১৩. কাপড় খুলল কুমালো

0 Comments

কাপড় খুলল কুমালো। লম্বা, শক্ত, বাদামী শরীর, যেন নারকেলের কাণ্ড। দেয়ালের গা থেকে উপসাগরের ওপর বেরিয়ে থাকা একটা পাথরে গিয়ে দাঁড়াল। পরনে সাঁতারের পোশাক বলতে কিছু নেই, হাতে শুধু দস্তানা। ধারাল প্রবাল থেকে তার আঙুল বাঁচাবে ওগুলো। খসখসে খোসাওয়ালা ঝিনুক খামচে ধরে তুলতে সুবিধে হবে।

ডুব দেয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগল সে। ডুবুরিরা এই পদ্ধতিটাকে বলে টেকিং দ্য উইণ্ড বা বাতাস নেয়া। দম নিতে আরম্ভ করল সে, একটা থেকে আরেকটা আরও ভারি, আরও লম্বা। ঠেলে, জোর করে বাতাস ঢোকাচ্ছে ফুসফুসে। সেই বাতাস আটকে রাখতে বাধ্য করল ফুসফুসকে।

তারপর আস্তে করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল পানিতে। ঝাঁপ দিল না বলে আলগোছে শরীরটাকে ছেড়ে দিল বলা ভাল। মাথা নিচু করে ডাইভ দেয়নি। সোজা হয়ে পড়েছে। পা নিচের দিকে দিয়ে নেমে যাচ্ছে খাড়া।

এভাবে নেমে গেল দশ ফুট। তারপর ডিগবাজি খেয়ে ঘুরিয়ে ফেলল শরীরটা, এবার মাথা নিচে পা ওপরে। একই সঙ্গে হাত পা নাড়ছে, কাছিমের মত।

পানির নিচে সাঁতারের অনেক দৃশ্য দেখছে মুসা, সে নিজেও ভাল সাঁতারু। কিন্তু এরকম দৃশ্য কখনও দেখেনি। ডুবুরির পোশাক ছাড়া তিরিশ ফুট নিচে নামতে পারলেই ধন্য হয়ে যায় ইউরোপিয়ান কিংবা আমেরিকান সাঁতারুরা। চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। ওই গভীরতায়ই পানির প্রচণ্ড চাপ পড়ে শরীরের ওপর। নিচের পানি ওপরের দিকে ঠেলতে থাকে, পারলে গ্যাসভর্তি বোতলের মুখের কর্কের মত ফটাস করে ছুঁড়ে মারতে চায়।

কিন্তু কুমালো পরোয়াই করল না চাপের। নেমে যাচ্ছে…চল্লিশ ফুট…পঞ্চাশ …ষাট।

আমার বিশ্বাস, এর ডবল নিচে নামতে পারবে ও, কিশোর বলল। সাঁতার জানে বটে পলিনেশিয়ানরা।

হ্যাঁ, যোগ করল রবিন। বয়েস দুবছর হওয়ার আগেই সাঁতার শিখে ফেলে। হাঁটা শেখার আগে সাঁতার শেখে অনেক পলিনেশিয়ান শিশু। ডাঙা আর পানি ওদের কাছে সমান। উভচর। সীল, কাছিম, ব্যাঙ, বীবরের মত।

আবছা দেখতে পাচ্ছে তিন গোয়েন্দা, থেমেছে কুমালো। প্রবাল আঁকড়ে ধরে যেন ঝুলে রয়েছে, পা ওপরের দিকে। হাতের জোরে টেনে শরীরটাকে নামাল খানিকটা, ছেড়ে দিল, তারপর ধরল আরেক জায়গার প্রবাল। এরকম করল কয়েক বার। মনে হচ্ছে, হাতের ওপর ভর দিয়ে সাগরের তলায় হেঁটে বেড়াচ্ছে সে।

তারপর কালো কিছু একটা আঁকড়ে ধরে মাথা ঘোরাল, তীব্র গতিতে উঠতে শুরু করল ওপরে। ভুস করে ভেসে উঠল তার মাথা, শরীর, কোমর পর্যন্ত, আবার ডুবল, ভাসল, ডুবল, ভাসল, পরিষ্কার করে নিল মাথার ভেতরটা। হাত বাড়িয়ে ধরল পাথরের কিনার, যেটা থেকে লাফ দিয়েছিল।

হিসহিস করে তার ফুসফুস থেকে বেরোচ্ছে চেপে রাখা বাতাস। ব্যবহৃত বাতাস বেরিয়ে যাওয়ার পর বুক ভরে টেনে নিল বিশুদ্ধ বাতাস। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ, ছেলেদের কথা যেন কানে ঢুকছে না।

ধীরে ধীরে ঢিল হয়ে এল শরীর। স্বভাবিক হল চেহারা। ওপরের দিকে তাকিয়ে হাসল সে। তার বাড়ানো হাতটা চেপে ধরে তাকে টেনে ওপরে তুলল ছেলেরা।

হাতের কালো বস্তুটা পাথরে রাখল কুমালো।

আনন্দে চিৎকার করে উঠল মুসা। মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাল কিশোর, সঠিক দ্বীপটা খুঁজে পাওয়ায়। উপসাগরটা খুঁজে পেয়েছে ওরা, পেয়েছে প্রফেসর ইস্টউডের মুক্তার খামার। নিশ্চিত হওয়ার কারণ আছে। এসব অঞ্চলের ঝিনুক সাধারণত এতবড় হয় না, বাইরে থেকে বীজ আনার ফলেই হয়েছে।

এরকম আর আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল কুমালো। বিছিয়ে আছে তলায়। সেজন্যেই ওপর থেকে কালো লাগে। একটার গায়ে আরেকটা লেগে রয়েছে। শয়ে শয়ে।

উত্তেজনায় প্রায় নাচতে শুরু করল মুসা। তারমানে শত শত মুক্তা!

না, শান্তকণ্ঠে বলল কুমালো। সব ঝিনুকে মুক্তা থাকে না। একটা মুক্তার জন্যেই হয়ত একশো ঝিনুক খুলতে হবে।

হ্যাঁ, সে-রকমই হবার কথা, একমত হল রবিন। তবে এখানে একটু অন্য রকম হতে পারে। বিশেষ ব্যবস্থায় ঝিনুকের চাষ করেছেন প্রফেসর।

দেখা যাক তাহলে এটাতে কিছু আছে কিনা, বলতে বলতে কোমর থেকে ছুরি খুলল মুসা। ঝিনুকটা নিয়ে চাড় মেরে খোলা দুটো খোলার চেষ্টা করতে। লাগল। অনেক চেষ্টা করল, ঘামতে শুরু করল সে, কিন্তু ঝিনুক আর খুলতে পারল না।

এভাবে পারবে না, কায়দা আছে,কুমালো হাত বাড়াল। দেখি, দাও আমার কাছে। চাড় দিয়ে ডালা খোলার বদলে ছুরির ফলাটা সে ঢুকিয়ে দিল দুই ডালার মাঝের ফাঁক দিয়ে, যতখানি যায়, কেটে ফেলল খোলাকে চাপ দিয়ে বন্ধ করে রাখে যে মাংসপেশি, সেটা। পেশি কেটে যেতেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ডানা দুটো।

মুসার হাতে ঝিনুকটা দিল কুমালো। নাও, এবার খুঁজে দেখ। থাকলে কিনারের মাংসের ভেতরেই থাকবে।

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে, কাঁপা হাতে মুক্তা খুঁজল মুসা। পেল না। হতাশ হল খুব। কিন্তু হাল ছাড়ল না। আরও ভেতরেও থাকতে পারে, কে জানে। অনেক খুঁজল সে। ঝিনুকের আঠাল পিচ্ছিল মাংস আর দেহযন্ত্রের কোনা কিছুই বাদ দিল না। কিন্তু মুক্তা মিলল না।

ধুত্তোর, খামোকা ঘাটলাম! বিরক্ত হয়ে প্রবালের একটা স্তপের ওপাশে ঝিনুকটা ছুঁড়ে মারল মুসা। অন্য পাশে গিয়ে শক্ত কিছুতে লাগার বদলে লাগল নরম কিছুতে, বিচিত্র একটা শব্দ শোনা গেল। লাফ দিয়ে উঠে স্কুপের কাছে দৌড়ে এল মুসা। আবিষ্কার করল রেভারেণ্ড হেনরি রাইডার ভিশনকে। মুখ থেকে ঝিনুকের রস আর মাংস মুছছে লোকটা।

গর্জে উঠে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ভিশন। মনে পড়ল, মিশনারির ওরকম রাগ করা উচিত না, মুখ খারাপ তো দূরের কথা। মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে হাসার চেষ্টা করল।

আপনি এখানে কি করছেন? মুসা জানতে চাইল।

প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না ভিশন। বেরিয়ে এল স্তুপের ওপাশ থেকে। কিশোর, রবিন আর কুমালোও এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের দিকে চেয়ে হাসল। কান। থেকে গড়িয়ে পড়ছে ঝিনুকের রস।

তোমাদের জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম, বলল সে। তাই আর থাকতে না পেরে দেখতে এসেছি কি করছ।

আপনি আমাদের ওপর স্পাইগিরি করছিলেন! গরম হয়ে বলল মুসা।

শান্ত দৃষ্টিতে মুসার দিকে তাকাল ভিশন। মাই বয়, তোমার মনে রাখা উচিত, দ্র আচরণ ঈশ্বর পছন্দ করেন।

পাক-পবিত্র থাকাও ঈশ্বর পছন্দ করেন, মুসা বলল। যান, মুখ ধুয়ে পাকসাফ হোন।

কিশোরের দিকে চেয়ে অভিযোগের সুরে বলল ভিশন, দেখ, তোমার বন্ধু দুর্ব্যবহার করছে। তোমার কিছু বলা উচিত।

নিশ্চয় বলব, তবে আপনাকে। ও ভূল বলেনি, আপনি সত্যি স্পাইগিরি করছিলেন আমাদের ওপর। আড়ালে থেকে চোখ রাখছিলেন।

ভুল করছ, মাই সান, ভুল করছ। আর তোমাদেরই বা দোষ দিই কিভাবে? রক্ত গরম, মাথা গরম করার বয়েস তো এটাই। যাকগে, আমি কিছু মনে করিনি তোমাদের কথায়। মিশনারি যখন হয়েছি, মাপ করতেই হবে মানুষকে, বলতে বলতে কিশোরের কাঁধে হাত রাখল ভিশন।

ঝাড়া দিয়ে হাতটা কাঁধ থেকে ফেলে দিল কিশোর। হয়েছে, ওসব ভণিতা রাখুন। আপনি মিশনারি নন। বেঈমান, দুমুখো সাপ।

বুঝতে পারছি, রেগেছ,ধৈর্য হারাল না মিশনারি। কিন্তু কেন এই ক্ষোভ জানতে পারি? সব খুলে বল আমাকে, বুঝে দেখি ভুল বোঝাবুঝিটা কোত্থেকে হল?

ক্ষণিকের জন্যে দ্বিধায় পড়ে গেল কিশোর। ভুল করেনি তো? লোকটা কি সত্যিই মিশনারি? ধৈর্য তো সে-রকমই, শান্তও রয়েছে। রেগে না গিয়ে বরং বোঝানর চেষ্টা করছে।

ফাঁদে ফেলার জন্যে হঠাৎ বলল কিশোর, প্রফেসর ইস্টউডের নাম নিশ্চয় শুনেছেন?

সামান্যতম চমকাল না ভিশন। মনে করার চেষ্টা চালাচ্ছে যেন। ইস্টউড… মাথা নাড়ল। না, মনে পড়ছে না। বোধহয় শুনিনি।

অ, তাহলে তো তাঁর ল্যাবরেটরিতে বাগও আপনি লুকাননি। তার সঙ্গে আমাদের কি কি কথা হয়েছে শোনেননি। জানেন না আমাদের এই দ্বীপে আসার কারণ। কালো সেডানে করে আমাদের পিছু নেননি। স্যালভিজ ইয়ার্ডটাও চেনেন।

না, তাই না?

কি বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না, গলার জোর কিছুটা হারিয়েছে ভিশন। ঝিনুকের একটুকরো মাংস খসে পড়ল লম্বা নাক থেকে।

বুঝিয়ে দিচ্ছি। জামবুকে আপনিই শুকতারায় তুলে দিয়েছিলেন পার্ল ল্যাগুনের অবস্থান জানার জন্যে। আপনার নির্দেশেই আমার কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছে সে। মিশনারির ছদ্মবেশে আমাদের ভুলিয়ে বোটে উঠেছেন জামবু যে কাজ করতে পারেনি, সেটা করার জন্যে। লগবুক থেকে রিডিং নকল করেছেন। পথে এত দ্বীপ পড়ল কোনটাতেই নামেননি, পছন্দ হয়নি আপনার। হবে কি ভাবে? নামার উদ্দেশ্যে তো আসেননি। মানুষের ভালবাসা না ছাই, আসলে এসেছেন মুক্তোর খোঁজে।

ধপ করে একটা নারকেলের গুড়ির ওপর বসে পড়ল মিশনারি। হতাশ ভঙ্গিতে দুহাত ছড়াল। সামনে ঝুঁকল চওড়া কাঁধ। রাগে কালো হয়ে গেছে মুখ। তবে সামলে নিল।

বেশ, বলল সে। বুঝতে পারছি, খেলা খতম। অতিরিক্ত চালাক তুমি। ফাঁকি দিয়ে আর লাভ হবে না, গিলবে না তুমি।

ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কিশোর।

হ্যাঁ, আবার বলল ভিশন। তোমাকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। বড় বেশি চালাক। তোমার বিরুদ্ধে না গিয়ে পক্ষেই থাকতে চাই।

সেটা সম্ভব নয়।

কেন নয়? স্বীকার করছি, আমি মিশনারি নই। ছদ্মবেশ নিয়েছি, অভিনয় করেছি। তার মানে এই নয় যে তোমাদের ক্ষতি করতে চেয়েছি।

কি চেয়েছেন তাহলে? মুক্তো চুরি করতে?

চুরি বলছ কেন? শব্দটা পছন্দ হল না ভিশনের। এই মুক্তোর খেত কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এই দ্বীপটার মালিকও প্রফেসর নয়। এমনকি আমেরিকান সরকারও এটার মালিকানা দাবি করতে পারবে না। এটা কারও জায়গা নয়, তারমানে সবার। আমি সেই সবার একজন। তোমরাও। এই ল্যাগুন, যা যা আছে এখানে, সব কিছুর মালিক সবাই। আমাদের সবারই অধিকার রয়েছে এতে।

তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, এত খাটাখাটনি করে, টাকা খরচ করে, প্রফেসর যে মুক্তোর খামার করেছেন…

প্রফেসরটা একটা গাধা। মানুষকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করে। নিজের ভাল বোঝার অধিকার রয়েছে মানুষের এটা যেন জানেই না। আমি তার মত বোকা নই। কাজেই নিজের ভালমন্দ অবশ্যই বুঝব। তোমাদের কাছে আর লুকিয়ে লাভ নেই, আমার নাম ভিশন নয়, ডেংগু পারভি। আমি মুক্তা ব্যবসায়ী। দক্ষিণ সাগরে খুচরা মুক্তা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যাই নিউ ইয়র্ক, লণ্ডন, প্যারিসে। বিক্রি করি। মুক্তা চিনি আমি। আমার সাহায্য নিলে লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না তোমাদের। আমি যে দামে বিক্রি করতে পারব, তার চার ভাগের এক ভাগ দামেও তোমরা পারবে না। একটা রফায় আসতে পারি আমরা, ফিফটি-ফিফটি শেয়ার। কি, রাজি?

আপনার কথা শেষ হয়েছে? তাহলে যেতে পারেন।

হাসি ফুটল ডেংগুর ঠোঁটে। কাঁধের হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করল। আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছ তোমরা, ভারি গলায় বলল সে। আরও একটা কথা জেনে রাখতে পার, মুক্তো অনেক দামি জিনিস। এরচে অনেক কম দামি জিনিসের জন্যে মানুষ খুন করেছি আমি।

কিশোর, মুসা বলে উঠল, ভয় দেখাচ্ছে ব্যাটা। রাজি হয়ো না। কচুটাও করতে পারবে না।

জ্বলে উঠল ডেংগুর চোখ। এই নিগ্রোর বাচ্চা, চুপ! আরেকটা কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব। তোকে কথা বলতে কে বলেছে? চুপ করে বোস ওখানে। জলদি! এই, তোমরাও বস।

শুনো না, কিশোর, ওর কথা শুনো না, চেঁচিয়ে উঠল মুসা। দেখি হারামজাদা কি করে…

গর্জে উঠল রিভলভার। দুবার গুলি করল ডেংগু। একটা বুলেট মুসার প্রায় কান ছুঁয়ে গেল। আরেকটা গেল কিশোরের মাথার ওপর দিয়ে। পাথরে লেগে পিছলে গেল বুলেট, শিস কেটে চলে গেল পানির ওপর দিয়ে। প্রতিধ্বনি তুলল ল্যাগুনের অন্যপাশে প্রবালের দেয়ালে। চিৎকার করে নারকেলের কাণ্ড থেকে উড়ে গেল একটা নিঃসঙ্গ গাংচিল।

মিথ্যে হুমকি দিচ্ছে না লোকটা, বুঝতে পারল কিশোর। যেখানে বসতে বলা হয়েছে, বসে পড়ল। হাত ধরে টেনে বসাল মুসাকে। রবিনকে কিছু বলতে হল না, আপনাআপনি বসে পড়ল।

নিরস্ত্র কয়েকজন মানুষকে রিভলভারের ভয় দেখাচ্ছেন, রবিন বলল। লজ্জা করে না আপনার?

মানুষ কোথায়? কয়েকটা পুঁচকে বাঁচাল ছোঁড়া, হাহ হা। আর তোমাদের কাবু করতে অস্ত্র লাগে নাকি? খালি হাতেই টেনে টেনে ছিড়তে পারি ইচ্ছে করলে। কিন্তু কে কষ্ট করতে যায়? আর রিভলভার তোমাদের ভয়ে বের করিনি, করেছি ওই দানবটার জন্যে। এই দানব, কানাকার বাচ্চা কানাকা, এদিকে আয়। বোস। রিভলভার নেড়ে কুমালোকে ডাকল ডেংগু।

কুমালোকে দলে টানার কথা ভাবছেন নাকি? কিশোর বলল। অযথা মুখ খরচ করবেন। লাভ হবে না।

টেনে টেনে হাসল ডেংগু। এমন কোন কানাকা দেখিনি আমি, টাকা দিয়ে যাকে গোলাম বানানো যায় না। কুমালো, আমার চাকরি করবি তুই। ডুবুরি। অনেক টাকা দেব তোকে। জীবনে, এত টাকা চোখেও দেখিসনি। যা, কাজ শুরু করে দে। পানিতে নাম।

ধীরে ধীরে হাসি ফুটল কুমালোর সুন্দর মুখে। ভুল করছেন, মিস্টার ডেংগু, মোলায়েম স্বরে বলল সে। নাম শুনেই বুঝতে পারছি অস্ট্রেলিয়া, কিংবা নিউ গিনির কোন জঙ্গলে আপনার বাড়ি। টাকা দিয়ে স্বদেশী কোন জংলী ভাইকে গিয়ে কিনুন। রায়াটিয়ার মানুষ গোলাম হয় না।

যা বলছি কর! বেঁকিয়ে উঠল ডেংগু। নইলে মগজ বের করে দেব!

কিশোরের দিকে তাকাল কুমালো। আবার ফিরল ডেংগুর দিকে। বেশ। কত দেবেন?

এই তো পথে আসছিস। গোলাম আবার হবি না। তোদের চিনি না আমি? যা তুলবি তার পাঁচ ভাগের একভাগ।

চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কুমালো। আমার দস্তানা। আপনার পেছনের ওই পাথরের কাছে…

পেছন ফিরল ডেংগু।

বসা থেকে উঠে পড়ল মুসা।

ঝট করে আবার এদিকে ফিরল ডেংগু। কুমালোর দিকে রিভলভার নেড়ে বলল, যা, তুই নিয়ে আয়।

পাশ দিয়ে চলে গেল কুমালো। সামান্য পাশে ঘুরে একসঙ্গে তিন কিশোর আর তার ওপর নজর রাখল ডেংগু।

নড়ে উঠল কিশোর। মুহূর্তের জন্যে শুধু নজর ফেরাল ডেংগু, এটুকুই যথেষ্ট। বাঘের মত লাফিয়ে এসে তার ওপর পড়ল কুমালো। বাহু দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল গলা। আরেক হাতে কজি চেপে ধরে রিভলভারটা হাত থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল।

এগিয়ে এল তিন গোয়েন্দা।

ডেংগুর গায়ে মোষের জোর। হাত থেকে রিভলভার ছাড়ল না। কিশোরকে নিশানা করল।

সর, সরে যাও! চিৎকার করে বলল কুমালো। কিছুতেই পিস্তলের নল যোরাতে পারছে না।

গর্জে উঠল রিভলভার। আগেরবার গুলি করেছিল মারধান করার জন্যে। এবার করেছে মারার জন্যে। শেষ মুহূর্তে কুমালোর হ্যাঁচকা টানে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল গুলি।

সামনে চলে এল মুসা। ঘুসি মারল ডেংগুর মুখে।

ভীষণ শক্তিশালী বার ভেতর থেকে রিভলভারটা বের করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে কুমালো। পারছে না। নলের মুখ আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে মুসার পেটের দিকে। এখন একটাই কাজ করার আছে কুমালোর, মুসাকে বাঁচাতে হলে। সামনে চলে আসা। নিজের শরীর দিয়ে মুসাকে আড়াল করা। ঠিক তা-ই করল সে। ডেংগুও ট্রিগারে চাপ দিল, সে-ও চলে এল নলের সামনে। গুলি খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

হাঁটু গেড়ে বন্ধুর পাশে বসে পড়ল মুসা। মনে পড়ল বিকিনির সেই রাতের কথা। সৈকতে বসে কথা দিয়েছিল ওরা, একে অন্যের জন্যে জীবন দিয়ে দেবে। নাম বদল করেছিল। কুমালো বন্ধুত্বের মান রেখেছে।

ডেংগুর সোলার প্রেক্সাসে ঘুসি মারছিল কিশোর। কিছুই হয়নি দানবটার। বরং কিশোরই হাতে ব্যথা পেয়েছে। তার মনে হয়েছে, ঘুসি মেরেছে একতাল রবারের ওপর। ঘুসাঘুসি বাদ দিয়ে বসল কুমালোর পাশে।

এই সুযোগে ছুটে চলে গেল ডেংগু।

পিছু নিতে যাচ্ছিল মুসা, হাত ধরে তাকে থামাল কিশোর। পরে। ওর কথা। পরে ভাবা যাবে। আগে কুমালোর ব্যবস্থা করা দরকার।

কি করব?নাড়ি দেখছে রবিন। চলছে এখনও। কুমালোর ডান হাঁটুর ইঞ্চি দশেক ওপর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

চোখ বুজে পড়ে আছে কুমালো।

ক্ষতটা পরীক্ষা করল কিশোর। দুটো গর্ত। বুলেট ঢোকার একটা, অন্যটা বেরোনোর। যেটা দিয়ে ঢুকেছে, ওটার মুখের চারপাশে পুড়ে গেছে চামড়া। খুব কাছে থেকে গুলি করলে হয় এরকম, বারুদের আগুনে পুড়ে যায়।

বুলেটটা বোধহয় হাড়ে লাগেনি, মাংস ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। ভাগ্য ভাল, শিরা হেঁড়েনি। রক্ত বেরোচ্ছে, তবে কম।

শার্টের কাপড় ছিঁড়ে ল্যাণ্ডন থেকে ভিজিয়ে আনল রবিন। মুছে দিতে লাগল ক্ষত।

পেনিসিলিন দরকার, কিশোর বলল। কিংবা সালফা পাউডার।

দুটোই আছে বোটে, বলল রবিন। নিয়ে আসব গিয়ে?

না। ওকেই নিয়ে যেতে হবে বোটে। বাংকে শুইয়ে দিতে হবে। কিন্তু, নেয়াই হয়ে যাবে মুশকিল। মুসা, তুমি বরং গিয়ে বোটটা কাছে নিয়ে এস। দাঁড়াও দাঁড়াও, ইঞ্জিনের শব্দ…

ঠিকই শুনেছে সে। চালু হয়েছে বোটের ইঞ্জিন। ডেংগুই বোধহয় নিয়ে আসছে, রবিন বলল। অনুশোচনা হয়েছে তাহলে।

প্রাচীরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বোটটা। ল্যাগুন পেরিয়ে এসে ঢুকল উপসাগরে। ইতিমধ্যে নিজের শার্ট দিয়ে পেঁচিয়ে কুমাােের জখমের ওপরে টর্নিকেট বেঁধে ফেলেছে কিশোর। তার জানা আছে পনেরো মিনিট পর পর ঢিল দিয়ে আবার বাঁধতে হবে।

ডেংগু বোটটা নিয়ে আসছে বলে তার ওপর থেকে রাগ অনেকখানি কমল কিশোরের। মুসা, ওকে দেখিয়ে দাও কোন জায়গায় বোট রাখবে।

ইঞ্জিন থেমে গেছে। মুখ তুলে তাকাল কিশোর। অবাক হল। তীর থেকে এখনও একশো ফুট দূরে রয়েছে বোটটা।

এই-ই, আরেকটু সামনে আনতে হবে, চেঁচিয়ে হাত নেড়ে বলল মুসা।

জবাবে খিকখিক হাসি শোনা গেল। হুইল মোরাল ডেংগু। বোটের নাক ঘুরে গেল আরেক দিকে।

ভুল করছ, বাবা, হেসে বলল ডেংগু। তীরে ভেড়ানর জন্যে আনিনি। যাবার আগে শুধু কয়েকটা কথা বলতে এলাম তোমাদের সঙ্গে।

বোকা হয়ে গেল কিশোর।

হাঁ করে ডেংগুর দিকে তাকিয়ে আছে তিনজনে।

যাবার আগে মানে? কিশোর বলল। কি বলতে চাইছেন? গলা কাঁপছে তার।

বুঝলে না? একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, মানতে পারনি। কাজেই একাই যেতে হচ্ছে আমাকে। সোজা পোনাপেতে চলে যাব। একটা জাহাজ আর ডুবুরি ভাড়া করে নিয়ে ফিরে আসব।

পারবেন না। নেভিগেশনের কিছু জানেন না।

তাতে কি? পোনালে অনেক বড় দ্বীপ। সোজা দক্ষিণে চলতে থাকব। এক সময় না এক সময় পেয়েই যাব দ্বীপটা।

কিন্তু কুমালোকে ডাক্তার দেখানো দরকার। এখানে থাকলে ও মরে যাবে। এভাবে একজন মানুষ মরবে, ভাবছেন না সে কথা?

কেন ভাবব? ও তো একটা কানাকা।

বলেন কি! এরকম একটা জায়গায়…,হারিক্যানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দ্বীপটার ওপর চোখ বুলিয়ে আতঙ্কিত হল কিশোর। এখানে ফেলে যেতে পারেন না আমাদেরকে। আপনি ফেরা পর্যন্ত বাচব না। কোন খাবার নেই। একটা কাঁকড়াও দেখিনি এতক্ষণে। ছায়া নেই, উড়ে যে বানাব তারও উপায় দেখি না। পানি নেই। পিপাসায়ইরে যাব। আর এতগুলো খুনের দায়ে সারা জীবন জল খাটতে হবে আপনাকে।

একবার খেটেছি, ডেংগু বলল। আর ঢাকার ইচ্ছে নেই ওখানে। এজন্যেই গুলি করে মারলাম না তোমাদের। যদি কেউ তোমাদের কথা জিজ্ঞেস করে-করবে বলে মনে হয় না—যদি করেই, বলব আমি না ফেরাতক দ্বীপে থাকবে ঠিক করেছিলে তোমরা। বাঁচতে পারনি, কোন কারণে মরে গেহ, তার আমি কি করব?

থ্রটলের দিকে হাত বাড়াল ডেংগু।

দাঁড়ান! মরিয়া হয়ে বলল কিশোর। একটা কথা অত রাখুন। ফার্স্ট এইড কিট থেকে পেনিসিলিনের টিউব আর সালফার কৌটাটা দিয়ে যান। কাছে আসার দরকার নেই। ছুঁড়ে মারুন।

হেসে উঠল ডেংগু। ওগুলো আমারও দরকার হতে পারে, খোকা। দূর যাত্রায় যাচ্ছি তো। কখন কি ঘটে যায়, বলা যায় না। তখন পাব কোথায়? চলি। গুড় বাই।

হালকা বাতাস ঠেলে বোটটাকে অনেকটা কাছে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিল মুসা। জোরে সাঁতরে চল বোটের দিকে। দেখাদেখি কিশোরও গিয়ে পানিতে পড়ল। প্রথমবারের চেষ্টায় ইঞ্জিন স্টার্ট না নিলে হয়ত বোটটাকে ধরে ফেলতে পারবে ওরা। খালি হাতে পারবে না ডেংগুর সঙ্গে, পারেনি চারজনে মিলেও, তার ওপর ওর কাছে রয়েছে রিভলভার। কি করে কাবু করবে এত শক্তিশালী শত্রুকে, একবারও ভাবল না ওরা।

চালু হয়ে গেল ইঞ্জিন। ঘুরতে শুরু করে প্রপেলার। খুব ধীরে গতি নিতে লাগল ভারি বোটটা। একসময় আশা হল ছেলেদের, ধরে ফেলতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণেই গতি বাড়ল, ওদের চেয়ে দ্রুত চলতে শুরু করল ওটা।

আর চেষ্টা করে লাভ নেই, থেমে গেল কিশোর আর মুসা। তাকিয়ে রয়েছে বোটের দিকে।

ল্যাগুনের প্রবেশমুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা। দেয়ালের কাঁধের ওপাশে হারিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে ওদের দিকে ফিরে হাত নাড়ল ডেংগু।

আর কিছু দেখার নেই। শুধু বোটের রেখে যাওয়া ঢেউ ছাড়া। চিৎকার করে উঠল সেই গাংচিলটা। ওই একটা পাখি ছাড়া জীবন্ত আর কোন প্রাণী যেন রেখে যায়নি রিক্যান।

আর কি করব! চল, বলে তীরের দিকে সাঁতরাতে শুরু করল কিশোর।

আস্তে আস্তে সাঁতরে তীরে ফিরে এল ওরা। ডাঙায় উঠে এসে ধপ করে প্রায় গড়িয়ে পড়ল কুমালোর পাশে।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। যা ঘটে গেছে, বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও। রুক্ষ প্রবালের স্কুপের ওপর ঘুরে এল ওদের দৃষ্টি।

হঠাৎ হাসতে শুরু করল মুসা। হতাশার দুর্বল হাসি। রবিনসন ক্রুসসা পড়ার পর কতবার ভেবেছি, ইস, ওরকম কোন দ্বীপে গিয়ে যদি থাকতে পারতাম, কি মজা হত। কিন্তু মরুভূমির চেয়ে খারাপ এরকম একটা জাগায় আটকা পড়ব, কল্পনাও করিনি কোনদিন!

Categories: