বাদুড়! বাদুড়! পরদিন সকালে কাকের বাসা থেকে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। গ্যারেজের দরজার সমান একেকটা!
।রবিন মিথ্যে বলে না, তবু বিশ্বাস করতে পারল না মুসা। বাদুড় পানিতে সাঁতার কাটে না। আর গ্যারেজের দরজার সমান বড়ও হয় না। কিন্তু রেলিঙের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হল। বিশাল কালো ডানা নেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠছে প্রাণীটা, আবার ঝুপ করে পড়ছে পানিতে।
ঘোষকের পদটা দেয়া হয়েছে রবিনকে। দিনের বেশির ভাগ সময়ই কাকের বাসায় বসে থাকে, চোখ রাখে সাগরের দিকে। আকর্ষণীয় কোন প্রাণী দেখলেই চিৎকার করে জানায়। সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে ছোটে জাহাজ। কাছে গিয়ে, যদি দেখা যায়, ধরার উপযোগী, তাহলে ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়।
হাত তুলে যেদিকে দেখাচ্ছে রবিন, সেদিকে জাহাজের মুখ ঘোরাল কলিগ। বিনকিউলার নিয়ে ছুটে এল কিশোর। মুসা তো বিশ্বাস করতে পারেনি না দেখে, দেখেও করতে পারল না। কী ওগুলো? জিজ্ঞেস করল ক্যাপ্টেনকে।
সাগরের বাদুড়। জেলেরা বলে শয়তান মাছ।
কালো একঝাঁক দানব খেলা জুড়েছে পানিতে। দেখেই বুঝল কিশোর, এই জিনিসই চান লিসটার, তার চাহিদার তালিকায় রয়েছে এর নাম। ম্যানটা। আরেকটা নাম আছে এগুলোর, জায়ান্ট রে।
কিন্তু ধরবে কিভাবে? ট্যাংকে জায়গা হবে?
কাছে গিয়ে দেখা গেল, খেলছে না ম্যানটাগুলো। মাছ ধরে খাচ্ছে। কাছের বিশেষ একটা ম্যানটার ওপর নজর দিল ওরা। কাত হয়ে একটা সাঁতার কাটছে পানিতে, একটা ডানা পানির ওপরে, আরেকটা নিচে। এক ডানার মাথা থেকে আরেক ডানার মাথা বিশ ফুটের কম না। মাথা থেকে লেজের ডগা আঠারো ফুট। একঝাঁক মুলেটকে তাড়া করেছে ওটা।
মুখের দুপাশে দুটো লম্বা চ্যাপটা ডানার মত, কিংবা হাতও বলা যায়। ওগুলো দিয়ে মাছ ধরে ধরে ঠেলে দিচ্ছে মুখের ভেতর।
আর কি একখান মুখ! চার ফুট চওড়া। দুটো মানুষকে এক লোকমায় ঢুকিয়ে ফেলতে পারবে মুখের ভেতর।
কিন্তু কিশোর জানে, জায়ান্ট রে মানুষখেকো নয়। মাছই পছন্দ।
মানুষ খায় না বলেই যে নিরীহ, তা নয়। ভীষণ বিপজ্জনক। শোনা যায়, শূন্যে লাফিয়ে উঠে ডানা ছড়িয়ে ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ে নৌকার ওপর। দুই টনী দেহটা দিয়ে চেপে, বাড়ি মেরে গুড়িয়ে দেয় নৌকা, মেরে ফেলে আরোহীদের। চাবুকের মত লেজের বাড়ি ছুরির মত কেটে বসে চামড়ায়। কোন কোন সময় শূন্যে না উঠে নিঃশব্দে নৌকার তলায় চলে আসে ম্যানটা, তারপর ভেসে উঠে নৌকা উল্টে দেয়। আরোহীরা পড়ে গেলে ওদের মাঝে দাপাদাপি করতে থাকে। এতে মারা যায় মানুষ। যাদের ভাগ্য ভাল তারা জখম হয়।
মানুষকে ভয় করে না এরা। হয়ত ভয় করার মত বুদ্ধিই নেই। কিংবা হয়ত নিজের ক্ষমতার ওপর প্রচণ্ড বিশ্বাস। কখনও কখনও নৌকার সঙ্গে সঙ্গে মাইলের পর মাইল সাঁতরে চলে যায়, সামনে আসে, পেছনে যায়, পাশে সাঁতরায়, মাঝে মাঝে লাফিয়ে চলে যায় নৌকার একপাশ থেকে আরেক পাশে, আরোহীদের মাথার ওপর দিয়ে। দাড়ের বাড়ি যেন ওদের গায়েই লাগে না, ব্যথা পায় বলে মনে হয় না।
জাহাজ থেকে একবার একজন লোক একেবারে ম্যানটার মুখের ভেতর পড়ে গিয়েছিল। মানুষের স্বাদ মোটেও পছন্দ হয়নি ওটার, থুথু করে ছিটিয়ে ফেলেছিল। দানবটার নিচের পাটির দাঁতে লেগে চামড়া ছড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন ক্ষতি হয়নি লোকটার।
জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে পালে হাওয়া লাগানো কমালো কলিগ। ধীরে ধীরে ভেসে এসে থামল ম্যানটার ঝাঁকের ভেতর। ঝুলে পড়েছে পাল, পতপত করছে অলস ভঙ্গিতে। দুপাশে পানিতে উঠছে নামছে বড় বড় কালো ডানা। জাহাজটার সান্নিধ্য যেন পছন্দ হয়েছে দানবগুলোর। সঙ্গ ভালবাসে ওরা। সেজন্যেই দলবেঁধে থাকে অনেক সময়। গুনে ফেলল কিশোর। মোট আটাশটা ম্যানটা।
কিশোরের বিস্ময় দেখে হাসল কলিগ। তারপর? কাছে তো এলাম, এখন কি করা?
একটাকে জ্যান্ত ধরতে চাই।
খেত খোত করে নাক টানল ক্যাপ্টেন। তা পারবে না। মেরে হয়ত ভোলা যায়, জ্যান্ত ধরতে পারবে না। হারপুন বের করতে বলব?
না। কিশোর চেঁচিয়ে আদেশ দিতে আরম্ভ করল বড়দের মত করে, মুসা, কুমালো, জলদি নিচে থেকে বড় জালটা নিয়ে এস। জামবু, ডিঙি নামাও। ক্যাপ্টেন, জাহাজ সোজা রাখুন, নড়েচড়ে না যেন।
ভুরু কুঁচকে ফেলল কলিগ। কি করতে চাও?
বড় দেখে একটাকে ধরব। জালের একমাথা জাহাজে বেঁধে, আরেক মাথা। ডিঙিতে ধরে রেখে বেড় দেব।
পাগল…, থেমে গেল ক্যাপ্টেন। তার কথা শোনার জন্যে ওখানে দাঁড়িয়ে নেই কিশোর। বিড়বিড় করল সে, ছেলেটার মাথা খারাপ!
ভারি জালের একমাথা শক্ত করে বাঁধা হল জাহাজের ক্যাপস্ট্যানের সঙ্গে। জালের বাকি অংশ ডিঙিতে ফেলে তাতে উঠে বসল কিশোর, মুসা আর কুমালো। দাঁড় বেয়ে সরে যেতে লাগল জাহাজের কাছ থেকে, ধীরে ধীরে পানিতে পড়ছে জাল।
জালটা যখন পুরোপুরি পড়ে সারল, ডিঙি তখন জাহাজ থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরে। জালের আরেক মাথা শক্ত করে বেঁধে ফেলা হল ডিঙির ছোট একটা খুঁটির সঙ্গে, নোঙরের দড়ি বাঁধা হয় যেটাতে।
চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে জালে এসে ঠেকল বড় একটা ম্যানটা, ওটাকে নিশানা করেই ফেলা হয়েছে জাল। এরপর যা ঘটল এমনটি ঘটবে কল্পনাও করতে পারেনি কেউ।
ঘুরে এল ম্যানটা। নৌকাটাকে দেখলই না যেন। কাছে থেকে আরও বড় আরও ভয়ঙ্কর মনে হল ওটাকে। পানি থেকে উঠে রয়েছে জালের ওপরের অংশ।
কি করে যেন বুঝে গেল শয়তান মাছ, বাধা আছে সামনে। গতি কমাল না, বরং বাড়িয়ে দিল। বাড়ছে, বাড়ছে…স্পীডবোটের মত শা শা করে ছুটছে পানি কেটে।
তারপর হঠাৎ লাফ দিল শূন্যে। নিখুঁতভাবে জালটাকে পেরিয়ে গেল দশ ফুট ওপর দিয়ে। মনে হল, ঝড়ে উড়ে গিয়ে পড়ল একটা গ্যারেজের দরজা। বুমম করে বিকট শব্দ হল পানিতে পড়ার, যেন নেভির পাঁচ ইঞ্চি কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে।
পানিতে পড়েই আবার ছুটতে শুরু করল ম্যানটা, নতুন একটা চক্র রচনা করছে। তার উত্তেজনা সংক্রমিত হল অন্য দানবগুলোর মাঝেও, একের পর এক শূন্যে লাফিয়ে উঠতে লাগল ওগুলো, পানিতে পড়ছে প্রচণ্ড শব্দ তুলে। পড়েই, ডিগবাজি খেয়ে চিত হয়ে যাচ্ছে কোন কোনটা, রোদে ঝিক করে উঠছে সাদা পেট।
কৌতূহলী হয়ে উঠেছে নৌকাটাকে দেখে, দেখতে আসছে কাছে থেকে।
ব্যাটারা দল বেঁধে হামলা চালাবে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
ক্যাপ্টেনের কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে কিশোর। বন্ধ উন্মাদই কেবল ডিঙি নিয়ে আটাশটা শয়তান মাছের ঝাঁকে নামার কথা ভাববে। কিংবা বোকা লোকে, জায়ান্ট রে সম্পর্কে যার কোন জ্ঞান নেই।
আরেকটা ম্যানটা এগোচ্ছে জালের দিকে। কাছাকাছি গিয়ে লাফিয়ে না পেরিয়ে শাঁ করে মোড় নিয়ে সোজা ছুটে আসতে লাগল নৌকার দিকে। হঠাৎ বুঝি চোখে পড়ল সামনের ডিঙিটাকে। লাফ দিল শূন্যে।
আরোহীদের চোখের সামনে থেকে সূর্য আড়াল করে দিল যেন একটুকরো কালো মেঘ। মাথা নিচু করে ফেলেছে কিশোর। ভাবছে, এখুনি বিশাল বপু নিয়ে ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে দানবটা। মুসাও মাথা নুইয়ে ফেলেছে। শুধু কুমালো পাটাতনের ওপরে বসে আছে হাসিমুখে, শান্ত। কারণটা বোঝা গেল। ডিঙিতে পড়ল না ম্যানটা। উড়ে গিয়ে পড়ল আরেকপাশে পানিতে। চাবুকের মত লেজটা বাড়ি লাগল নৌকার পাশে, গভীর একটা ক্ষত করে দিল।
কাছে এসে গভীর আগ্রহে নৌকাটাকে দেখছে আরেকটা শয়তান মাছ। আস্তে ডানা তুলে ছুঁয়ে দেখল, তাতেই থরথর করে কেঁপে উঠল ডিঙি। জোরে বাড়ি দিলে কি হত কে জানে! হঠাৎ ছুটতে শুরু করল, ঘুরে এগিয়ে যাচ্ছে জালের দিকে।
পেয়েছি ব্যাটাকে! চিৎকার করে বলল কিশোর।
যদি নতুন কোন কাণ্ড না করে, মাথা তুলল মুসা।
আমার মনে হয় শুধু এগোতেই পারে ওরা, পিছাতে পারে না।
পিছানোর কোন লক্ষণও দেখাল না ম্যানটা। তবে জালের কাছে গিয়ে মসৃণ ভঙ্গিতে তুলে ফেলল একটা ডানা, তারপর আরেকটা, নিখুঁত ভাবে জাল এড়াল। কিন্তু লেজটা বাঁধল বিপত্তি। জালের খোপে ঢুকে গেল। লেজের ডগায় বসানো কাঁটাগুলো আটকে গেল বড়শির মত।
বাও! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
ঝপাত করে পানিতে পড়ল দুই জোড়া দাঁড়। প্রাণপণে বেয়ে চলল মুসা আর কুমালো, জাহাজের দিকে ছুটল ডিঙি নিয়ে। দানবটার ওপর দ্রুত চেপে আসতে লাগল জাল।
কিন্তু এত সহজে ধরা দেয়ার পাত্র নয় শয়তান মাছ। দাপাদাপি শুরু করল। সে তো আর চুনোপুঁটি নয়, পানির মহারাজ। তার দাপাদাপিতে ফুলেফেঁপে উঠল পানি, প্রচণ্ড ঘূর্ণি, অসংখ্য ফোয়ারা, ভিজিয়ে চুপচুপে করে দিল ডিঙির তিন আরোহীকে। দেখতে দেখতে পানিতে ভরে গেল ডিঙির খোল ডুবে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে এখন খুদে নৌকা।
ভাগ্য ভাল, বুদ্ধি করে নৌকার সঙ্গে জাল বাধা হয়েছিল। ধরে রাখলে সর্বনাশ হত। হ্যাঁচকা টান লেগে একবার এদিকে ঘুরছে ডিঙি, আবার ওদিকে। কয়েকবার কাত হয়েও সোজা হয়ে গেল। আর সামান্য কাত হলেই যেত উল্টে।
অবশেষে জাহাজের কাছাকাছি চলে এল নৌকা। রেলিঙে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে ক্যাপ্টেন, চোখ বড় বড়, কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে বুঝি। জালের দড়িটা দাও আমার হাতে! চেঁচিয়ে বলল সে। কুইক!।
ডিঙির সঙ্গে বাঁধা দড়িটা খুলে ছুঁড়ে দিল কিশোর। খপ করে ধরল ক্যাপ্টেন। তাড়াতাড়ি নিয়ে গিয়ে পেঁচিয়ে ফেলল ক্যাপস্ট্যানে।
জালের দুই মাথা-ই এখন শক্ত করে বাঁধা হয়েছে ক্যাপস্ট্যানের সঙ্গে। আটকা পড়েছে দানবটা, পালানোর পথ বন্ধ।
কারগো বুমটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সরিয়ে আনছে জামবু। প্রধান মাস্তুলের সঙ্গে লাগানো রয়েছে ওটা, এক মাথায় একটা বড় আঁকশি লাগানো। আঁকশিটা জালে আটকে দিল কিশোর।
চাল হয়ে গেল ইঞ্জিন। আঁকশিটা ওপরে উঠতে লাগল, সেই সাথে টেনে তুলতে লাগল জাল।
হাততালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল কাকের বাসায় বসা রবিন। তার সঙ্গে গলা মেলাল বোটের আরোহীরা। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি খুশি হওয়া উচিত হয়নি ওদের। জালের মধ্যে ভীষণ দাপাদাপি শুরু করেছে ম্যানটা, এখন আর খেলাচ্ছলে নয়, মুক্তির জন্যে। ডানা ঝাড়ছে, লেজ দিয়ে বাড়ি মারার চেষ্টা করছে। শপাং করে এসে বোটে লাগল লেজের বাড়ি। নৌকার যেখানে লাগল, গুড়িয়ে গেল ডিমের খোসার মত।
কখন পানিতে পড়ল, বুঝতেও পারল না মুসা। মাথা তুলে চেয়ে দেখল, তার পাশেই হাবুডুবু খাচ্ছে কিশোর। দ্রুত ওকে টেনে নিয়ে সাঁতরে ম্যাটার কাছ থেকে সরে এল সে। ওপর থেকে দড়ি ছুঁড়ে দিল কলিগ। সেটা ধরে বেয়ে ডেকে উঠে এল দুজনে।
এতক্ষণে কুমালোকে দেখতে পেল ওরা। শয়তান মাছের লেজের বাড়ি খেয়ে বোধহয় বেহুঁশই হয়ে গেছে বেচারা। ভাসছে। রক্ত বেরোচ্ছে ক্ষত থেকে। ইতিমধ্যেই রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছে হাঙরেরা, দূরে ভেসে উঠেছে ওদের পিঠের পাখনা। পানি কেটে ছুটে আসছে তীব্র গতিতে।
একটানে কোমরের খাপ থেকে বড় ছুরি বের করল মুসা।
বাধা দিল ক্যাপ্টেন, যেও না! বাঁচাতে পারবে না।
দূর, মরুক না ডুবে, ঘৃণায় মুখ বাঁকাল জামবু। একটা কানাকার জন্যে মরবে নাকি গিয়ে?
দ্বিধা যাও বা সামান্য ছিল মুসার, জামবুর কথায় একেবারে দূর হয়ে গেল। রাগে জ্বলে উঠল সে। ডাইভ দিয়ে পড়ল রক্তাক্ত সাগরে। দড়িটা নিতে ভুলল না। ওটার মাথা কুমালোর বুকে পেঁচিয়ে বাঁধল।
হাজির হয়ে গেল একটা হাঙর। হাত লম্বা করে ছুরিটা সোজা করে ধরে রাখল মুসা। পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় লাগল হাঙরের শরীরে। ওটার ঘাড়ের নিচ থেকে লেজের কাছাকাছি লম্বা হয়ে ফেড়ে গেল গভীরভাবে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। খাবি খেতে খেতে দৌড় দিল একদিকে, যন্ত্রণায় শরীর মোচড়াচ্ছে। মানুষের দিক থেকে নজর সরে গেল অন্যান্য হাঙরগুলোর। ছুটে গেল জাতভায়ের মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে।
দড়ি ধরে টেনে তুলে নেয়া হল কুমালোকে। পানিতে অপেক্ষা করছে মুসা, আবার দড়িটা এলে তারপর উঠবে। চোখ হাঙরগুলোর দিকে। কয়েক গজ দূরে আহত হাঙরের গা থেকে মাংস খুলে নিচ্ছে অন্যগুলো। দেখতে দেখতে শেষ করে ফেলবে।
মুসার মনে হল, কয়েক যুগ পরে তার পাশে এসে পড়ল দড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে ধরল। টেনে তুলে নেয়া হল ওকেও।
একবার মাত্র চোখ খুলল কুমালো, মুসাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্যে, তারপরই মুদে ফেলল। পড়ে রইল মড়ার মত। কাকের বাসা থেকে নেমে এসেছে রবিন। সে আর কিশোর মিলে কুমালোর জখম ধুয়ে মুছে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিতে লাগল।
গেল একটা চমৎকার ডিঙি, পানির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্যাপ্টেন। জালের মধ্যে এখনও দাপাচ্ছে ম্যানটা। পানিতে আলোড়ন তুলেছে। তাতে ডুবছে ভাসছে নৌকার ভাঙা কাঠগুলো। নৌকা ভাঙার সমস্ত ঝাল গিয়ে ওটার ওপর পড়ল কলিগের। চেঁচিয়ে বলল, তোলো ব্যাটাকে! যেন তুললেই বেত দিয়ে পেটানো শুরু করবে।
উঠে যাচ্ছে জাল। ওপরে, আরও ওপরে। কামড়ে কয়েক জায়গায় জাল কেটে ফেলেছে শয়তান মাছ। এছাড়া আর কোন ক্ষতি করতে পারেনি সাংঘাতিক শক্ত জালটার। দানব ধরার জন্যেই যেন তৈরি হয়েছে ওটা। জালটাকে নামিয়ে আনা হল ট্যাংকের মুখের কাছে।
ট্যাংকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আন্দাজ করে ফেলল কিশোর। নাহ, অসুবিধে কিছুটা হলেও জায়গা হয়ে যাবে ম্যানটার। সত্যিই হয়ে গেল। কিন্তু নতুন বাড়ি মোটেও পছন্দ হল না শয়তান মাছের। আবার শুরু করল দাপাদাপি। ছিটিয়ে সমস্ত পানি ফেলে দিতে লাগল বাইরে। চালু করে দেয়া হল পাম্প, পালি, ভরতে লাগল ট্যাংকে। বড় ঢাকনাটা লাগিয়ে দেয়া হল, যাতে লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারে অতিকায় প্রাণীটা।
ট্যাংকের দেয়ালে মোটা কাচে ঢাকা জানালা রয়েছে। সবাই হুড়াহুড়ি করে এসে চোখ রাখল তাতে, ভেতরে শয়তান মাছ কি করে দেখার জন্যে।
শান্ত হয়ে গেছে জায়ান্ট রে। ট্যাংকের তলায় বিছিয়ে রয়েছে মস্ত এক কালো চাঁদরের মত। জালটা এখনও জড়ানোই রয়েছে শরীরে।
খুলবে কি করে ওটা? রবিন জিজ্ঞেস করল।
দানবটার সঙ্গে আরেকবার ধস্তাধস্তি করার কোন ইচ্ছেই নেই কিশোরের। বলল, থাক, জালের মধ্যেই। বের করতে সুবিধে হবে। আশা করি দিন দুয়েকের মধ্যেই হনুলুলু পৌঁছবে। তখন কোন একটা মালবাহী স্টীমারে তুলে দেব, লস অ্যাঞ্জেলেসে পৌঁছে দেবে। ট্যাংকটা দরকার আমাদের। আরেকজনের জন্যে খালি করতে হবে।
কার জন্যে? অক্টোপাস?
হয়ত। মুসা, জনাব শয়তানের বাবুর্চি নিযুক্ত করা হল তোমাকে। জন্তুজানোয়ারকে খাওয়ানোর ব্যাপারটা তুমিই ভাল বোঝ। যত পার মাছ খাওয়াবে।
ডিঙি তো নেই, মাছ ধরব কিভাবে? বলেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুসার চোখের তারা। আছে, উপায় আছে!
কিভাবে? রবিন জানতে চাইল। রাতেই দেখবে।
রাতে, ডেকে বসে পালের ওপর টর্চের আলো ফেলে রাখল মুসা। আলো দেখে পাগল হয়ে গেল যেন উড়ুক্কু মাছের দল। একের পর এক এসে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল মাস্তুলে, পালে। বাড়ি খেয়ে অবশ হয়ে পড়ল কোনটা, কোনটা পাল থেকে গড়িয়ে পড়ল ডেকে। জমাতে শুরু করল মুসা আর কুমালো। মজা পেয়ে রবিন আর কিশোরও হাত লাগাল। দেখতে দেখতে মাছের ছোটখাট একটা স্থূপ দিয়ে ফেলল।
নিশ্চিন্ত হল তিন গোয়েন্দা। খাবারের অভাব হবে না জনাব শয়তানের।