১০. শহরে মাত্র একটা বিজনেস স্ট্রীট

0 Comments

শহরে মাত্র একটা বিজনেস স্ট্রীট। কাজেই পোস্ট এক্সচেঞ্জটা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না জামবুর।

ভেতরে ঢুকে এমন ভাব করল, যেন এখানে তার সঙ্গে কারও দেখা করার কথা। বিশালদহেী এক লোক এগিয়ে এল, পিঠটা সামান্য কুঁজো। হাসল না। হাত বাড়িয়ে দিল না। রূঢ়কণ্ঠে বলল, এতক্ষণে এলে? জাহাজটা সেই কখন ঢুকতে দেখলাম। আধ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি: এখানে। চোখে সন্দেহ নিয়ে আড়চোখে তাকাল একবার ক্লার্কের দিকে। বেরোও। এখানে কথা বলা যাবে না।

মেইন রোড ধরে এগোল ওরা। পয়লা মোড়টাতেই ঘুরে নেমে পড়ল একটা গলিতে। এঁকেবেঁকে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে পথটা, পাতার কুঁড়েগুলোর মাঝখান দিয়ে। প্রতিটি বাড়িতেই বাগান আছে। বাতাসে ফুলের সুবাস, জ্যাসমিন, ফ্র্যাঙ্গিপ্যানি, সিন্যামোন, আর আল্পও নানা জাতের ফুল। বিশাল একটা রুটিফল গাছের নিচ দিয়ে চলল দুজনে, ফুটবলের সমান বড় বড় ফল ধরে আছে গাছটাতে। পথে ওরকম আরও ডজন খানেক গাছ পড়ল। আরও নানারকম উদ্ভিদ। একটা বোটানিকেল গার্ডেনে এসে হাজির হয়েছে যেন।

গাছপালার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ে এখানকার মানুষগুলো। পুরুষেরা ছয় ফুটের বেশি লম্বা, পেশিবহুল শরীর, বাদামি চামড়া। মেয়েরাও কম লম্বা নয়। খোঁপায় সাদা ফুল গোঁজা, কিংবা মালা জড়ানো। হাসিখুশি মোটাসোটা শিশু তাদের কোলে। রাস্তার ওপর বসে আছে একটা সুন্দর বাচ্চা। বিশালদেহী লোকটার দিকে চেয়ে ফোকলা হাসি হাসল।

পা দিয়ে ঠেলে, প্রায় লাথি মেরেই বাচ্চাটাকে পাশের ঝোপে ফেলে দিল লোকটা। চিৎকার করে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।

অস্বস্তি বোধ করছে জামবু। লোকটা ভীষণ বদমেজাজী। ভয়ই পাচ্ছে এখন। যা বলতে এসেছে, সেটা শুনে মোটেই খুশি হবে না ও। কারণ খুশি করার মত কোন তথ্য জানতে পারেনি সে।

ইউরোপিয়ান স্টাইলে তৈরি একটা বাড়ির বাগানে ঢুকল ওরা। লেবু, কমলা, ডালিম, ম্যাংগোস্টীন আর পিকক পাম নামে একজাতের তাল জাতীয় গাছ প্রচুর জন্মে আছে।

ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলল লোকটা। জামবুকে নিয়ে এল একটা ঘরে। ছাতা পড়া দেয়াল। তাড়াহুড়ো করে এসে ঢুকল দুজন পোনাপিয়ান চাকর। চেয়ার সাজিয়ে দিল মেয়েটা। পুরুষটা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, প্রভু কি খেতে ইচ্ছে করেন।

বেরো এখান থেকে! গর্জে উঠল লোকটা। দুজনেই যা! বলেই ঘাড় ধরে ধাক্কা মারল মেয়েটাকে। হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল সে তার সঙ্গীর, পিঠে। পেছন ফিরেও তাকাল না আর ওরা। দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল লোকটা।

নোঙরা ছুঁচোর দল! খেপা কুকুরের মত দাঁত খিচাল সে। বাদামী চামড়ার নিকুচি করি! আমাকে দায়িত্ব দিলে কবে দ্বীপ থেকে ঝেটিয়ে খেদাতাম ব্যাটাদের!

একটা চেয়ারে জামুবকে বসার ইঙ্গিত করে তার মুখখামুখি আরেক চেয়ারে। বসল লোকটা। সামনে ঝুঁকল। দুজনের চোখের দূরত্ব এখন মাত্র দুই ফুট। তার বাঁকা পিঠ দেখে মনে হয়, শিকারের ওপর ঝাঁপ দিতে তৈরি হচ্ছে সিংহ।

অল রাইট। বলে ফেলো এবার! ঘেঁকিয়ে উঠল লোকটা। অবস্থান জানতে পেরেছ?

শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে যেন জামবুর। যত দেরি করে বলা যায়, ততই ভাল। বড় শক্ত কাজ দিয়েছেন আমাকে। কত চেষ্টা করলাম। যখনি ওরা কথা বলেছে, আড়ি পেতেছি। দ্বীপটা সম্পর্কে একটা কথা বলেনি। ওদের জিনিসপত্র…

অতো কথা শুনতে চাই না। দ্বীপটা কোথায় জেনেছ? জেনেছি বলব না, তবে…।

কথা শেষ করতে পারল না জামবু। বিশাল মুঠোর এক ঘুসি এসে লাগল মুখে। ঝটকা দিয়ে ঘুরে গেল মাথা, চেয়ার উন্টে ধুড়ুম করে মেঝেতে পড়ল সে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল, রক্তাক্ত নাক চেপে ধরেছে।

এর জন্যে….এর জন্যে ভুগতে হবে তোমাকে ডেংগু…

ভয় দেখাচ্ছিস? কাছে এসে দাঁড়াল ডেংগু ! জামবুর মনে হল বিশাল এক পাহাড় এসে দাঁড়িয়েছে তার মাথার ওপর। পাহাড়টার হাত রিভলভারের বাঁটে।

আমি…আমি কিছু ভেবে বলিনি, মিস্টার পারভি!

খটাস করে জামবুর কানে পিস্তলের বাটের বাড়ি পড়ল। চুপ, ব্যাটা! খবরদার, আর কখনও আমার নাম মুখে আনবি না। আমি চাই না, এখানে কেউ আমাকে চিনে ফেলুক।

চিনবে না? সবাই তো জানে আপনি অনেক বড় মুক্তা ব্যবসায়ী, সুলু সাগরের থারসডে আইল্যাণ্ড থেকে এসেছেন।

ওখানে জানে, এখানে না। মুক্তার কথা ভাবেই না কেউ এখানে।

বেশ, ডেংগু পারভি নন আপনি। বিষুব অঞ্চলের দক্ষিণ থেকে আসেননি, মুক্তা ব্যবসায়ী নন। তাহলে কে আপনি?

সোজা হল লোকটা। ধুর্ত এক চিলতে হাসি ঠোঁটে ফুটেই মিলিয়ে গেল। আমি? কিছু যদি মনে না কর, তাহলে আমি রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন। আমেরিকায় গো-ইয়ে-ফোর্থ গির্জার পাদ্রী ছিলাম। এখন মিশনারি। সুদুর এই দ্বীপে উড়ে এসেছি এখানকার অসভ্য মানুষগুলোর মনে ঈশ্বরের আলো জ্বালাতে।

গুঙিয়ে উঠল জামবু। আপনার যা ভাবসাব, কি করে বিশ্বাস করাবেন আপনি মিশনারি? দুদুটো খুনের অপরাধে আপনাকে খুঁজছে পুলিশ। ধরতে পারলেই

আবার নিয়ে গিয়ে জেলে ঢোকাবে।

ধরতে পারলে তবে তো। আর বিশ্বাস কিভাবে করাব বলছ? শুনলে অবাক হবে, দোস্ত, আমার বাবা সত্যিই পাদ্রী-ছিল। সানডে ইস্কুলে পড়ালেখা করতে বাধ্য করা হয়েছে আমাকে। বাইবেল আমার মুখস্থ, গড়গড় করে বলে যেতে পারি। মাঝে মাঝে উচ্চারণে গোলমাল করে ফেলি বটে, কিন্তু এখানে কে সেটা বুঝবে? জেলখানার পাদ্রীই ধরতে পারেনি।

কিন্তু এই ছদ্মবেশ কেন?,

ডেংগুর হাসি দূর হয়ে গেল। কেন সেটা আবার জিজ্ঞেস করছ? গর্জে উঠল সে। গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ ছিল, তোমাকে দিয়ে হবে না এই কাজ। মনে মনে তৈরিই ছিলাম, কি করতে হবে।

ছেলেগুলোকে ফাঁকি দেবেন?

নিশ্চয়ই। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে, আমার মত একজন ভদ্রলোককে পেলে খুশিই হবে। ভুলিয়ে ভালিয়ে কথা ঠিকই আদায় করে ফেলব। ইতিমধ্যেই অবশ্য অনেক কিছু জেনে গেছি। বাগ লুকিয়ে রেখেছিলাম প্রফেসরের ল্যাবরেটরিতে। প্রত্যেকটা কথা শুনেছি। প্রফেসর ব্যাটা খুব চালাক। দ্বীপটার অবস্থানের কথা মুখে কিছু বলেনি। ছেলেগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পর ওদের পিছু নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডটাও চিনে এসেছি। তবে তাতে তেমন কোন কাজ হয়নি। এক মুহূর্ত থামল সে। কাজ করতে পারার কথা ছিল তোমার। এত পথ একসঙ্গে এসেছ। কিন্তু বুদ্ধ তো, পারবে কি করে।

রিভলভারটা আবার শোল্ডার হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল ডেংগু। জামবুকে দরজা দেখিয়ে বলল, যেতে পার এবার। আমার অনেক সময় নষ্ট করেছ।

কিন্তু জামবু নড়ল না। কথা ভুলে যাচ্ছেন না আপনি?

কথা? কিসের কথা?

আমার টাকা?

কুকুরের মত ঠোঁট ভেঙুচাল ডেংগু। আবার টাকা! কাজটা কি করেছ শুনি? কিছুই জানতে পারোনি, উল্টো ছেলেগুলোর সন্দেহ জাগিয়ে দিয়ে এসেছ। তোমার বরং এখন আমাকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা। যাও ভাগো। নইলে ঘাড় মটকে দেব।

যাচ্ছি, নাকী সুরে বলে দরজার দিকে এগোল জামবু। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অনেকটা নিরাপদ বোধ করল, বলল, এর জন্যে ভুগতে হবে তোমাকে, ডেংগু, কপালে দুঃখ আছে। তোমার সমস্ত জারিজুরি ফাঁস না করে দিয়েছি তো আমার নাম জামবু নয়। এখুনি আমি ছেলেগুলোকে গিয়ে সব বলে দেব।

কালো হয়ে গেল ডেংগুর মুখ। হাত চলে গেল রিভলভারের বাটে। কিন্তু বের করতে গিয়েও করল না। দ্রুত ভাবনা চলেছে মাথায়। জামবু ঠিকই বলেছে, তার সমস্ত জারিজুরি খতম করে দিতে পারে। ওকে থামাতে হবে। কিন্তু কিভাবে? এই দিনের বেলা খুন্ন করা চলবে না। গুলির শব্দ অনেকের কানে যাবে এখানে গুলি করলে। টাকা দিয়ে দেবে? তাহলেও শয়তানটার মুখ বন্ধ করা যাবে কিনা সন্দেহ। আরও টাকার জন্যে চাপ দেবে, শুরু করবে ব্ল্যাকমেইল। না, অন্য কোন ভাল ব্যবস্থা করতে হবে।

চেহারাটা স্বাভাবিক রাখল ডেংগু। শোনো, এদিকে এস। বুঝতে পেরেছি, দুর্ব্যবহার করে ফেলেছি তোমার সঙ্গে। তোমার সাধ্যমত করেছ, ছেলেগুলো মুখ না খুললে তুমি কি করবে? এরচে বেশি অন্য কেউ হলেও করতে পারত না। ঠিক আছে, টাকা আমি তোমাকে দেব। গলাটা শুকিয়ে গেছে। চল, কোথাও বসে ভিজিয়ে নেয়া যাক।

ডেংগুর এই হঠাৎ পবিবর্তনে সন্দেহ হল জামবুর। কিন্তু টাকা আর মদের লোভও সামলাতে পারল না। লোকটার সঙ্গে চলল সে।

আবার মেইন স্ট্রীটে ফিরে এল ওরা। টিলাটার দিকে এগোচ্ছে ডেংগু, যেটাতে ছেলেরা উঠেছে। অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জামবু।

কিন্তু বাংলো পর্যন্ত গেল না ডেংগু। তার আগেই রাস্তা পেরিয়ে ছোট একটা লিকার শপের দিকে এগোল।

একটা গাছের নিচে জটলা করছে কয়েকজন পোনাপিয়ান জেলে, মাছ ধরে ক্লান্ত হয়ে এখন বিশ্রাম নিতে এসেছে। তাদের ঠেলে সরিয়ে দোকানের দরজার দিকে এগোল ডেংগু। জামবুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। রোগাটে একজন শ্বেতাঙ্গ বসে আছে কাউন্টারের ওপাশে।

তাকে বলল ডেংগু, বিল, ও আমার বন্ধু, জামরুকে দেখাল সে। এইমাত্র এল। গলা ভেজানো দরকার। বেশি করে দিতে হবে।

নিশ্চয়, বিল বলল। হতচ্ছাড়া এই দেশে তো কেউ আসে না। বন্ধু এসেছে, তোমার কেমন খুশি লাগছে, বুঝতেই পারছি। দেব, যত চাও।

আনন্দ করতে চাই আজ, জানালার বাইরে তাকাল ডেংগু। মন খুলে। আর পার্টি ছাড়া আনন্দ হয় না। লোক আর পাব কোথায়? জামবু, ওই ব্যাটাদেরই গিয়ে ডেকে আনে।

না না, ওদের নয়, তাড়াতাড়ি বাধা দিল বিল। বাদামিদের মদ খাওয়া এখানে বেআইনী।

আরে রাখ তোমার আইন! পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করে বিলের নাকের কাছে নাড়ল। এই যে আইন। জামবু, যাও, ডেকে আনো।

কানাকাগুলোকে মদ খাওয়ানোর কোন ইচ্ছেই নেই জামবুর। কিন্তু ডেংগুর যদি পয়সা বেশি হয়ে যায় তার কি? দরজায় বেরিয়ে হাত তুলে ডাকল লোকগুলোকে। অদৃশ্য গেলাস ঠোঁটের কাছে নিয়ে মদ খাওয়ার ভঙ্গি করল।

একবারই যথেষ্ট। হুল্লোড় করে ছুটে এল জেলেরা।

মদ তো নয়, পোনাপিয়ানদের জন্যে ডিনামাইট। ওসব ছাড়াই ওদের শান্ত রাখা মুশকিল, যোদ্ধার রক্ত ওদের শরীরে, পূর্বপুরুষেরা ছিল দারুণ লডুয়ে, কথায় কথায় লেগে যেত। মদ পেটে পড়লে যেন উন্মাদ হয়ে যায়। এই জন্যেই ওদের কাছে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

একটা কাজ করতে পারি আমি, বিল বলল। মদ তোমার কাছে বিক্রি করব। তোমার জিনিস তুমি কাকে দেবে, সেটা তোমার ব্যাপার।

ঠিক আছে। খুব কড়া দেখে দাও।…জামবু, এই নাও টাকা, বিশ ডলার তার হাতে গুঁজে দিল ডেংগু। যত খুশি মদ কিনে খাওয়াও বন্ধুদের। টাকা লাগে আরও দেব।

টাকাটা বিলকে দিল জামবু।

ও-কে। এই রসিদটা সই কতো, মেমোবুকটা ঠেলে দিল বিল।

কেন?

নিয়ম। এখানে মদ কিনলে সই করতে হয়। কার কাছে বিক্রি করলাম পুলিশ জানতে চাইবে।

মদ খাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে গেছে জামবু। কিছুই না ভেবে সই করে দিল।

ফিরে চেয়ে দেখল, ডেংগু নেই, কোন্ ফাঁকে চলে গেছে।

ঘন্টা দুয়েক পর তুমুল হই-হট্টগোল কানে এল তিন গোয়েন্দার। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখায় ব্যাঘাত ঘটল ওদের।

ক্যাপ্টেন কলিগ জাহাজে ফিরে গেছে। কুমালো রান্নাঘরে ব্যস্ত।

কুমালো, ডেকে বলল কিশোর। বাইরে গিয়ে দেখ তো কি হয়েছে।

বেরিয়ে গেল কুমালো। খানিক পরেই হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল। দাঙ্গা লেগেছে…-জামবুকে পুলিসে ধরেছে…।

হুড়াহুড়ি করে রাস্তায় বেরোল তিন গোয়েন্দা।

এদিক ওদিক দৌড় দিয়েছে জনাবারো পোনাপিয়ান, মাতাল বোঝাই যায়। ছুরি মারামারি করেছে দুজনে, শরীর জখম, রক্ত ঝরছে। রাস্তার অনেক নিচে জামবুকে ধরেছে দুজন নেভাল পুলিশ।

পথের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা এক লোক, পিঠ সামান্য কুঁজো। হাতে কাল একটা বই।

ছেলেরা এগোল। তাদেরকে দেখে এগিয়ে এল লোকটা। দুর্ভাগ্য, বলল সে। ভারি দুর্ভাগ্য ওদের। করুণার দৃষ্টিতে তাকাল মাতালগুলোর দিকে।

কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ওই জাহাজীটা মদ খাইয়েছে ওদের। বেআইনী, ভীষণ বেআইনী! ঈশ্বর তো নিষিদ্ধ করেছেনই, মানুষও করেছে এখানে। বাইরে থেকে আসে শয়তান, এখানকার নিস্পাপ সরল লোকগুলোর সর্বনাশ করে।

জামবুর দিকে তাকাল কিশোর। পুলিশে খবর দিল কে?

আমি দিয়েছি। এখানকার নাগরিক এবং মিশনারি হিসেবে এটাকে আমার কর্তব্য মনে করেছি।

কিশোর লক্ষ্য করল, লোকটার হাতের ছোট বইটা বাইবেল। ভাবল, পোনাপিয়ানদের সৌভাগ্য, এরকম একজন মানুষ পেয়েছে তাদের মাঝে।

কি শাস্তি হবে?

বেশি না, জোরে নিঃশ্বাস ফেলল মিশনারি। এই বড় জোর মাস দুই জেল। তারপর বের করে দেবে দ্বীপ থেকে। দেশে পাঠিয়ে দেবে।

জামবুর জন্যে সুপারিশ করতে যাবে কিনা ভাবল কিশোর। শেষে ভাবল, থাক, এই ভাল হয়েছে। শয়তানির শাস্তি হয়েছে, তার পথের কাঁটাও দূর হয়েছে। জাহাজে তুললে আবার লাগত ওর বিরুদ্ধে, প্রফেসরের গোপন দ্বীপের খবর জানার চেষ্টা চালাত। আরও কি কি করত কে জানে! জেনেশুনে বিপদ সঙ্গে নেয়ার কোন মানে হয় না। জেলে আটকে থাকলে তার আর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সৌভাগ্যই বলতে হবে।

জেলটা কি খুব খারাপ?

মোটেই না। খাবে আর ঘুমাবে, ব্যস। ওরকম একটা শয়তানের জন্যে বরং বেশি ভাল।

হাত বাড়িয়ে দিল কিশোর। আমি কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড। আজই এলাম, একটা জাহাজ নিয়ে। শুকমর্নিং স্টার। হারিক্যান একেবারে গুড়িয়ে দিয়েছে জাহাজটাকে।

তাই! আহা! আফসোস করল আগন্তুক। ধরল কিশোরের হাত। আমি হেনরি। রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন। রবিন আর মুসার সঙ্গেও হাত মেলাল সে।

পোনাপেতে কোন গির্জায় আছেন?

না। আমিও এসেছি এই কদিন আগে। এসে দেখি-গির্জা, পাদ্রী সবই আছে এখানে। ছোট এলাকা। কত আর পাদ্রী লাগে? ভাবছি, আশেপাশের অন্যান্য দ্বীপগুলোতে ঘুরব। ঈশ্বরের নাম যারা শোনেনি, সেইসব হতভাগ্যদের শোনাব তার কথা। যাব কিভাবে সেটা ভাবছি এখন।

বোট ভাড়া করবেন?

না। অত টাকা নেই আমার কাছে। দেখি, ওদিকে কোন বোট যায় কিনা। যাত্রী হয়ে যাব। আশা করি আমার অনুরোধ ফেলতে পারবে না কোন দ্রলোকের

ছেলে।

কোন দিকে যাওয়ার ইচ্ছে?

উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, যেদিকে খুশি। দ্বীপ আর তাতে মানুষ থাকলেই হল, যারা ঈশ্বরের নাম শোনেনি।…ও, আমার কথাই তো শুধু বকবক করে যাচ্ছি। তোমাদের কথা বল। পোনাপেতেই থাকবে?

না, বলল কিশোর। আশেপাশের দ্বীপ দেখার ইচ্ছে আমারও আছে। সুযোগ যখন পেয়েছি, ঘুরে দেখব। আবার কখন সুযোগ হয় না হয়, আদৌ হবে কিনা তাই বা কে জানে। মিশনারিকে যাত্রী হিসেরে নেয়ার আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েও জানাল না সে, থেমে গেল ঠিক মুহূর্তে। সাবধান করল তার খুঁতখুঁতে সতর্ক মন। অচেনা একজন লোক…ভাবল, দেখাই যাক না লোকটা নিজে থেকে কিছু বলে কিনা?

কিন্তু বলল না মিশনারি। বরং চুড়ান্ত ভদ্রতা আর সৌজন্য বোধেরই পরিচয় দিল। ঈশ্বর তোমাদের সহায় হোন। দোয়া করি, ভালভাবে, সুস্থ শরীরে ফিরে আস আবার পোনাপেতে। ওহহহ, আমার দেরি হয়ে গেল। অসহায় একটা লোককে বিনায় ফেলে এসেছি। বড় গরিব বেচারা। কঠিন অসুখ হয়েছে। একে একে তিনজনের সঙ্গে হাত মেলাল সে। ঘুরে রওনা হয়ে গেল।

নাহ, লোকটা ভালই, ভাবল কিশোর। আমরা সেদিকেই যাব শুনেও কিছু বললেন না, ইনিয়ে বিনিয়েও একবার জানালেন না তিনি যেতে আগ্রহী। আর কথাবার্তায় বেশ শিক্ষিত লোক মনে হল। সত্যিকার মিশনারিদের মতই কথা বলেন, অভিনয় বলে মনে হল না। যথেষ্ট স্মার্ট। তবে মানুষটার চোখ দুটো পছন্দ হয়নি তার, মনে হয় কি যেন গোপন করতে চায় ওই চোখ! তবে সেটা তেমন অস্বাভাবিক নয়। কত লোকের সঙ্গে মিশতে হয় মিশনারিদের, কত রকম জায়গায় যেতে হয়, বুদ্ধিমান না হলে চলবে কেন? সে শুনেছে, অনেক মিশনারিই ঘর তৈরি করতে জানে, চাষ করে ফসল ফলাতে পারে, ভাল ব্যবসা-বাণিজ্য জানে, ইঞ্জিন আর চিকিৎসাবিদ্যায়ও গভীর জ্ঞান আছে। এই ভদ্রলোককে দেখে মনে হল, ওসব –তো জানেনই, আরও বেশি কিছু জানেন। এমন একজন মানুষকে সঙ্গে নিতে পারলে খুশিই হত সে। দেখা যাক, সময় তো আছে। দ্রলোক সম্পর্কে আরও ভালমত খোঁজখবর নিতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে ডেংগু ভাবছে, ছেলেটা সাংঘাতিক চালাক। ওকে টোপ গেলানো কঠিন হবে। ওর মনে সামান্যতম সন্দেহ জাগালেই ভেস্তে যাবে সব। জামবু নয় ও। জামবুকে তো সহজেই জায়গা মত পাঠিয়ে দেয়া গেছে, আর কোন গোলমাল করতে পারবে না। এক সমস্যা তো গেছে, দেখা দিয়েছে আরেক

সমস্যা, কিশোর ছেলেটাকে কি করে পটানো যায়?

ডেংগু ভাবছে, ওই, ছেলের কাছ থেকে মুক্তাদ্বীপের অবস্থান জানতে পারবে।। পেটে বোমা মারলেও মুখ খুলবে না সে। জানতে হলে তার সঙ্গে ওই দ্বীপে যেতে হবে। তারপর কোনভাবে ছেলেগুলোকেও সরিয়ে দিতে হবে পথ থেকে। কিছু একটা ঘটাতে হবে ওদের। পুলিশ যাতে সন্দেহ করতে না পারে, ভাবে নিছক দুর্ঘটনা। তারপর মুক্তা তোলার একটা জাহাজ নিয়ে মুক্তাদ্বীপে চলে যাবে সে, তুলে আনবে সমস্ত ঝিনুক, মুক্তাগুলো বিক্রি করবে নিউ ইয়র্ক আর লণ্ডনের মুক্তা ব্যবসায়ীদের কাছে। ওই দুই শহরের অনেক জুয়েলারকে সে চেনে। দক্ষিণ সাগর থেকে মুক্তা এনে ওদের কাছেই বিক্রি করত,যখন মুক্তার ব্যবসা করত সে। অনেক আগেই প্রফেসর ইস্টউডের মুক্তার খামারের কথা কানে এসেছে তার, যখন সে সেলিবিসে ছিল। তখন পোনাপে যাবার পথে রসদ জোগাড়ের জন্যে ওখানে থেমেছিল প্রফেসরের জাহাজ। তাতে পারশিয়ান গালফ থেকে আনা নমুনাগুলো ছিল। সবুই জানা আছে তার, শুধু একটা কথা ছাড়া, একটা তথ্য–পার্ল ল্যাগুনের অবস্থান।

সেটাও জানতে পারবে, যদি কিশোর পাশা তাকে সঙ্গে নিতে রাজি হয়। জোর করে কিছু করা যাবে না। তাকে কি সহায়তা করবে ছেলেটা? না করার কোন কারণ নেই। শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত একজন মিশনারিকে সঙ্গে নিতে অরাজি হবে কেন?

Categories: