এলিভেটরের দিকে ছুটে গেল কিশোর। পেছনে রবিন আর মুসা। ওরা এসে পৌঁছতে পৌঁছতে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। মাঝপথে আটকে গেল মিরিনার চিৎকার।
হাতে কমিকগুলো ধরাই রয়েছে। পাই করে ঘুরল কিশোর। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। দুই সহকারীকে বলল, এসো!
ঘোরানো লোহার সিঁড়িটার দিকে দৌড় দিল সে। আগের রাতে এটা দিয়েই পালিয়েছিল ওদের ঘরের চোর। এক টানে দরজা খুলেই ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। একেক লাফে দুতিনটে করে ধাপ পেরিয়ে নামতে লাগল।
তার সাথে পাল্লা দিতে মুসার অসুবিধে হল না, তবে রবিন পেরে উঠল না। পিছিয়ে পড়তে লাগল।
পা ব্যথা শুরু হয়েছে কিশোরের। মাংসপেশীতে খিচ ধরছে এভাবে নামতে গিয়ে। কেয়ার করছে না। তার এক চিন্তা, মিরিনাকে ধরতে পারবে তো? নামতে পারবে এলিভেটরের আগে?
অসম্ভবই মনে হলো। তবু হাল ছাড়ল না। গতি কমাল না। নেমে চলল একই ভাবে।
লবিতে পৌঁছেও থামল না কিশোর। টিভির সাংবাদিক সহ অনেকেই রয়েছে এখানে। এতগুলো মানুষের সামনে কিছুতেই বেরোবে না লোকটা মিরিনাকে নিয়ে। অন্য কোন তলায় নামারও সাহস করবে না। এলিভেটরের জন্যে অপেক্ষা করতে পারে যে কেউ দেখে ফেলার ভয় আছে।
লোকটার জন্যে একমাত্র নিরাপদ জায়গা হলো গ্যারেজে নামা।
সিঁড়ির শেষ কয়েকটা ধাপ যেন উড়ে নেমে এল কিশোর। আগের রাতের মতই গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্যানিক বারের ওপর। লোকটা বেরিয়ে গিয়ে মিরিনাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পরার আগেই ধরতে না পারলে…
এলিভেটর ব্যাংকের দিকে দৌড় দিল সে। ধস্তাধস্তি আর চিৎকারের চাপা শব্দ যেন মধুবর্ষণ করল তার কানে। এর অর্থ এখনও এলিভেটরের ভেতরেই রয়েছে মিরিনা। মুক্তির চেষ্টা করছে।
তুমি থামবে! ধমক শোনা গেল। গায়ে হাত তুলতে চাই না আমি। আমার জিনিসগুলো কোথায় লুকিয়েছ বলে দাও, ছেড়ে দেব।
পরিচিত কণ্ঠস্বর। দরজা খুলে বেরিয়ে এলে কিশোর দেখল, তার অনুমান ঠিক। মিরিনাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন ম্যাড ডিকসন।
কমিক হাতে কিশোরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে গেলেন তিনি। আপনাআপনি ঢিল হয়ে গেল মিরিনার গলা পেঁচিয়ে ধরা হাতের বাঁধন।
এটাই চেয়েছিল কিশোর। টেনে সরিয়ে আনল মিরিনাকে। এক ধাক্কায় ডিকসনকে ফেলে দিল কংক্রিটের দেয়ালের ওপর। দেয়ালে দুপ করে বাড়ি খেলো কমিক বিক্রেতার শরীর। ক্ষণিকের জন্যে অসাড় হয়ে গেল যেন।
টলমল করছে মিরিনার পা। শরীরের ভার রাখতে পারছে না যেন। একবার দুলে উঠেই পড়তে শুরু করল কাটা কলাগাছের মত।
কমিকগুলো হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে তাকে ধরতে গেল কিশোর। এই সময় ঝাঁপিয়ে এসে পড়লেন ডিকসন। জুডোর প্যাচ কষার সময় নেই। সরাসরি ঘুসি মারল তাঁর চোয়ালে কিশোর। আবার গিয়ে দেয়ালে ধাক্কা খেলেন কমিক বিক্রেতা।
রবিন আর মুসা পৌঁছে গেছে। মিরিনাকে ধরল রবিন। মুসা এগোল কিশোরকে সাহায্য করতে। এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল ডিকসনকে।
পাশে চলে এল কিশোর। কমিক বিক্রেতার প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, মেয়েমানুষের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করার চেয়ে পুরুষমানুষের সঙ্গে করা অনেক কঠিন, তাই না?
মিরিনাকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করল রবিন। ডিকসনকে ধরে রেখেছে মুসা। মিরিনার কাছে এসে কিশোর সান্তনা দিয়ে বলল, আর ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। ও আর কিছু করতে পারবে না তোমার।
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল মিরিনা। তারপর হঠাৎই যেন কথাটা মনে পড়তে চিৎকার করে বলল, হায় হায়, ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে! আম্মা আমাকে মেরে ফেলবে…
বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন ওর শরীরে। রবিনের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঝট করে বসে পড়ে কমিকগুলো কুড়াতে লাগল। তুলতে তুলতেই কিশোরের দিকে তাকাল একবার। অনেক ধন্যবাদ তোমাদের।…বলো তো, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে? ক্যামেরার সামনে যেতে পারব?
ঠিকই আছে সব, রবিন বলল। পারবে।
যা ঘটল সেটা সবার সামনে আম্মাকে বলা যাবে না। যাই। তোমাদের সঙ্গে পরে দেখা করব।
কমিকের বই হাতে এলিভেটরের দিকে এগোল মিরিনা।
ডিকসনের দিকে নজর দিল আবার কিশোর। অনেক কথা বের করতে হবে পেট থেকে।
এভাবে আমাদের দেখে নিশ্চয় চমকে গেছেন, হেসে বলল রবিন।
চমকাব কেন? আরেক দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ডিকসন। চুলগুলো আগের চেয়ে এলোমেলো, সত্যি সত্যিই এখন পাগল মনে হচ্ছে তাঁকে। মাথা নাড়তে লাগলেন। ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু মুসা কি আর ছাড়ে।
ও, চমকাননি, ব্যাঙ্গ করে বলল কিশোর। তা চমকাবেন কেন? কাল রাতে তো আর আপনি আমাদের ঘরে ঢোকেননি। আমরা যখন পিছু নিয়ে এখানে, নামলাম, তখন আমাদেরকে মারেনওনি।
কি বলছ বুঝতে পারছি না।
তা তো পারবেনই না, মুসা বলল। পেরেছেন কেবল ভ্যানে করে পালাতে। হেডলাইট ভাঙা সবুজ গাড়িটাতে চড়ে। চমৎকার একটা নাম দিয়েছি আমরা ওটার, জানেন। সাইক্লপস।
আমি..মানে…আমি…
মানে মানে না করে ঝেড়ে ফেলুন না, কিশোর বলল। নাকি,আমরাই বলে দেব কি কি অকাজ করেছেন। চুরি, খুনের চেষ্টা, অপহরণের চেষ্টা…
অভিযোগগুলো সব সত্যি নয়! গলা কাঁপছে ডিকসনের। শুনলাম, স্টারগার্লের পোশক পরা মেয়েটা কমিকগুলো খুঁজে পেয়েছে। ভাবলাম, সবই বুঝি পেয়েছে। তারপর শুনলাম, না, শুধু তোমাদেরগুলো পেয়েছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল আমার কাছে।
রাগত ভঙ্গিতে চোখ মিটমিট করছেন তিনি। কমিকগুলো চুরি যাওয়ার আগে আমার স্টলের সামনে তাকে দেখেছি। তারপর হঠাৎ করেই কয়েকটা কমিক পেয়ে গেল সে। ধরেই নিলাম, সবগুলোই আছে তার কাছে। অল্প কয়েকটা বের করেছে। কাজেই তাকে একা ধরার জন্যে ওত পাতলাম। কোথায় কমিকগুলো লুকিয়েছে বের করার জন্যে। টাকা খাইয়ে কয়েক মিনিটের জন্যে আর্দালিটার কাছ থেকে এলিভেটরটা চেয়ে নিয়েছি। বের করে দিয়েছি তাকে।
একটা মুহূর্তের জন্যে কিশোরের মনে হলো, মিরিনাকে একা ছেড়ে দিয়ে ভুল করল না তো? কমিকগুলো নিয়ে পালাল? হয়তো মিরিনাই আসল চোর। পরক্ষণেই দূর করে দিল সন্দেহটা। কমিকগুলো দেখার পর মিরিনার চমকে যাওয়াটা অভিনয় হতেই পারে না। বলল, ভুল মানুষকে ধরেছিলেন আপনি, মিস্টার ডিকসন। কমিকগুলো পাওয়ার সময় আমি ছিলাম মিরিনার সামনে। কে জানি তার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
উদভ্রান্ত দৃষ্টি ফুটল ম্যাডের চোখে। পাগলই হয়ে যাচ্ছেন যেন। অনুনয়ের সুরে কিশোরকে বললেন, চুরি করে কমিকগুলো নিয়ে গিয়ে মাথা খারাপ করে দিল আমার লোকটা। তোমরাও সুবিধে করতে পারলে না। বের করতে পারলে না ওগুলো। তখন আমিই খুঁজতে শুরু করলাম। কাল রাতে তোমাদের ঘরে সেজন্যেই ঢুকেছিলাম।
কিন্তু আমাদের ঘরে কেন ঢুকলেন? মুসার প্রশ্ন।
তোমরা যে আছ ওখানে, তা-ই জানতাম না। শুধু জানি, ওটা দিয়ে তিনশো চোদ্দ নম্বরে ঢোকা যায়, তাই ঢুকেছিলাম…
লুই মরগানের ঘরে ঢোকার জন্যে? ভুরু তুলল রবিন।
লুই মরগান! নিজের কপালে চাপড় মারল কিশোর। আজ সকালে ভিডিও টেপের বাক্স নিয়ে বেরোতে দেখলাম একটা লোককে, তার ঘর থেকে। তখনই মনে পড়া উচিত ছিল আমার, কোথায় দেখেছি লোকটাকে। সুমাতো কমিকের স্টলে গরম গরম কার্টুনের ভিডিও ক্যাসেট বিক্রি করছিল।
ডিকসনের দিকে তাকাল সে। কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছেন ম্যাড, যেন বুঝতে পেরেছেন জ্যান্ত পোড়ানো হবে না আর তাকে, রেহাই পেয়ে গেছেন।
মরগানের সঙ্গে সুমাতো কমিকের সম্পর্ক কি, বলুন তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
জায়গাটার মালিক সে, জবাব দিলেন ডিকসন। কেন, তুমি জানো না? এজন্যেই তো কনভেনশনটা করতে পেরেছে এখানে। বহুদিন ধরে কমিকের ব্যবসা করে আসছে লোকটা।
কমিকের ব্যবসা, আমনে বিড়বিড় করল কিশোর। কয়েকটা ছিন্ন সুতো জোড়া দেয়ার চেষ্টা চালাল মনে মনে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছে, ম্যাড ডিকসন চুরিটা করেননি।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। একজন সন্দেহভাজন কমল। তবে রহস্য যেখানে ছিল, মোটামুটি সেখানেই রয়ে গেছে। সমাধান হয়নি।
আরেকটা প্রশ্ন করা দরকার ডিকসনকে। ফ্যান ফানের একটা কপি চুরি যাওয়ার পর আরেকটা যেটা এনে রাখা হল তার জায়গায়, সেটাতে প্রাইস ট্যাগ দেখলাম দুশো পঞ্চাশ ডলার। অথচ যেটা চুরি গেছে সেটা যখন কিনতে এলেন নীল বোরাম, দাম চাইলেন ছশো ডলার, এবং তাতেই তিনি কিনতে রাজি হয়ে গেলেন। কেন? ওটার এত বেশি দাম হওয়ার কারণ কি?
কালো ছায়া নামল ম্যাড ডিকসনের মুখে। ওটাতে আইজাক হুফারের সই ছিল। আসল আইজাক হুফার। সংগ্রাহকের জিনিস। কারও পছন্দ হলে যত দাম হকতাম, তত দিয়েই কিনে নিত।
This is a demo store for testing purposes — no orders shall be fulfilled. Dismiss