১২. অনেক পেছনে পড়ে থাকল পোনাপে

0 Comments

অনেক পেছনে পড়ে থাকল পোনাপে। মেঘে ঘেরা উঁচু টটলম চুড়াটাও চোখে পড়ছে না আর এখন।

যেদিকেই তাকানো যায়, আকাশ নীল। সাগর শান্ত। ভাল এগোচ্ছে মোটরবোট। আশেপাশে খেলে বেড়াচ্ছে ডলফিন। উড়ুক্কু মাছের ছড়ানো ডানায় রোদের চমক।

এই বোটটার নাম রেখেছে কিশোর মেঘনা। আগে জাপানী নাম ছিল কিকু, জাপানী এই শব্দটার মানে ক্রিসেনথিমাম। কেনার পর নামটা বদলে ফেলেছে সে।

জন্মের সময় নিশ্চয় ফুলের মতই সুন্দর ছিল বোটটা, এখনও তার কিছুটা অবশিষ্ট রয়েছে। তবে নতুনের সেই সুগন্ধ আর নেই। এখন আছে বোঁটকা গন্ধ, সামুদ্রিক মাছের তীব্র আঁশটে গন্ধ যা কখনও কোন কিছুতেই দূর হবার নয়। এর ডেক আর কিনারে অসংখ্য বোনিটোর কাটার দাগ। আর রয়েছে তলোয়ার মাছের তলোয়ার, ব্যারাকুড়ার দাঁত আর হাঙরের সিরিশ কাগজের মত খসখসে চামড়ার স্বাক্ষর।

বোটের সবাই সুখী। গ্যালিতে দাঁড়িয়ে পলিনেশিয়ান গানের সুর গুন গুন করছে কুমালো। গলুইয়ের কাছে খালি হাতে উড়ুক্কু মাছ ধরার চেষ্টা করছে মুসা। রেলিঙের কাছে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে সাগর দেখছে রনি- নই ধরেছে কিশোর। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের কড়া রোদ অনেকখানি মোলায়েম হয়েছে। সাগরের শীতল বাতাসের পরশে।

বোটে সব চেয়ে সুখী ব্যক্তি এখন রেবারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশন। কোন কারণ ছাড়াই একটু পর পর হেসে উঠছেন দরাজ গলায়।

ভালই আছেন, স্যার, আপনি, কিশোর বলল। চিন্তা নাই ভাবনা নাই…

কি সাংঘাতিক এক রসিকতা যেন করে ফেলেছে কিশোর। হাসতে আরম্ভ করল মিশনারি। হাসতে হাসতে পানি চলে এল চোখে। হাসব না…হাসব না বলছ…কল্পনা করতে পার? যেখানে যেতে চাই ঠিক সেখানে নিয়ে চলেছ… থেমে গেল সময়মত। তোমার জন্যেই পারলাম…

না না, এ-আর এমন কি? বাধা দিয়ে বলল কিশোর।

এমন কি মানে! তুমি বুঝতে পারছ না ইয়াং ম্যান, আমার জন্যে এটা কতখানি। কোন ধারণাই নেই তোমার, হাহ, হাহ। অবশেষে যাচ্ছি সেখানে, বাদামি ভেড়াদের এলাকায়…খুশি হব না? এর চেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার আছে ঈশ্বরের কাছে?

লোকটার কথাবার্তা অদ্ভুত লাগল কিশোরের। কোথায় যেন একটা অমিল রয়ে গেছে! পাদ্রীর হাসিটাও যেন কেমন! ভাল লাগে না।

না লাগুক। ভাবনাটা দূর করে দিতে চাইল কিশোর। সবার হাসিই যে সবার ভাল লাগতে হবে এমন কোন কথা নেই।

পাদ্রী সাহেব কি করে-হাসেন, কথা বলেন, সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই তার। ওর কাজ, তাঁকে এমন কোন দ্বীপে নামিয়ে দেয়া, যেখানে তিনি দ্বীপবাসীদের সাহায্য করতে পারবেন। চার্টে দেখা যাচ্ছে ওরকম দুটো দ্বীপ, পার্ল ল্যাগুনে যাবার পথেই পড়ে।

দুপুর। চারপাশে ফথাও ডাঙার চিহ্ন চোখে পড়ছে না। পাল নেই, জাহাজ নেই, এমনকি স্টীমারের ধোঁয়াও নেই কোনখানে। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। সূর্য ঠিক মাথার ওপরে। কোন দিক থেকে এসেছে ওরা, কোন দিকে চলেছে, কিছুই বোেঝার উপায় নেই এখন কম্পাস ছাড়া।

ভোমার হিসেবে ভূল না হলেই বাঁচি, কিশোরকে বলল মুসা। একটু এদিক

ওদিক হলেই এখন সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।

সেটা কিশোরও বুঝতে পারছে। সেক্সট্যান্ট আর ক্রোনোমিটার বের করল। লগবুকের রীডিং দেখল, উত্তর-পশ্চিমে চলেছে। এখন যেভাবে চলেছে, সেরকম চলতে পারলে সহজেই পার্ল ল্যাগুনে পৌঁছানো যাবে।

কিন্তু কিশোর জানে, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। পথভ্রষ্ট করে দিতে পারে বাতাস। তাছাড়া উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের কাছাকাছি হচ্ছে এখন ওরা। আগে থেকে বোঝার উপায় নেই ওই স্রোতের শক্তি কতখানি। কোন দিকে যে বইছে, সেটাও

সঠিক বলা যায় না। মোটামুটি জানা আছে, ঝোঁকটা পশ্চিমমুখী।

বিশাল এই জলরাশির মাঝে খুদে একটা দ্বীপ খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার চেয়েও কঠিন মনে হচ্ছে এখন কিশোরের কাছে। মহাসাগর আর আকাশের অসীমতার মাঝে নিজেদেরকে বড় ক্ষুদ্র আর নগণ্য লাগছে। চার্ট বলছে, পানির গভীরতা ওখানে তিন মাইল। সাগরের তলায় ওখানে রয়েছে অসংখ্য ডুবো-পাহাড় আর উপত্যকা।

লগবুক দেখে বারবার হিসেব মিলাল কিশোর। দেখল, কোথাও ভুল হল কিনা।

রাতের বেলা সেদিন ভালই থাকল আবহাওয়া। আকাশ পরিষ্কার। তারা দেখা যায়, কাজেই যাত্রাপথ ঠিক করতে অসুবিধে হল না। কিশোর, মুসা আর কুমালো পালা করে হুইল ধরছে। রবিন বোট চালাতে জানে না, কাজেই তার হাতে হুইল ছাড়তে ভরসা পেল না কেউ। অনেকক্ষণ ডেকে বসে থেকে, গল্প করে মাঝরাতের দিকে ঘুমাতে গেল সে। মিশনারি বলল, নৌ-বিদ্যার কিছুই জানে না। বসে থেকে আর কি করবে? সারাটা রাত কেবিনের বাংকে কাটাল সে।

পরদিন সূর্য ওঠার পর কিছুটা অশান্ত হল সাগর। বোটও স্থির থাকতে পারল স্বাভাবিকভাবেই, দুলছে, গড়াচ্ছে। নাস্তা তেরি করে আনল কুমালো। ডেকে খেতে বসল সবাই। মিস্টার ভিশন জানাল, শরীর খারাপ লাগছে তার, সীসিকনেস। কাজেই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে আবার গিয়ে ঢুকল কেবিনে।

কিছুক্ষণ পর লগবুকটা নিতে কেবিনে এল কিশোর। দেখে, বইটা খুলে তার ওপর ঝুঁকে রয়েছে মিশনারি। রীডিং টুকে নিচ্ছে একটা কাগজে।

এদিকে পেছন করে আছে লোকটা। পিঠটা বেঁকে রয়েছে, যেন একটা পিপা। হঠাৎ টের পেল, ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ। তাড়াতাড়ি পিঠটাকে আরও কুঁজো করে আড়াল করতে চাইল তার কাজ, কাগজের টুকরোটা রেখে দিল পকেটে।

ফিরে চেয়ে হাসল লোকুটা। লগবুকটা দেখছিলাম। ভারি ইনটারেসটিং। না বলেই হাত দিলাম, কিছু মনে করেছ?

না না, মনে করার কি আছে, বলল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে বাঁকা পিঠটার দিকে। কি যেন লুকিয়ে রেখেছে ওই কুঁজ! কোথায় দেখেছে ওই পিঠ?

মনে পড়ল। ঠিক এই রকম একটা পিঠ দেখেছে, প্রফেসরের বাড়ি থেকে সেদিন বেরিয়ে আসার সময়। কালো গাড়িতে চড়েছিল যে লোকটা। তারপর ট্রাকের পিছে পিছে আসতে দেখেছে, লোকটাকে স্পষ্ট দেখেনি, তবে গাড়িটা দেখেছে।

এরকম কুঁজ আরও মানুষের থাকতে পারে। শুধু এই একটা কারণ নিয়ে সন্দেহ করার কিছু নেই, করতও না কিশোর, কাকতলীয় বলেই ধরে নিত। কিন্তু চুরি করে লগবুকের রীডিং দেখা, নকল করা, কাগজের টুকরো লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা, সন্দেহ বাড়িয়ে দিল তার। প্রফেসরের ভয় ছিল তাঁর ঘরে বাগ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের কথা কেউ আড়িপেতে শুনে ফেলছে। আশঙ্কা অমূলক ছিল না তার। সত্যি শুনেছে। সব শুনেছে, শুধু জানতে পারেনি মুক্তাদ্বীপের অবস্থান। তার পর সেই লোক, কিংবা তার কোন সহকারী মিশনারির ছদ্মবেশে উড়ে এসেছে পোনাপেতে। চালাকি করে উঠে পড়েছে বোটে, তাদের সঙ্গে চলেছে এখন। লগ দেখে জেনে নেবে, দ্বীপটা কোথায়। তারপর যখন খুশি চলে আসতে পারবে এখানে।

ডেকে ফিরে এল কিশোর। মুসাকে সরিয়ে দিয়ে হুইল ধরল। এত সহজে মিশনারির ফাঁদে পড়ল বলে লাথি মারতে ইচ্ছে করছে নিজেকে। মিশনারি! নেটিভদের সাহায্য করতে যাচ্ছে! শয়তান কোথাকার! ভুল যা করার তো করে ফেলেছে, এখন এটাকে শোধরানোর চেষ্টা করতে হবে।

বুঝতে পারছে, পাকা অপরাধীর কবলে পড়েছে। বলা যায় না, স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে খুন করতেও হয়ত দ্বিধা করবে না লোকটা। এসেছে যখন, মুক্তাদ্বীপের

অবস্থান জানার চেষ্টা করবেই, যেভাবেই হোক।

কি হয়েছে, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করল। ঘামছ কেন? গরম তো তেমন নেই।

ঠাণ্ডা রয়েছে রবিন আর মুসা, ঠাণ্ডাই থাক, ভাবল কিশোর। এখন সব বলে ওদেরকেও দুশ্চিন্তায় ফেলে লাভ নেই। এমনও হতে পারে; মিশনারি সত্যি মিশনারি। কৌতূহলের বশেই দেখেছে লগবুকটা।

যদিও সেটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে জানাজানি হয়ে গেলে আরও খারাপ হবে। লোকটা যদি বুঝে ফেলে তাকে সন্দেহ করা হয়েছে, তাহলে আরও সতর্ক হয়ে যাবে। হয়ত নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চূড়ান্ত কিছু করে বসবে। তাতে ক্ষতি ছাড়া ভাল হবে না। তার চেয়ে বরং ওকে ভাবতে দেয়া উচিত, তার কাজ পরিকল্পনা মাফিকই এগোচ্ছে। কুমালো, মুসা আর রবিনকে জানালে ওরা কিশোরের মত শান্ত থাকতে পারবে না। এমন কিছু করে বসবে, যাতে মিশনারি টের পেয়ে যাবে, তার ছদ্মবেশ ফাঁস হয়ে গেছে।

আমাকেই ওর ওপর চোখ রাখতে হবে, ভাবল কিশোর। কিছুতেই ভাবতে দেয়া চলবে না যে আমি ওকে সন্দেহ করেছি। আর ওকে ফাঁকি দেয়ার একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

ঘন্টার পর ঘন্টা সমস্যাটা নিয়ে ভাবল আর ঘামল কিশোর। তারপর, পরের নতুন রীডিংটা ঠিক করার আগেই চট করে সমাধানটা এসে গেল মাথায়।

বোটের পজিশন ঠিক করল একরকম, লগে লিখল আরেক রকম। দশ মিনিট করে বাদ দিয়ে দিল।

পরের বার রীডিং ঠিক করার সময় বাদ দিল বিশ মিনিট, তার পরের বার তিদিশ মিনিট, এবং তার পরের বার চল্লিশ মিনিট। এভাবেই বাদ দিতে থাকল, যতবার পজিশন ঠিক করল নতুন করে। লগবুকে বাড়তেই থাকল ভুলের মাত্রা। কিন্তু কিশোরের জানা আছে, কতটা বাদ দিয়েছে, কাজেই সঠিক পথ নির্ণয় করতে তার কোন অসুবিধে হল না।

কেবিনেই ফেলে রাখল লগবুক। দেখে দেখে রীডিং নকল করার প্রচুর সুযোগ এবং সময় দিল ভিশনকে।

এক মিনিট ল্যাটিচিউড সমান এক সামুদ্রিক মাইল ধরা হয়। দশ মিনিট মানে দশ মাইল। কিশোর যতটা সরিয়েছে, তাতে করে আবার এসে ওই রীডিং দিয়ে দ্বীপটা কিছুতেই খুঁজে পাবে না মিশনারি।

লোকটা যদি মুক্তাচোরই হয়ে থাকে, কোন সন্দেহ নেই, ফিরে গিয়ে মুক্তা তোলার জন্যে বড়সড় জাহাজ আর ডুবুরি নিয়ে ফিরে আসবে। তখন যেন কিছুতেই দ্বীপটা খুঁজে না পায়, সেই ব্যবস্থাই করেছে কিশোর। আসল রীডিং দিয়েই দ্বীপটা খুঁজে পাওয়া কঠিন, আর এত বড় ভুল দিয়ে তো অসম্ভব।

পরদিন দিগন্তে কয়েকটা নারকেল গাছের মাথা চোখে পড়ল। ধীরে ধীরে ফুটে উঠল একটা দ্বীপের অবয়ব। কিশোর জানে, ওটা মুক্তাদ্বীপ নয়। কাজেই শান্ত রইল সে। কিন্তু বড় বড় হয়ে উঠল নকল মিশনারির চোখ।

এখানেই নামবে? জিজ্ঞেস করল মিশনারি।

না, কিশোর বলল। আপনি নামবেন নিশ্চয়? অনেক নৌকা দেখছি। নিশ্চয় অনেক মানুষ আছে এখানে, ঈশ্বরের বাণী শোনাতে পারবেন।

কিন্তু আগ্রহী হল না মিশনারি। বলল, না, আরও সামনে যেতে চাই। পোনাপে থেকে এ-জায়গা বেশি দূরে নয়, হয়ত ওখানকার মিশনারিরাই চলে আসে এখানে। আমি যেতে চাই এমন জায়গায়, সভ্য মানুষের নামও শোনেনি যারা।

বিকেলে আরেকটা দ্বীপ দেখা গেল। মিশনারি যখন শুনল, কিশোররা এখানেও থামবে না, নামতে রাজি হল না সে। আরও সামনে যেতে চায়।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল কিশোর, পোনাপে থেকে যতই দূরে সরে আসছে, চার্ট ততই গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই মিলছে না। কোন কোন দ্বীপের চিহ্নের পাশে লেখা রয়েছে পি. ডি. অর্থাৎ, পজিশন ডাউটফুল (অবস্থান সন্দেহজনক)। খুদে খুদে অনেক দ্বীপ দেখা গেল, যেগুলো দেখানই হয়নি চার্টে। কিংবা চার্টে আছে, এমন অনেক দ্বীপ খুঁজে পাওয়া গেল না। বোঝা গেল, অনেকটা আন্দাজের ওপরই তৈরি হয়েছে চার্টটা। যে করেছে তার কাছেও প্রশান্ত মহাসাগরের এই অচেনা অঞ্চল অচেনাই থেকে গেছে। এ-যেন এক হারানো পৃথিবী।

নানারকম সমস্যায় না ভুগলে এখানে কিছুদিনের জন্যে হারিয়ে যেতে আপত্তি ছিল না কিশোরের। তার মাথা জুড়ে রয়েছে এখন জটিল সব অঙ্ক। মিশনারির ভয়ে কাগজ-কলমের সাহায্য নিতে পারছে না। একটু ভুলচুক হয়ে গেলে কি সর্বনাশ হয়ে যাবে আন্দাজ করতে পারছে। কঠিন হিসেব আর জ্যামিতির বোঝায় এখন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে তার মগজ। এইভাবে মনে মনে হিসেব করে কতটা কি করতে পারবে? ভুল ইতিমধ্যেই হয়ে যায়নি তো? পারবে ঠিক জায়গায় পৌঁছাতে? তার মনে হল, পারলে, সেটা অলৌকিক ব্যাপার হয়ে যাবে।

সারাক্ষণ মনে বাজছে একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট পুব, এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট উত্তর। তার ভয় হচ্ছে, ঘুমের ঘোরে না জোরে জোরে বলে ফেলে। মাত্র চারফুট দূরে বাংকে ঘুমায় ভিশন। তার কানে কথাগুলো চলে যাবেই। তাহলেই সব শেষ, এত কষ্টের কোন মানে থাকবে না আর।

উজ্জ্বল তারার আলোয় আরেকটা রাত বোট চালানো হল। পরদিন সকালে সূর্য উঠল। হুইল ধরে আছে মুসা। গলুইয়ের কাছ থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, রবিন, ডাঙাআ, ডাঙা দেখা যাচ্ছে!

হয়েছে,কেবিনে থেকে ভাবল কিশোর। দেখে ফেলেছে! তাড়াতাড়ি বাংক থেকে নেমে ডেকে বেরিয়ে এল সে। তার পিছে পিছেই বেরোল মিশনারি।

সামনে, সাগরের মাঝে যেন শুয়ে রয়েছে প্রবাল প্রাচীরের একটা আঙটি। একটা সবুজ ল্যাগুনকে ঘিরে রেখেছে। দুটো জায়গায় চওড়া হয়ে গিয়ে বীপ সৃষ্টি করেছে প্রাচীরটা, তবে ওগুলোতে উদ্ভিদ প্রায় নেই। ছিল, এখন নেই। এরকম দৃশ্য আসার সময় আরও কয়েকটা দ্বীপে দেখে এসেছে ওরা। এর জন্যে দায়ী হারিক্যান। নষ্ট করে দিয়েছে সব। আর এই দ্বীপ দুটোকে যেন একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে নারকেল গাছের মাথা, গোড়া থেকে আটদশ ফুট উঁচু কাণ্ডগুলো শুধু রেখে গেছে।

উত্তেজনায় কাঁপছে কিশোরের বুক। ঠিক জায়গাতেই এসেছে? ভুল করেনি তো? যন্ত্রপাতি নিয়ে বসল। ভালমত দেখেটেখে হিসেব বের করল। না, ঠিকই তো আছে। মগজে যা লেখা হয়ে আছে সেই একই রীডিং, একশো আটান্ন ডিগ্রি  বারো মিনিট পুব, এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট উত্তর।

তাহলে এটাই সেই পার্ল ল্যাগুন! মুক্তাদ্বীপ!

নব্বই মিনিট করে বাদ দিয়ে লগবুকে রীডিং লিখল সে: পার্ল ল্যান পাওয়া গেল। একশো ছাপ্পান্ন ডিগ্রি বেয়াল্লিশ মিনিট পুব, দশ ডিগ্রি চার মিনিট উত্তর।

যাও ব্যাটা, এবার লিখে নাও গিয়ে কাগজে, মনে মনে হাসল কিশোর। আবার যদি আস, দেখবে দ্বীপটা নেই। কিংবা যদি কোনটা থাকেও সেটা এই দ্বীপ নয়। পশ্চিমে সরবে নব্বই মাইল, দক্ষিণেও সরবে নব্বই মাইল। তুমি তো তুমি, ব্যাটা, দুনিয়ার অভিজ্ঞতম নাবিকও এই রীডিং দিয়ে পার্ল ল্যাণ্ডন খুঁজে বের করতে পারবে না।

ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল কিশোর, ভিশন যে নাবিক নয় এই জন্যে। ডেকের ওপরে চলাফেরার ভঙ্গিই বুঝিয়ে দেয় লোকটা জাহাজী নয়। সাগরে বড় ঢেউ উঠলে, জাহাজ বেশি দুললে ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যায় তার। ইঞ্জিন চালাতে আর হুইল ধরতে পারে বটে, কয়েকবার দেখলে আনাড়ি লোকও সেটা পারবে। এমন কোন কঠিন ব্যাপার নয়। সেক্সট্যান্ট বোজার চেষ্টা করেছিল একবার, উল্টো করে ধরেছিল যন্ত্রটাকে, দেখেছে কিশোর। নটিক্যাল অ্যালমানাকে হাত দেয়নি একবারও। পুরোপুরি নির্ভর করে বসে আছে কিশোরের করা হিসেবের ওপর।

যাও, ভালমত দেখে নাও পার্ল ল্যাগুন, মনে মনে ভিশনকে বলল কিশোর। জীবনে আর দেখার সুযোগ তো পাবে না।

ল্যাগুনটাকে চক্কর দাও, হুইল ধরে থাকা মুসাকে বলল কিশোর। দেয়ালের বেশি কাছে যেয়ো না।

মাইলখানেকের বেশি হবে অ্যাটটার বেড়। পশ্চিম দিক দিয়ে ল্যাগুনে ঢোকার বেশ সুন্দর একটা পথ আছে। পুরো এক চক্কর ঘুরে এসে ওখান দিয়ে ঢুকতে শুরু করল মুসা। বেশ কায়দা করে ঢেউয়ের মাথায় চড়ে চড়ে বোটটাকে ঢুকিয়ে ফেলল ভেতরে। ওখানটায় পানি খুব কম। ছয় থেকে বারো ফুটের মধ্যে। পরিষ্কার সবুজ পানির ভেতর দিয়ে তলা দেখা যাচ্ছে। প্রবালের স্বর্গ যেন জায়গাটা। রামধনুর সাত রঙ নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের নানা আকারের প্রবাল-দুর্গ।

পানির নিচে পরীর রাজ্য, প্রাচীরের ওপরে হারিক্যানের ধ্বংসলীলা, একটার সঙ্গে আরেকটার কোন মিল নেই। বড় বেশি চোখে বাজে। খুদে দ্বীপ দুটোর দিকে তাকালেই একটা ধাক্কা খেতে হয়।

খাইছে! এখানে আটকা পড়তে চাই না আমি কিছুতেই! গায়ে কাঁটা দিল মুসার। তুফানে করেছে কি দৈখ! আমার তো মনে হয় ইঁদুরও বাঁচেনি। পার্ল ল্যাগুন, না? মুক্তাদ্বীপ? তার চেয়ে বল মৃত্যু দ্বীপ কিংবা ক্ষুধার দ্বীপ।

কিশোরের নির্দেশে নোঙর ফেল কুমালো। ভালমত দেখে জায়গা নির্বাচন করেছে গোয়েন্দাপ্রধান। উঁচু হয়ে এখানে উঠে গেছে প্রাচীরের কাঁধ, ফলে ল্যাগুনের উত্তর অংশটা চোখে পড়ে না। ভেসে ভেসে দেয়ালের কয়েক ফুটের মধ্যে চলে এল বোট, তারপর শেকলে টান লেগে আটকে গেল, আর সরতে পারবে না, ঘষাও লাগবে না ধারাল প্রবালের গায়ে।

তীরে নামব আমরা, ভিশনকে বলল কিশোর। আপনি নিশ্চয় নামবেন না। মানুষ নেই। ঈশ্বরের বাণী কাকে শোনাবেন? বোটেই থাকুন। নাকি মাছকে শোনানোর ইচ্ছে আছে?

কিশোরের রসিকতায় হাসল মিশনারি। বলল, না না, আমি থাকি। তোমর যাও। এখানে নেমে কোন লাভ নেই এখন আমার।

তার শেষ কথাটা রহস্যময়। কিশোর বুঝলেও, অন্য তিনজন এর মানে বুঝল না।

বোট থেকে আগে নামল কুমালো। ওখানে পানি এক ফুটেরও কম। ছপা ছপাৎ করে পানি ভেঙে শুকনোয় উঠল ওরা। এগিয়ে চলল উত্তরে। খুব তাড়াতাড়িই বোটটাকে ওদের দৃষ্টির আড়াল করে দিল দেয়াল।

পশ্চিমের দেয়াল ধরে ধরে চলে এল ওরা একটা চওড়া জায়গায়, যেখানে সৃষ্টি হয়েছে দুটো দ্বীপের একটা, ল্যাগুনের উত্তর-পশ্চিম কোণ এটা। তারপর বোতলের গলার মত সরু হয়ে গেছে দেয়ালটা, গিয়ে মিশেছে আরেকটা দ্বীপের সঙ্গে। ওটা উত্তর-পূর্ব কোণে।

ওখানেই কোথাও আছে, কিশোর বলল। প্রফেসর বলেছিলেন দ্বীপের উত্তরপূর্ব কোণে।

দ্বিতীয় দ্বীপটা চওড়ায় কয়েকশো গজ। ঝোপঝাড় ছিল, একসময়, ছিঁড়ে, উপড়ে নিয়ে গেছে ঝড়। পুরো দ্বীপটাই বোধহয় পানির নিচে চলে গিয়েছিল। নারকেলের কাণ্ডগুলো দেখে মনে হয় কবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভ। উপড়ানো কিছু কাণ্ড পড়ে আছে এখনও, তবে বেশিরভাগই ভেসে গেছে।

হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে। দেয়ালের ওপর জমে রয়েছে প্রবালের স্তূপ, কোন কোনটা দশ ফুট উঁচু। হোঁচট খেয়ে পড়লে চিরে ফালাফালা হয়ে যাবে হাঁটু আর হাতের চামড়া, এত ধার ওসব প্রবাল।

দ্বীপের পাশে ল্যাগুনে গভীর একটা খাঁড়ি রয়েছে, তিনদিক থেকে এমনভাবে ঘেরা মনে হয় একটা খুদে উপসাগর। তলা অস্পষ্ট, কারণ পানি ওখানে দশ ফ্যাদমের বেশি। চওড়ায় প্রায় একশো গজ। দেখলেই মনে হয় কি যেন এক রহস্য লুকিয়ে রেখেছে গভীর এই খড়িটা।

ভাগ্যিস কুমালোকে সঙ্গে এনেছিলাম, মুসা বলল। এত নিচে নামতে পারব আমি। কিশোর, তুমি?

কি যে বল না ছাই। তুমি না পারলে আমি পারব?

নামার জন্যে কাপড় খুলতে গেল কুমালো, তাকে থামাল কিশোর, রাখ, কথা আছে। এই, বস এখানে সবাই।

মিশনারিকে সন্দেহ করছে, একথা সঙ্গীদেরকে জানাল কিশোর।

সন্দেহ আমারও হয়েছে,কুমালো বলল। অনেক মিশনারি দেখেছি আমি। কারও স্বভাবই ওর মত ছিল না। লোকটাকে একটুও পছন্দ হয় না আমার।

আমারও না, রবিন বলল। চল, গিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করি। ৫ লিখুলি জিজ্ঞেস করি, আসলে সে কে?

না, উচিত হবে না, কিশোর বলল। পিস্তল-টিস্তল থাকতে। পরে। থাকুক। আমাদেরকে খুন করার সাহস নিশ্চয় হবে না।

কিছুই বলা যায় না। হয়ত অনেক টাকার মুক্তো রয়েছে এই উপ…হ্যাঁ, উপসাগরই বলি, খাড়ি শুনতে ভাল্লাগে না। লক্ষ, হয়ত কোটি টাকারও হতে পারে। এত টাকার জিনিস পাওয়ার জন্যে খুন করতে দ্বিধা করবে না অনেকেই। আর মনে রেখ, এটা রকি বীচ নয়, পথের মোড়ে মোড়ে পুলিশ নেই। বেআইনী কাজ চলছে কিনা দেখতে আসছে না কেউ। এখানে অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়া সহজ। কাজেই, লোকটাকে খেপানো উচিত হবে না। এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাল কিশোর। যেমন ভাবে চলছি আমরা, তেমনি চলব। বুঝতে দেব না যে ওকে সন্দেহ করেছি। এমন কোন আচরণ করবে না, যাতে ব্যাপারটা তার কাছে ফাঁস হয়ে যায়। ঠিক আছে?

মাথা ঝাঁকাল তিনজনেই।

গুড। কুমালো, এবার নামতে পার। দেখা যাক, কি আছে উপসাগরের তলায়।

(দ্বিতীয় খণ্ডে সমাপ্য)

Categories: