১. ডেভিস ক্রিস্টোফারের প্যাসিফিক স্টুডিও

0 Comments

ডুবুরি-পোশাক পরে সাগরে ডুব দিয়েছ কখনও? জিজ্ঞেস করলেন ডেভিস ক্রিস্টোফার।

প্যাসিফিক স্টুডিও। বিখ্যাত চিত্রপরিচালকের অফিসে বসে আছে তিন গোয়েন্দা।

বিশাল টেবিলের ওপাশে বসা মিসটার ক্রিস্টোফারের দিকে চেয়ে বলল মুসা আমান, হ্যাঁ, স্যার, ড়ুবেছি। গতকাল শেষ পরীক্ষা নিয়েছেন আমাদের ইনস্ট্রাকটর। পাস করেছি। ভালভাবেই।

অভিজ্ঞ ডুবুরি নই আমরা, যোগ করল কিশোর পাশা। তবে নিয়মকানুন সব জানি। ফেস মাস্ক আর ফ্লিপার আছে আমাদের তিনজনেরই।

গ্যাস ট্যাংক আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি? জানতে চাইলেন চিত্রপরিচালক।

গুড, বললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। মনে হয় কাজটা করতে পারবে তোমরা।

কাজ! বলে উঠল রবিন।

হ্যাঁ, বললেন চিত্রপরিচালক। একটা রহস্যের কিনারা করতে হবে। সেজন্যেই ডেকেছি তোমাদের। আর হ্যাঁ, এক-আধটু অভিনয়ও করতে হবে।

অভিনয়? ভুরু কোঁচকাল মুসা। কিন্তু আমরা তো স্যার, অভিনেতা নই। কিশোর অবশ্য মাঝেমধ্যে টেলিভিশনে…

অভিজ্ঞ অভিনেতার দরকার নেই ওদের, বললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। মুসা, তোমার বাবা কোথায় আছে এখন, জান?

জানি স্যার, অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান মুসার বাবা রাফাত আমান। ছবির শুটিঙের সময় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তদারকির ভার থাকে তাঁর ওপর। ফিলাডেলফিয়ায়।

ভুল বললে, হাসলেন পরিচালক। রাফাত এখন একটা দ্বীপে।

কিন্তু বাবা তো গিয়েছিল ডিরেক্টর জন নেবারের সঙ্গে। এসকেপ ছবির শুটিঙে।

জনের সঙ্গেই আছে। ছবির একটা বিশেষ দৃশ্যের জন্যে পুরানো পার্ক দরকার। স্কেলিটন আইল্যান্ডে আছে তেমনি একটা পার্ক।

স্কেলিটন আইল্যান্ডা ভুরু কুঁচকে গেছে। রবিনের। শুনে মনে হচ্ছে জলদস্যুদের দ্বীপ।

ঠিকই ধরেছ, বললেন পরিচালক। এককালে জলদস্যুদের ঘাঁটি ছিল ওই দ্বীপ। নামটা সত্যিই অদ্ভুত। আজও নাকি ভূতের উপদ্রব রয়েছে ওখানে। বালির তলা থেকে মাঝে মধ্যেই বেড়িয়ে পড়ে মানুষের কঙ্কাল। ভীষণ ঝড়ের পর কখনও-সখনও সৈকতে পড়ে থাকতে দেখা যায় সোনার মোহর। বেশি না, একটা দুটো। ভেবে বস না, গুপ্তধন আছে স্কেলিটন আইল্যান্ডে। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে, পাওয়া যায়নি। উপসাগরের তলায় হয়ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু মোহর। ঝড়ের সময় ঢেউয়ের ধাক্কায় সৈকতে এসে পড়ে।

এবং ওই দ্বীপেই যেতে বলছেন আমাদেরকে? আগ্রহে সামনে বুকল কিশোর। রহস্যের কিনারা করতে?

হ্যাঁ, এক হাতের আঙুলের মাথা সব একত্র করে মোচার মত বানালেন পরিচালক। দুজন সহকমীকে নিয়ে আছে ওখানে মুসার বাবা। পার্কটার জঞ্জাল পরিষ্কারের জন্যে লোক লাগিয়েছে। কিন্তু গোলমাল শুরু হয়ে গেছে। প্রথম দিন থেকেই। জিনিসপত্র চুরি যাচ্ছে। স্থানীয় একজন লোককে পাহারাদার নিযুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু চুরি ঠেকানো যাচ্ছে না। ভাবনায় পড়ে গেছে জন। খবর পাঠিয়েছে আমাকে।

আমাদের কাজ কি? জানতে চাইল কিশোর।

আসছি সে কথায়, হাত তুললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। এসকেপ ছবিটার প্রযোজক আমি। ঠিক করেছি, তোমাদেরকে পাঠাব। নাম যা-ই হোক, দ্বীপটা কিন্তু খুব সুন্দর। চারদিক ঘিরে আছে আটলান্টিক উপসাগর, গভীরতা খুবই কম। ওখানে ইচ্ছেমত ডোবাড়ুবি করতে পারবে তোমরা। কেউ কিছু সন্দেহ করবে না। ভাববে, তিনটে ছেলে গুপ্তধন খুঁজছে।

খুব…খুবই ভাল হবে, স্যার, বলল কিশোর।

জনের সঙ্গে কোম্পানির একজন লোক আছে, জোসেফ গ্র্যাহাম। দক্ষ ডুবুরি। ভাল ছবি তুলতে পারে, বিশেষ করে পানির তলায়। দরকার পড়লে সে তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। আরও একজন আছে, জনের সহকারী, পিটার সিমনস। সে-ও সাহায্য করবে তোমাদের। তাছাড়া মুসার বাবা তো আছেই। গুপ্তধন শিকারির ছদ্মবেশে চোর ধরার চেষ্টা করবে। আর হ্যাঁ, তোমরা গোয়েন্দা, অপরিচিত কারও কাছে সে কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করবে না।

খুব মজা হবে। তবে, রবিনের গলায় দ্বিধা, বাবা যেতে দিলে হয়।

না দেবার তো কোন কারণ দেখি না, বললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। খরচ-খরচা সব কোম্পানির। তোমাদের স্কুল ছুটি। তাছাড়া ওখানে মুসার বাবা আছে। দরকার হলে আমিও নাহয় ফোন করব। মিস্টার মিলফোর্ডকে। কিশোর, তোমার কোন অসুবিধে আছে?

নাহ। মুসা আর রবিন যাচ্ছে। তাছাড়া রাফাত চাচা আছে ওখানে, অমত করবে না মেরিচাচী।

তো কখন রওনা হচ্ছি। আমরা? পরিচালকের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।

বাড়িতে গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নাওগে। বিকেলে প্লেনের টিকেট পাঠিয়ে দেব। হ্যাঁ, রবিন, তোমাকে একটা জিনিস দিচ্ছি, ড্রয়ার খুললেন পরিচালক। একটা বড় খাম বের করে ঠেলে দিলেন টেবিলের ওপর দিয়ে। এতে একটা ম্যাগাজিন আছে। রেকর্ড আর রিসার্চের ভার যখন তোমার ওপর, তুমি রাখ এটা। স্কেলিটন আইল্যান্ডের ওপর একটা সচিত্র ফিচার আছে। পড়ে দেখ। অনেক কিছু জানতে পারবে দ্বীপটা সম্পর্কে।

উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।

যাত্রা শুভ হোক তোমাদের, বললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার।

থ্যাংকু, স্যার, বলে বেরিয়ে এলো তিন কিশোর।

ওই যে কঙ্কাল দ্বীপ, প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। এই বাংলা নামটা শিখেছে কিশোরের কাছ থেকে। স্কেলিটন আইল্যান্ড-এর চেয়ে ছন্দময়।

কই।…কোথায়া বলে উঠল কিশোর।

দেখি দেখি! বলল মুসা।

দুজনে একই সঙ্গে বুকে এলো জানালার কাছে, রবিনের গায়ের ওপর দিয়ে।

লম্বা, সরু উপসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে প্লেন। আঙুল তুলে দেখাল রবিন। তাদের নিচেই একটা ছোট্ট দ্বীপ। ঠিক যেন একটা মানুষের মাথার খুলি।

ম্যাপের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, বললো রবিন।

কৌতূহলী চোখে অদ্ভুত দ্বীপটার দিকে চেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। মিস্টার ক্রিস্টোফারের দেয়া ম্যাগাজিন পড়ে জেনেছে। ওরা অনেক কিছু। তিনশো বছরেরও বেশি আগে জলদস্যুদের ঘাঁটি ছিল কঙ্কাল দ্বীপ। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে, পাওয়া যায়নি গুপ্তধন। তার মানে এই নয় যে, ধনরত্ন লুকানো নেই। হয়তো দ্বীপে নেই, কিন্তু উপসাগরের তলায় থাকতে বাধা কোথায়? নিশ্চয় পানির তলায় কোথাও লুকানো আছেই। গুপ্তধন। তিন গোয়েন্দার আশা, খুঁজে পাবে ওরা।

আরেকটা ছোট দ্বীপ নজরে পড়ল।

ওই যে, দ্য হ্যান্ডা বলল কিশোর। হস্ত।

আর ওগুলো নিশ্চয় দ্য বোনস, যোগ করল মুসা। আঙুল তুলে দেখাল। কঙ্কাল দ্বীপ আর হস্তের মাঝামাঝি এক সারি ছোট প্রবাল-প্রাচীর দেখিয়ে বলল মুসা। ইয়াল্লা! এত তাড়াতাড়ি এসে পড়লাম! দুপুরের খাওয়াই হজম হয়নি এখনও!

দেখ, দেখা বলল রবিন। হাতের আঙুল। ওগুলো সরু প্রবালপ্রাচীরা পানির তলায় রয়েছে, অথচ ওপর থেকে কি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!

হস্তে যাব একদিন, বলল কিশোর। প্রাকৃতিক ফোয়ারা দেখব। কখনও দেখিনি।

দ্বীপগুলোকে পেছনে ফেলে এল প্লেন। মূল ভূখণ্ডের ওপর এসে পড়েছে। নিচে একটা গ্রাম। নাম ফিশিংপোর্ট। ওখানেই উঠবে তিন গোয়েন্দা। একটা বোডিং হাউসে ঘর ভাড়া করে রাখা হয়েছে তাদের জন্যে।

ফিশিংপোর্ট ছাড়িয়ে এল প্লেন। দ্রুত উচ্চতা হারাচ্ছে। ডানে ছোট্ট একটা শহর। নাম মেলভিল। এয়ারপোর্ট ওখানেই। কয়েক মুহুরুত পরেই রানওয়ে ছুলো প্লেনের চাকা। এয়ার টার্মিনাল বিল্ডিঙের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।

প্লেন থেকে নেমে এল তিন কিশোর। একপাশে তারের জালের বেড়া। বেড়ার ওপাশে লোকের ভিড়।

রাফাত চাচা এসেছেন। কিনা কে জানে! বলল রবিন।

ফোনে তো বলল আসবে, ভিড়ের দিকে চেয়ে হাঁটছে মুসা। কোন কারণে নিজে না আসতে পারলে অন্য কাউকে নিশ্চয়ই পাঠাবে।

বেড়ার বাইরে এসে দাঁড়াল তিনজন। এদিক ওদিক চাইল। মুসার বাবাকে দেখা গেল না।

অন্য কেউই এসেছে, নিচু গলায় বলল রবিন। ওই যে, আমাদের দিকে এগোচ্ছে।

ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে আসছে বেঁটে মোটা এক লোক। লালচে নাক।

এই যে, কাছে এসে বলল লোকটা। নিশ্চয়ই হলিউড থেকে এসেছ? তোমাদেরকে নিয়ে যেতে পাঠানো হয়েছে আমাকে। তিন কিশোরকে দেখছে সে। ছোট ছোট চোখে শীতল চাহনি। কিন্তু তোমরা গোয়েন্দা! বয়স্ক লোক আশা করেছিলাম আমি।

স্থির হয়ে গেল। রবিনের পাশে দাঁড়ানো কিশোর। আমরা গোয়েন্দা আপনার তো জানার কথা নয়!

আরও অনেক কিছুই জানি, দাঁত বের করে হাসল লোকটা। এখন এসো। গাড়ি অপেক্ষা করছে। তোমাদের মালপত্র যাবে অন্য গাড়িতে। আমারটায় জায়গা নেই। হলিউড থেকে অনেক জিনিসপত্র এসেছে, বোঝাই হয়ে গেছে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল লোকটা। পেছনে চলল। তিন গোয়েন্দা। পুরানো একটা স্টেশন ওয়াগনের সামনে এসে দাঁড়াল।

জলদি উঠে পড় গাড়িতে। আধা ঘণ্টা লেগে যাবে যেতে। আকাশের দিকে তাকাল। তার আগেই ঝড় এসে পড়বে। কিনা কে জানে!

আকাশের দিকে মুখ তুলল রবিন। পশ্চিম দিগন্তে ছোট্ট এক টুকরো কালো মেঘ, ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। ঢাকা পড়েছে সূর্য। আজ আর বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না। মেঘের চুড়ার কাছে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। ঝড় আসবে, ভীষণ ঝড়।

পেছনের সিটে উঠে বসল। তিন কিশোর। ড্রাইভিং সিটে বসল। লোকটা। গাড়ি ছাড়ল। এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে এসে রওনা হল উত্তরে।

আপনার সঙ্গে এখনও পরিচয়ই হল না, মিস্টার… থেমে গোল কিশোর।

হান্ট বলেই ডাকবে আমাকে। সবাই তাই ডাকে, বলতে বলতে এক্সিলারেটরে পায়ের চাপ বাড়াল লোকটা। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। দ্রুত নামছে অন্ধকার।

হ্যাঁ, মিস্টার হান্ট, আবার বলল কিশোর, আপনি কি সিনেমা কোম্পানিতে কাজ করেন?

সব সময় না, জবাব দিল হান্ট। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আপন মনেই বিড়বিড় করল, ঝড় আসছে। রাত নামতে দেরি নেই। নিশ্চয় বেরোবে আজ নাগরদোলার ভূতা ইস্স্, বোকামিই করলাম! বেরোনোই উচিত হয়নি!

শিরশির করে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। রবিনের মেরুদন্ড বেয়ে। নাগরদোলার ভূত! কঙ্কাল দ্বীপের ওই ভূতের কথা লেখা আছে ম্যাগাজিনে। বাইশ বছর আগে প্লেজার পর্কের নাগরদোলায় চড়েছিল। এক সুন্দরী তরুণী। নাম, স্যালি ফ্যারিংটন। হঠাৎ উঠল ঝড়। পর্কে আরও অনেকেই এসেছিল সেদিন, তাড়াহুড়ো করে পালাল। থেমে গোল নাগরদোলা। স্যালিকে নামতে বলল দোলার চালক। কিন্তু নামিল না। মেয়েটা। দোলা আবার চালাতে অনুরোধ করল। ঝড়ের মধ্যে নাগরদোলায় চড়তে কেমন লাগে, দেখতে চায়।

কিছুতেই মেয়েটাকে নামাতে পারল না চালক। ঝড় বেড়েই চলল। নিরাপদ জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিলো সে। স্যালি বসে রইল কাঠের ঘোড়ার গলা আঁকড়ে ধরে। হঠাৎ পড়ল বাজ। পড়ল এসে একেবারে নাগরদোলার ওপর।

বজ্রপাতে মারা গেল স্যালি। এর কয়েক হস্তপ্ত পরেই আরেক ঝড়ের রাতে নাকি দেখা গেল, আলো জ্বলে উঠেছে নাগরদোলার। পার্ক বন্ধ হয়ে গেছে বিকেলেই। কে জ্বলিলো আলো! কয়েকজন লোক সঙ্গে নিয়ে মোটরবোটে করে দেখতে গেলেন পার্কের মালিক মিস্টার স্মিথ। দ্বীপের কাছে গিয়ে দেখলেন, ঘুরছে নাগরদোলা। একটা কাঠের ঘোড়ায় চেপে বসেছে সাদা একটা মূর্তি। হঠাৎ দপ করে নিভে গেল সমস্ত আলো। থেমে গেল দোলা। কয়েক মিনিট পরে তীরে ভিড়ল বোট। দোলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকেরা। একটা রুমাল খুঁজে পেল, মহিলাদের রুমাল। এক কোণে সুতো দিয়ে তোলা হয়েছে দুটো অক্ষরঃ এস এফ।

খবরটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার স্মিথ, নইলে বন্ধ হয়ে যাবে পার্ক। কিন্তু গুজব ঠেকানো গেল না। পরদিন সকাল হতে না। হতেই ছড়িয়ে পড়লা খবর। লোকে জানল, ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে পার্কে। ওটার কাছ থেকে দূরে রইল সবাই। পড়ে পড়ে নষ্ট হতে লাগল নাগরদোলা, নাগরদোলা, দোলনা।

স্যালি ফ্যারিংটনের ভূত নাকি আজও দেখা যায়। ইদানীং নাকি বেড়েছে। প্রায় ঝড়ের রাতেই জেলেরা দেখতে পায়, সাদা একটা মূর্তি। ঘুরে বেড়াচ্ছে দ্বীপে। নষ্ট হয়ে গেছে নাগরদোলা। লোকের ধারণা, ওটা আবার চালু হবার অপেক্ষায় আছে স্যালির প্ৰেতাত্মা।

বহু বছর ধরে নির্জন পড়েছিল। কঙ্কাল দ্বীপ। গ্ৰীষ্মকালে মাঝে মধ্যে দুচারজন বিদেশী যেত ওখানে পিকনিক করতে, তবে দিনের বেলা।

সিনেমা কোম্পানি ঠিক করছে আবার নাগরদোলাটা, বলল হান্ট। স্যালির প্ৰেতাত্মা তাহলে খুব খুশি হবে। আবার চড়তে পারবে… থেমে গেল সে। জানালার কাচে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে ঝড়ো বাতাস। গাড়ি চালনায় মন দিল হান্ট।

পথের দুধারে জলাভূমি, লোক বসতির চিহ্নও নেই। আধা ঘণ্টা পর একটা জায়গায় এসে পৌঁছুল গাড়ি। সামনে দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। বাঁদিকের পথের পাশে মাইলপোস্ট। লেখাঃ ফিশিংপোর্টঃ ২ মাইল। ছেলেদেরকে অবাক করে দিয়ে ডানে গাড়ি ঘোরাল হান্ট। খানিক পরেই শেষ হয়ে এল পিচঢালা পথ। সামনে কাঁকর বিছানো ধুলোভরা কাঁচা রাস্তা।

মাইলপোস্ট বসানো বাঁয়ের রাস্তার পাশে, বলেই ফেলল মুসা। এ পথে যাচ্ছি কেন আমরা, মিস্টার হান্ট?

দ্বীপে নিয়ে যেতে বলেছেন, মিস্টার আমান, কাঁধের ওপর দিয়ে বলল হান্ট। আজ রাতে বোডিং হাউসে যেতে মানা করেছেন।

অ! চুপ করে গেল মুসা। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারল না। কোথায় যেন একটা খটকা রয়ে গেল!

ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোল গাড়ি। গতি কম। মাইল দুয়েক এসে থেমে পড়ল। হেডলাইটের আলোয় চোখে পড়ল একটা নড়বড়ে জেটি। ছোট, ঝরঝরে একটা মাছ ধরা বোট বাঁধা আছে জেটিতে। জলদি বেরোও! বলল হান্ট। গড নোজা ঝড় এসে গেলেই…

গাড়ি থেকে নামল তিন গোয়েন্দা। বোটটা দেখে অবাক। এতবড় মুভি-কোম্পানি, এর চেয়ে ভাল কোন বোট জোগাড় করতে পারল না! নাকি হান্টের নিজের বোট ওটা?

আমাদের মালপত্র? হান্ট নামতেই জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ওগুলোর জন্যে ভাবতে হবে না তোমাদের, বলল হান্ট। নিরাপদেই পৌঁছে যাবে বোর্ডিং হাউসে। জলদি এসো, বোটে ওঠ। এখনও অনেক পথ বাকি।

বোটে উঠল ওরা। মোটরের ওপর বুকল হান্ট। একটা বোতাম টিপে দিতেই স্টার্ট হয়ে গেল পুরানো ইঞ্জিন। ঢেউ কেটে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে চলল বোট। একবার। এদিক কাত হচ্ছে একবার ওদিক। ড়ুবেই যাবে যেন। ভয়ে বুক কাঁপছে তিন কিশোরের।

এলো বৃষ্টি। প্রথমে গুড়ি গুড়ি, জোর বাতাসের ধাক্কায় রেণু রেণু হয়ে আছড়ে পড়ল গায়ে। তারপর নামল বড় বড় ফোঁটায়। পাতলা ক্যানভাসের ঢাকনার তলায় গুটিসুটি হয়ে বসল। তিন কিশোর। অল্পক্ষণেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।

রেনকোট নেই? চেঁচিয়ে বলল মুসা। এভাবে বসে থাকলে বোট ড়ুবে যাবার আগেই মরব।

মাথা ঝোঁকাল হান্ট। দড়ি দিয়ে বাঁধল হুইলের একটা স্পোক। দড়ির অন্য মাথা দিয়ে বাঁধল বোটের গায়ে একটা খুঁটির সঙ্গে। কোনদিকেই এখন ঘুরতে পারবে না হুইল। উঠে গিয়ে একটা ছোট আলমারি খুলল। বের করে আনল চারটে হলুদ রেনকোট। একটা নিজে পরল। বাকি তিনটে দিল তিন কিশোরকে।

পরে ফেল, চেঁচেইয়ে বলল হান্ট। বাতাসের গর্জন, আস্তে কথা বললে শোনা যায় না। বোটেই রাখতে হয়। এগুলো। কখন বৃষ্টি আসে, ঠিকাঠিকানা তো নেই।

মুসার গায়ে ঠিকমত লাগল কোট, কিশোর আর রবিনের গায়ে বড় হল। তাতে কিছু যায় আসে না এখন। গায়ে পানি না লাগলেই হল।

আবার গিয়ে হুইল ধরল হান্ট। অনবরত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বেড়েছে বাতাসের বেগ। আকারে বড় হয়েছে ঢেউ। ধরেই নিয়েছে ছেলেরা, যে কোন মুহূর্তে উল্টে যেতে পারে বোট।

বিদ্যুতের আলোয় ডাঙা দেখা গেল সামনে। ছেলেদের মনে হল, জেটি ছাড়ার পর কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে।

ডাঙার কাছে চলে এলো বোট। জেটি চোখে পড়ল না। অবাক হয়ে দেখল ছেলেরা, চ্যাপ্টা একটা পাথরের ধারে এসে বোট রেখেছে হান্ট। পানির তলা থেকে বেরিয়ে আছে পাথরটা।

লাফাও, লাফিয়ে নাম! চেঁচিয়ে বলল হান্ট। গড নোজ!

নীরবে একে একে লাফিয়ে তীরে নেমে এলো ছেলেরা।

আপনি নামবেন না? চেঁচিয়ে বলল কিশোর।

ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে বোট। নামা যাবে না, চেঁচিয়ে জবাব দিল হান্ট। পথ ধরে এগোও। ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে।

ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়ল। দ্রুত সরে গেল বোট। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল ঝড়ো রাতের অন্ধকারে।

বাতাসের তাড়নায় গায়ে যেন সুচ ফুটাচ্ছে বৃষ্টি। মাথা নুইয়ে রাখতে হল তিন কিশোরকে।

চল, পথটা খুঁজে বের করিা বলল মুসা।

মাথা বুকিয়ে সায় দিল কিশোর।

হঠাৎ শোনা গেল শব্দটা। অদ্ভুত। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে যেন কোন বিশাল দানব। হু-উ-উ-উ-উ-হু-ই-শ-শ! হু-উ-উ-উ-উ-হু-ই-শ-শ!

শুনছ! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। কিসের শব্দ!

আবার শোনা গেল অদ্ভুত আওয়াজ।

কিছু একটা আছে দ্বীপো বলল কিশোর। আবার বিদ্যুৎ চমকালেই দেখার চেষ্টা করব! তোমরাও কর।

যেদিক থেকে শব্দ এসেছে, সেদিকে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। বিদ্যুৎ চমকাল। ক্ষণিকের জন্যে দেখল। ওরা, ছোট্ট এক দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে। এটা অন্য কোন দ্বীপ, কঙ্কাল দ্বীপ। এত ছোট না।

একটা টিলা, উটের কুঁজের মত ঠেলে বেরিয়ে আছে দ্বীপের গা থেকে। আশপাশে ছোটবড় পাথরের ছড়াছড়ি। এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা গাছ, বাতাসের ঝাপটায় মাথা নুইয়ে ফেলেছে। কোন পথ চোখে পড়ল না, দেখা গেল না ক্যাম্প।

অদ্ভুত শব্দ হল আবার। ঠিক এই সময় আবার বিদ্যুৎ চমকাল। অবাক হয়ে দেখল তিন কিশোর, কুঁজের ঠিক মাঝখান থেকে তীব্ৰ গতিতে আকাশে উঠে যাচ্ছে পানি, বিশাল এক ফোয়ারা। বাতাসের আঘাতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিটকে পড়ছে পানি, অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে সে-জন্যেই।

প্রাকৃতিক ফোয়ারা বলে উঠল কিশোর। কঙ্কাল দ্বীপ না, এটা হস্ত!

স্তব্ধ হয়ে গেল অন্য দুজন।

তাদেরকে হস্তে নামিয়ে দিয়ে গেল কেন হান্ট? এই ভয়াবহ ঝড়ের রাতে নির্জন দ্বীপে ফেলে রেখে গেল কেন?

Categories:

This is a demo store for testing purposes — no orders shall be fulfilled. Dismiss