১১. একটা বোট জোগাড় করেছি

0 Comments

একটা বোট জোগাড় করেছি তোমাদের জন্যে।

পরদিন সকালে দেখা করতে এসে ছেলেদেরকে সুসংবাদটা জানাল কমাণ্ডার ম্যাকগয়ার। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে আরও দুজন তরুণ অফিসারকে। পরিচয় করিয়ে দিল, লেফটেন্যান্ট ওলসেন আর লেফটেন্যান্ট ফিশার।

বোটটা বেশি বড় না, কমাণ্ডার বলল। তিরিশ ফুট।

যথেষ্ট বড়, কিশোর বলল। চলবে। কি ইঞ্জিন?

ইঞ্জিন খুব ভাল। হ্যাকাটা মোটর, জাপানী। অনেক পুরানো জিনিস যদিও, তবে খুব নির্ভরশীল। জাপানীরা এনেছিল বোটটা, বোনিটো মাছ ধরার জন্যে। এখন আমেরিকান নেভির দখলে। অনেক বছর ধরে পড়ে আছে। খুব অল্প দামেই পেয়ে যাবে।

জায়গাটায়গা কেমন আছে?

চার বাংকের কেবিন আছে একটা। গ্যালি আছে। আর আছে প্রচুর বোটকা গন্ধ।

হাসল কিশোর। নেব ওটা।

ক্যাপ্টেন হয়ে কে যাচ্ছে? কলিগকে জিজ্ঞেস করল ম্যাকগয়ার। আপনিই নিশ্চয়?

।না, আমাকে এখানে থাকতে হবে। সামনে না থাকলে ঠিকমত ঠিক হবে না। শুকতারা। কিশোর ভাল নাবিক হয়ে গেছে, একাই যেতে পারবে।

নতুন দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল ম্যাকগয়ার। অভিযাত্রী…জীববিজ্ঞানী এখন নাবিক। এই বয়েসেই এত কিছু শিখে ফেলেছ…হবে, তোমার উন্নতি হবে জীবনে।

লাল হয়ে গেল কিশোর। খোলাখুলি প্রশংসায় খুশিও হয়, অস্বস্তিও বোধ করে। বলল, আপনার যা বয়েস, স্যার, কমাণ্ডার হয়ে বসে আছেন। নিশ্চয় আমার চেয়ে কম বয়েসেই সাগরে ভেসেছিলেন?

হাহ হাহ করে হাসল কমাণ্ডার। ধরেছ ঠিকই। বারো বছর বয়েসেই নৌকা নিয়ে পাড়ি দিয়েছি পাঁচশো মাইল, একা।

সেই তুলনায় আমি তো অনেক বড়। ক্যাপ্টেন কলিগ আমার ওস্তাদ, নেভিগেশন ভালই শিখিয়েছেন। সুযোগ যখন পাওয়া গেল, দেখি একবার বেরিয়ে, একা কতটা কি করতে পারি।

পারবে পারবে, সাহস দিল কমাণ্ডার। কাজটা মোটেই কঠিন না। কেবল সাহস দরকার। আর মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। থুতনি চুলকালো সে। পুলিশ তোমার একটা ক্ষতিই করে দিল। একজন মাল্লা কমিয়ে দিল।

কিশোর বুঝল, জামবুর কথা বলছে ম্যাকগয়ার। বলল, না, না, তাতে কিছু। এমনিতেও ওকে আমি নিতাম না। ওকে দিয়ে কোন কাজ হয় না।

আমিও আর নেব না, ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল কলিগ। কেন যে ব্যাটাকে নিয়েছিলাম, সেটাই বুঝতে পারছি না এখন। জোরাল সুপারিশ নিয়ে হাজির হল। পরে বুঝলাম ব্যাটা একটা আস্ত শয়তান। কাজকর্ম কিছু করতে চায় না, মহা ফাঁকিবাজ। আর খালি থাকে গোলমাল পাকানোর তালে।

তাই? ম্যাকগয়ার বলল, শোধরানোর ভাল জায়গায়ই গিয়েছে তাহলে। এখানে নেমেই শুরু করেছিল গোলমাল। নেটিভদের ডেকে মদ খাইয়েছে। মারামারি বাধিয়েছে। মদের ব্যাপারে এখানে খুব কড়াকড়ি আইন মিশনারি যখন আমাদেরকে ব্যাপারটা জানালেন…

রহস্যময় পাদ্রীর ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করল না কিশোর। মিস্টার ভিশনের কথা বলছেন? পাদ্রী বললেন, অল্পদিন হল এসেছেন পোনাপেতে। আপনারা কতখানি জানেন তাঁর সম্পর্কে?

খুব বেশি কিছু না। আমেরিকা থেকে প্লেনে করে এসেছে এই হপ্তাখানেক আগে। ক্যালিফোর্নিয়ার কি এক সংস্থার প্রতিনিধি দুক্ষিণ সাগরের অনেক অঞ্চলই খুব ভাল চেনেন। পোনাপের আশেপাশের দ্বীপগুলোতে যাওয়ার জন্যে এটা বোট খুঁজছেন। ভাড়া নেয়ার সামর্থ্য নেই, যাত্রী হিসেবে যেতে চান, আই মীন, ফ্রি রাইড। মানুষকে খুব ভালবাসেন। স্থানীয় অধিবাসীদের ভালর জন্যে জীবন দিতে রাজি।

একমত হল কলিগ। ঠিকই বলেছেন। কাল যা করেছেন, সেটাই তো এর প্রমাণ। নইলে কোন কানাকা কোথায় মদ খেয়ে মরছে, তার বলার কি দরকার?

ইচ্ছে করলে পোনাপেতেই থাকতে পারতেন, ওলসেন বলল। ভাল জায়গা। তবু থাকতে চাইছেন না। তিনি যেতে চান এমন সব দ্বীপে, যেখানে খুব কষ্টে আছে লোকে। তাদের ভাল করতে চান। না, এমন যার মন, তিনি খারাপ হতেই পারেন না। খুব ভাল মানুষ।

ওরকম লোক আমাদের এখানেও দরকার, ফিশার বলল।

ভাবল কিশোর, যদি বানিয়েই থাকেন, শুধু তাকেই বোকা বানাননি রেভারেন্ট হেনরি রাইডার ভিশন, বানিয়েছেন আরও তিনজন বুদ্ধিমান লোককে। মিশনারি হয় অসাধারণ ধূর্ত, তাদের চারজনের চেয়ে বুদ্ধিমান, নয়ত সত্যিই তিনি পাদ্রী–অভিনয় করেননি। লোকটাকে সন্দেহ করছে বলে খারাপই লাগছে তার।

ম্যাকগয়ার বলল, নেটিভদের ওলসেন আর ফিশারও খুব ভালবাসে। সাধারণ লোক নয় ওরা, সরাসরি নেভিতে চলে আসেনি। ওলসেন ছিল স্কুল টিচার, ফিশার ডাক্তার। ওরা এসেছেই এখানে নেটিভদের সাহায্য করতে। যাতে শিক্ষিত, স্বাস্থ্যবান হয়ে গড়ে ওঠে পোনাপিয়ানদের পরের জেনারেশনটা।

রাক্ষসের মত গিলছে ওরা, ওলসেন বলল। লেখাপড়ার কথা বলছি। শেখার জন্যে যেন হাঁ করে আছে।

রোগশোক কেমন এখানে? ফিশারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আছে মন্দ না। আগে অত ছিল না। বিদেশীরা, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গরা এনে ছড়িয়েছে।

হুঁ, বহুদেশে গিয়েই এই সর্বনাশ করেছে শ্বেতাঙ্গরা, কিশোর বলল।

মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার। হ্যাঁ, আমিও শ্বেতাঙ্গ, কিন্তু সত্যি কথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই। প্রায় দেড়শো বছর আগে এখানে যক্ষ্মার জীবাণু নিয়ে এসেছিল স্প্যানিশরা। আশি বছর আগে ইয়্যাপে কুষ্ঠ আমদানী করেছিল এক জার্মান রেডিও অপারেটর। পালাউতে আমাশার বীজ নিয়ে গিয়েছিল ইংরেজ বণিকেরা। আমেরিকানরা এনেছে হাম, বসন্ত আর আরও মারাত্মক কিছু রোগ। এসব রোগে ভোগেনি কখনও এখানকার অধিবাসীরা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই শরীরের। ফলে মশামাছির মত মরতে লাগল। দেখতে দেখতে ইয়্যাপের জনসংখ্যা তেরো থেকে চার হাজারে নেমে গেল। কুসাই দ্বীপে ছিল দুজাহার লোক। এল আমেরিকান তিমি শিকারিরা, দিল রোগ ছড়িয়ে। লোকসংখ্যা দুহাজার থেকে নামিয়ে দিল দুশোতে। ম্যারিনা দ্বীপপুঞ্জে ছিল এক লাখ, হয়ে গেল তিন হাজার।

এখনও মরছে?

না। উপকারটা জাপানীরাই করেছে, মৃত্যু রোধ করেছে। ওদেরকে ধন্যবাদ জানাতে কার্পণ্য করব না আমি। ভাল ভাল ডাক্তার নিয়ে এসে হাসপাতাল গড়েছিল। তবে এখন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেক ভাল, অনেক উন্নতি করেছি আমরা। প্রতিটি দ্বীপেই এখন আস্তে আস্তে লোকসংখ্যা বাড়ছে।

দ্বীপের মানুষগুলোর জন্যে দুঃখ হল কিশোরের। ওদের জন্যে কিছু করতে ইচ্ছে হল। কিন্তু কি করতে পারবে সে? কি ক্ষমতা আছে? আছে, অতি সামান্য হলেও আছে, পরোক্ষভাবে। মিশনারি ভদ্রলোককে তার বোটে যাত্রী হিসেরে নিতে পারে, নামিয়ে দিতে পারে তিনি যে দ্বীপে নামতে চান। মনস্থির করে ফেলল গোয়েন্দাপ্রধান, সঙ্গে নেবে পাদ্রী সাহেবকে।

Categories: