১. হাতের যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল মুসা, সাংঘাতিক জিনিস

0 Comments

গুপ্তচর শিকারি – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথশ প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৯৬

দেখতে এমন সাধারণ হলে কি হবে, হাতের যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল মুসা, সাংঘাতিক জিনিস। যে কোন জিনিস খুঁজে বের করতে পাররে এটা দিয়ে, ধাতু হলেই হলো।

যেমন? জানতে চাইল রবিন।

 গহনা, মুদ্রা, সোনার কলম…

বলো কি হে, কৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল রবিন, বাড়ির আশপাশের গুপ্তধন তো আর রাখবে না তুমি..

 দেখো, অত ইয়ার্কি মেরো না, আদর করে পুরানো যন্ত্রটায় হাত বুলাল মূসা, আসলেই রাখব না। এর ক্ষমতা তুমি জানো না।

আমি জানি, কিশোর বলল, এ সব মেটাল ডিটেক্টর সত্যিই কাজের জিনিস। কিনে ফেলেছ নাকি? দাম দিয়ে দিয়েছ?

হ্যাঁ, পানির দাম বলতে পারো। নষ্ট ছিল। কিনে নিয়ে নিজেই মেরামত করেছি। চমৎকার কাজ করে এখন। কিন্তু পরীক্ষাটা কোথায় চালাব বুঝতে পারছি না।

কেন, তোমাদের বাড়ির আশেপাশে? রবিন বলল, ওখানে তো গুপ্তধন আছে বলে গুজব রয়েছে।

চেনা জায়গায় অনুসন্ধান চালাতে ভাল্লাগে না।

তা বটে, মাথা দোলাল রবিন, চেনা জায়গায় গুপ্তধন আছে, ভাবা যায়। না। গুপ্তধন শব্দটা শুনলেই মনে হয় অচেনা, ভয়ানক দুৰ্ম কোন জায়গা…

মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল, কিশোর কোথায় তোরা? একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে তোদের সঙ্গে।

অর্কশপ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর।

 জঞ্জালের স্তূপের পাশে মেরিচাচীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। কালো চুল, বাদামী উজ্জ্বল চোখে রাজ্যের উদ্বেগ। কিশোরকে দেখে এগিয়ে। এল, আমি ইভা গেনার। জিনার বন্ধু! ওর কাছে তোমাদের কথা শুনেছি।

চুপ করে রইল কিশোর। মেয়েটা কি বলে শোনার অপেক্ষা করছে।

রবিন আর মুসাও বেরিয়ে এল।

 মেরিচাচীর তাড়া আছে, চলে গেলেন।

 ইভা বলল, তোমাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি… জিনা বলল…

এসো, ভেতরে এসো, ওঅর্কশপের দরজা দেখাল কিশোর।

 ইভাকে ভেতরে নিয়ে এল সে। চারপাশে তাকাতে লাগল মেয়েটা। অবাক হলো না। তিন গোয়েন্দার ওঅর্কশপে কোথায় কি আছে জিনার কাছে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে।

একটা টুল দেখিয়ে ওকে বসতে বলল কিশোর।

বসল ইভা। কোন রকম ভূমিকার মধ্যে গেল না। বলল, একটা সাংঘাতিক বিপদে পড়েছি…তোমরা কি আমাকে সাহায্য করবে? বলেই কেঁদে ফেলল।

এ সব পরিস্থিতিতে বিব্রত বোধ করে কিশোর। কি করে কান্না থামাবে বুঝতে পারছে না। মুসা তাড়াতাড়ি ওর মেটাল ডিটেক্টরে হাত দিল। কেবল রবিন স্বাভাবিক রইল, শান্তকণ্ঠে বলল, কেঁদো না। কি হয়েছে, বলো, সাহায্য আমরা অবশ্যই করব।

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ডলল ইভা। ফোপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার মা-বাবা কেউ নেই। দুজনেই মরে গেছে।

এইবার থমকে গেল রবিন। কি করে সাহায্য করবে মেয়েটাকে? কারও বাবা-মা মরে গেলে তো আর এনে দেয়া যায় না।

সহানুভূতির সুরে কিশোর বলল, কেঁদে আর কি হবে? তোমার কষ্ট আমি খুব বুঝতে পারছি, আমিও তোমার মতই এতিম।

ওদের জন্যে কাঁদছি না আমি, আরেকবার চোখ ডলল ইভা। ওরা অনেক ছোটবেলায় মারা গেছে, চেহারাও ভালমত মনে নেই। কাঁদছি আমার ভাইয়ের জন্যে।

খাইছে! সে-ও কি মারা গেছে নাকি? ফস করে বলে ফেলেই পস্তাতে শুরু করল মুসা, এ ভাবে বলাটা বোকামি হয়ে গেছে।

মাথা নাড়ল ইভা, জানি না! ওকে খুঁজে বের করে দেয়ার জন্যেই এসেছি তোমাদের কাছে।

কি হয়েছে ওর? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

চোখের পানি মুছতে মুছতে ইভা বলল ওর ভাইয়ের নাম হ্যারিস গেনার। আরলিংটন কলেজের ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ইনস্ট্রাক্টর ছিল। হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গেছে। এবং আমি চাই তোমরা ওকে খুঁজে বের করো, অনুরোধের সুরে বলল সে। পুলিশকে জানিয়েছি। কিন্তু কিছুই করতে পারছে ওরা।

জানা গেল, আরলিঙটন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ইভা। স্প্রিঙ টার্ম সবে শেষ হয়েছে। ভেবেছিল গরমের ছুটিতে ভাইকে নিয়ে ওয়েস্ট কোস্টে। আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। এই সময় হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল ওর ভাই।

কি করব, বুঝতে পারছি না আমি, কিশোর, ককিয়ে উঠল ইভা। প্লীজ, কিছু একটা করো আমার জন্যে!

দুই সহকারীর মতামতের জন্যে ওদের দিকে তাকাল কিশোর।

ইভার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল রবিন, দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমার ভাই কিছুদিন আগে বিদেশে পলিটিক্যাল মেথড নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল, তাই না?

অবাক হলো ইভা, তুমি জানলে কি করে?

পত্রিকায় পড়েছি। তোমার ভাইয়ের নিরুদ্দেশের খবর ছাপা হয়েছে। ওখানেই লিখেছে কথাটা।

মাথা ঝাঁকাল ইভা। কোন দেশে পড়তে গিয়েছিল ওর ভাই, জানাল। দেশটার সঙ্গে আমেরিকার সদ্ভাব নেই। ওখানে থাকতে নাকি একদিন সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় খুব আঘাত পেয়েছিল হ্যারিস গেনার। দেশে ফেরার পর ওকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে, ইভা বলল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ছিল না। নিশ্চয় স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে দাদার। পথ ভুলে কোনদিকে চলে গেছে কে জানে।

ওই আঘাতের কারণে নষ্ট হয়েছে ভাবছ? প্রশ্ন করল কিশোর।

হ্যাঁ। ডাক্তারের কাছে শুনেছি এ ধরনের আঘাতের প্রতিক্রিয়া আঘাত পাওয়ার বেশ কিছুদিন পরেও হয়ে থাকে।

কিশোর, মুসা বলল, আমার মনে হয় কেসটা নিয়ে ফেলা উচিত আমাদের।

হাসল কিশোর। তা তো নেবই…

উজ্জ্বল হলো ইভার মুখ। কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে বলে উঠল, ওহ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ!…কেঁদেকেটে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড করে ফেলেছি, সরি!

না না, ঠিক আছে, ও কিছু না, তাড়াতাড়ি বলল রবিন। আর বিব্রত হতে চায় না।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, ইভা, তোমার ভাইয়ের কোন ছবি আছে তোমার কাছে?

হাতব্যাগ থেকে একটা ফটোগ্রাফ বের করে দিল ইভা। এই একটাই ছিল আমার কাছে, হাসল সে, হারালে আর পাব না। উঠে দাঁড়াল। তো, চলি আজ।

কোথায় থাকো, ঠিকানা দিয়ে যাও। তোমার সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন হতে পারে।

ইভা বেরিয়ে গেলে দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, যাক, অনেক দিন পর কেস একটা পাওয়া গেল।

তেমন জটিল কোন রহস্য বলে তো মনে হচ্ছে না, মুসা বলল। একজন মাথা খারাপ লোককে খুঁজে বের করতে হবে, ব্যস। এ আর এমন কি কঠিন।

পুলিশ যে রহস্যের সমাধান করতে পারেনি, ওটাকে এত সহজ ভাবছ কেন? বলা যায় না কি খুঁজতে গিয়ে কি বেরোয়।

তাহলে আরলিংটনে যাচ্ছি আমরা?

অবশ্যই। ইভাকে কথা দিয়ে দিলাম না আমরা। তুমিও তো বললে কাজটা নেয়া উচিত আমাদের।

তা তো বলেছি, কিন্তু আমার গুপ্তধন খোঁজার কি হবে? যন্ত্রটা কেনার পর ব্যবহারই করতে পারলাম না।

গাড়িতেই রেখে দাও, হেসে বলল রবিন। গুপ্তধন বাদ দিয়ে আপাতত মানুষ খুঁজতে কাজে লাগাবে।

মানুষের ব্যাপারে সঙ্কেত দেয় না। শুধু ধাতব জিনিস।

মানুষও অনেক ধাতুতে গড়া। আমাদের শরীরে কত রকমের ধাতু আছে, শুনতে চাও?

না, চাই নাওসব শুনতে এ মুহূর্তে ভাল লাগবে না আমার!

.

 পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা মুসার পুরানো জেলপি গাড়িটাতে করে। দ্রুত ছুটল সাগরতীরের রাস্তা ধরে।

রবিন বলল, তোমার এই ভটভটি নিয়ে তো বেরোলাম, শেষে রাস্তাঘাটে না আটকে পড়ি। চলবে তো?

চলবে না মানে! দেখতে খারাপ, আওয়াজও করে, কিন্তু কোনদিন কোথাও বিপদে ফেলেনি আমাকে, আদর করে স্টিয়ারিঙে হাত বোলাল মুসা।

ওর কথা ঠিক। এবারও ওদের ঝামেলায় ফেলল না গাড়িটা। ঠিকমতই পৌঁছে দিল আরলিংটনে। শহরে ঢোকার পর কিশোর বলল, ভালমত নজর রাখো। থাকার জায়গা দেখলেই থামতে হবে।

কয়েকটা মোটেল পেরিয়ে এল ওরা। কোনটাই পছন্দ হলো না। হয় বেশি দামী, নয়তো একেবারে সাধারণ। অত সাধারণ জায়গায় থাকতে ইচ্ছে করে না কিশোরের। ওর মতে ওগুলোতে থেকে কষ্ট করার চেয়ে বাইরে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানো অনেক আরামের!

অ্যাই, কিশোর, ওটা কেমন মনে হয়? হাত তুলে একটা সাইনবোর্ড দেখাল রবিন।

রিজ মোটেল, নাম লেখা রয়েছে। নিজেদের গুণকীর্তন সবিস্তারে লিখে রেখেছে নিচে।

মনে হয় খারাপ হবে না, কিশোর বলল। মুসা, ঘোরাও তো। যাও ওদিকে।

ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢোকাল মুসা। পাতার ছাউনি দেয়া একটা সুন্দর কটেজ দেখা গেল। সাইনবোর্ড লেখা রয়েছে: অফিস। বাঁয়ে লম্বা একটা নিচু একতলা বাড়ি। প্রতিটি ঘরের সামনে একটা করে পামগাছ লাগানো হয়েছে। ডানে রয়েছে একসারি কটেজ। মোট বারোটা, সব একই রকম দেখতে। অফিস বাড়িটার মত ওগুলোরও পাতার ছাউনি।

কোথায় উঠলে ভাল হয়? রবিনের প্রশ্ন। লম্বা বাড়িটাতে ঘর নেব, নাকি একটা কটেজ ভাড়া করব।

চলো, আগে দাম জিজ্ঞেস করে দেখি, কিশোর বলল। অফিসের দিকে যেতে বলল মুসাকে।

অফিসে ডেস্কের ওপাশে বসে থাকতে দেখা গেল মাঝবয়েসী এক লোককে। পুরো মাথা জুড়ে গোল টাক, কেবল কান আর ঘাড়ের ওপরে অল্প কিছু পাতলা ফুরফুরে চুল বাদে। টাকে হাত বুলিয়ে হাসি দিয়ে ছেলেদের স্বাগত জানাল সে, এসো এসো। বেড়াতে এসেছ? ছাত্র নিশ্চয়? বেড়াতে এলে ছাত্ররা এই মোটেল ছাড়া আর কোথাও ওঠে না।

প্রশ্নের জবাব দিয়ে মোটেলে রূম খালি আছে কিনা, ভাড়া কত জানতে চাইল কিশোর। একটা ঘরই খালি আছে, জানাল ম্যানেজার। রেজিস্টারে নাম সই করে, ক্লার্কের হাতে টাকা গুণে দিল কিশোর। ঘরের চাবি দিল ওকে লোকটা।

সাত নম্বর রূম। চাবি দিয়ে দরজা খুলে মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকল ওরা।

রবিন বলল, কিছু মানুষ আছে অতিরিক্ত কথা বলে, অহেতুক।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, তা ঠিক। দেখলে না কেমন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করছিল। কেন এসেছি আমরা। এটা যত কম লোকে জানবে, ততই ভাল।

ওদের কথায় কান দিল না মুসা, সুটকেস খুলতে খুলতে বলল, আমার খিদে পেয়েছে। তোয়ালে বের করে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সে।

হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় পরে, আবার বেরোল ওরা। দরজায় তালা দিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠল। মুসা বলল, রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি তো, নাকি?

হ্যাঁ, কিশোর বলল, আগে খাওয়া। তারপর থানায় যাব পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে।

হ্যারিস গেনারের ব্যাপারে কতটা জানে ওরা জানার জন্যে? রবিনের প্রশ্ন।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

খাওয়া সেরে নিয়ে থানায় রওনা হলো ওরা।

নতুন তৈরি একটা বিল্ডিঙের মাটির নিচে পুলিশ হেডকোয়ার্টার। ওপরটায় টাউন হল। পুলিশ চীফ অফিসে নেই, সুতরাং ডেস্ক সার্জেন্টের কাছে নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর। রকি বীচের পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচার তিন গোয়েন্দাকে একটা সার্টিফিকেট দিয়েছেন, শহরের বাইরে অন্য অঞ্চলে কাজ করতে গেলে সেটা দেখালে যাতে পুলিশ ওদের সহায়তা করে। সেটা দেখিয়ে সার্জেন্টের কাছে গেনারের কেসটার কথা জানতে চাইল কিশোর।

ও কিছু না, গুরুত্বই দিল না সার্জেন্ট, অন্যমনস্ক হয়ে কলেজ থেকে হেঁটে বেরিয়ে গায়েব হয়ে গেছে হ্যারিস গেনার। ওয়াল্ট ডিজনির অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর দেখোনি, ওরকম ব্যাপার আরকি।

কোন সূত্র পাওয়া যায়নি? জিজ্ঞেস করল রবিন।

 না, কিছুই না। আশা করছি দুচারদিনের মধ্যেই ওর খবর পাব। সামনে ঝুঁকল সার্জেন্ট, একটা গোপন কথা বলি তোমাদের, আমার ধারণা লোকটা পাগল। অতিরিক্ত মাথা ঘামিয়ে অনেক বিজ্ঞানী আছে না পাগল হয়ে যায়, মগজে চাপ পড়ে বলে, এরও হয়েছে ওরকম।

মন্তব্য করল না গোয়েন্দারা। চুপচাপ বেরিয়ে এল থানা থেকে। বাইরে বেরিয়েই ফুঁসে উঠল মুসা, এই সার্জেন্ট নোকটাও পাগল! জ্ঞান দিতে আসে!

 জ্ঞান আর উপদেশ বিতরণ করা অনেক মানুষের স্বভাব, কি আর করা, আনমনে মাথা চুলকাল কিশোর।

এরপর কলেজের ডিনের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল সে।

কলেজটা কোথায় একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল মুসা। গাড়ি চালাল সেদিকে। শহরের একধারে ছোট্ট একটুকরো বনের মাঝে কলেজটা। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিঙের সামনে এনে গাড়ি রাখল সে।

একসঙ্গে সবার যাওয়ার দরকার নেই। গাড়িতে বসে রইল মূসা। কিশোর আর রবিন নেমে মার্বেল পাথরে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। একটা হলওয়েতে ঢুকল।

ডিনের অফিসটা খুঁজে পেতে দেরি হলো না। দরজার গায়ে লেখা রয়েছে:

DEAN WALTER FOLLETT.

ডিনের ঘরে ঢুকতে হলে অনুমতি নিতে হয়। একজন রিসেপশনিস্টকে বুঝিয়ে বলল কিশোর, জরুরী কারণে দেখা করতে এসেছে ওরা। ব্যাপারটা গোপনীয়। সবাইকে বলা যাবে না, কেবল ডিনকেই বলবে।

অনুমতি মিলল। ওদেরকে ডিনের অফিসে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে ফিরে গেল রিসেপশনিস্ট।

বড় ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন লম্বা একজন মানুষ, ঝাঁকড়া চুল বয়সের কারণে ধূসর হয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার ফলেট। হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দন হয়ে গেলে বললেন, বসো। কি নাকি গোপন কথা আছে আমার সঙ্গে? বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে।

ডেস্কের অন্যপাশে ডিনের মুখোমুখি বসল তিন গোয়েন্দা।

 হ্যারিস গেনারকে খুঁজতে এসেছে, জানাল কিশোর।

ভাল করেছ, ডিন বললেন, আমরা সবাই তাকে খুঁজছি। তা তোমরা কে, তাই তো জানা হলো না।

পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে দিল কিশোর।

হাতে নিয়ে দেখলেন ফলেট। তারপর কার্ডটা টেবিলে রেখে দিয়ে। বললেন, বুঝলাম। হ্যাঁ, তা আমার কাছে কি জানতে চাও, বলো?

হ্যারিস গেনারের নিরুদ্দেশের ব্যাপারে যতটা জানাতে পারেন।

আশা করি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জেনে যাবে তোমরা শিগগিরই, গোয়েন্দা যখন। আনমনে মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলেন তিনি, অদ্ভুত! ভারি অদ্ভুত!

কি? জানতে চাইল কিশোর।

ওই তো, যেভাবে গায়েব হয়ে গেল গেনার। কি করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন লেকচারার, জানালেন ফলেট। পরদিন নাকি ছেলেদের পরীক্ষা ছিল, এর জন্যে প্রশ্নপত্রও তৈরি করেছেন গেনার। তারপর রহস্যজনক ভাবে সেটা ডেস্কের ওপর ফেলে রেখে রাতের বেলা কোথায় চলে গেছেন।

পরদিন সকালে কাগজগুলো পাওয়া গেছে, ডিন বললেন। পেয়েছে। ওরই একজন সহকারী। সেই সব প্রশ্ন ছেপে পরীক্ষাও নেয়া হয়েছে। ছেলেদের।

অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে একটা পেন্সিল তুলে নিয়ে ডেস্কে ঠুকতে লাগলেন তিনি। কিন্তু সেই যে গেল, আর ফিরে এল না গেনার। ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত!

সহকারীর নাম কি, যিনি কাগজগুলো পেয়েছেন? জানতে চাইল রবিন। বলতে অসুবিধে আছে?

প্রশ্নটায় অবাক হলেন যেন ডিন। একটা ভুরু সামান্য উঁচু হলো। না, অসুবিধে থাকবে কেন? ওর নাম মেরিন ডিগ। গেনারের সহকারী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। একই কথা খেলে গেল দুজনের মনে, মেরিন ডিগের সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ও-কে, বয়েজ, আর কিছু বলার নেই আমার, যা যা জানি, বলেছি, উঠে দাঁড়ালেন ডিন। আমার ধারণা, মাথায় কোন গোলমাল দেখা দিয়েছে গেনারের। স্মৃতিবিভ্রমও ঘটে থাকতে পারে।

মিস্টার ডিগের সঙ্গে দেখা করতে চাই আমরা, অনুরোধ করল কিশোর, আপনি কি কোন সাহায্য করতে পারেন? আর, মিস্টার গেনারের ঘরটাও একবার দেখতে চাই।

একটা কাগজে ঠিকানা লিখে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলেন ফলেট। জানালার কাছে গিয়ে হাতের ইশারায় কিশোরকে ডাকলেন। মাঠের শেষধারে কতগুলো বাড়ি দেখিয়ে বললেন, বড় বিল্ডিঙটাতে গ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা থাকে। আর তার ওপাশের ছোট ছোট বাড়িগুলোতে ইনস্ট্রাক্টর আর লেকচারাররা।

ডিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল দুজনে। গাড়িতে উঠে মুসাকে বলল, মাঠের ধারের বাড়িগুলোর কাছে নিয়ে যেতে।

.

গাড়ি চালাল মুসা। ডিনের কাছে কি জেনে এসেছে, সব জানাল ওকে রবিন আর কিশোর। পথে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে দেখা গেল-সামার সেশনের জন্যে নাম রেজিস্ট্রি করতে এসেছে।

বাড়িটা থেকে খানিক দূরে গাড়ি রেখে বসে রইল মুসা। কিশোর আর রবিন নেমে গেল আগেরবারের মত। সামনে বেটেমত এক লোক হেঁটে যাচ্ছে। বয়েসে তরুণ। ওকে চোখে পড়ে যায় তার কারণ গাঢ় রঙের জ্যাকেট গায়ে দিয়েছে, আর হাস্যকর ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। দ্রুত হেঁটে ওর পাশকাটিয়ে এল দুজনে।

পাশ কাটানোর সময় রবিনের গায়ে আলতো খোঁচা দিল কিশোর। ইঙ্গিত করল লোকটার দিকে। একবার পেছনে ফিরে তাকানোর কৌতূহল সামলাতে পারল না রবিন। গোলগাল, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা লোকটার।

বাড়িটাতে পৌঁছে ১৭ নম্বর রূম খুঁজে বের করুন কিশোর। দরজার পাশে বসানো কলিং বেলের সুইচ টিপল। কান পেতে রইল ভেতরের শব্দ শোনার আশায়। নেই, কোন শব্দ নেই। আবার বেল টেপার জন্যে হাত বাড়াল কিশোর, এই সময় পেছন থেকে বলে উঠল একটা হাসিখুশি কণ্ঠ, আমাকে খুঁজছ?

চমকে গিয়ে ঘুরে তাকাল কিশোর আর রবিন। সেই লোকটা।

মেরিন ডিগ? আপনা থেকেই প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল কিশোরের মুখ থেকে।

হ্যাঁ। কি সাহায্য করতে পারি?

নিজের আর রবিনের পরিচয় দিল কিশোর।

দরজা খুলে ওদেরকে নিজের ঘরে নিয়ে এল ডিগ।

কেন এসেছে, জানাল কিশোর। হারিস গেনার সম্পর্কে যা যা জেনেছে, ভিগকে জানিয়ে জিজ্ঞেসকরুল সে এর বেশি আর কিছু জানে কিনা।

জানি, জবাব দিল ডিগ, তবে পুলিশের ধারণা, ওগুলো জরুরী কোন বিষয় নয়।

কি জানেন? আগ্রহে সামনেকে এল রবিন।

দাঁড়াও, বলছি, ওদের বসতে বলে একটা চেয়ার টেনে এনে মুখোমুখি কুসল ভিগ। খুব শীঘ্রি বিয়ে করতে যাচ্ছে হারিস, এই খবরটা কি জানো তোমরা?

অবাক হলো দুজনেই। মাথা নাড়ল।

ডিগ জানাল, ইয়োরোপের যে দেশটায় লেখাপড়া করতে গিয়েছিল গেনার, ওখানে একটা মেয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠত হয়। ওই মেয়েটাকেই নাকি বিয়ে করবে সে। যেহেতু দেশটার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভাল না, ওই দেশের মেয়েকে বিয়ে করার কথা তার বোনকেও বলতে অস্বস্তি বোধ করেছে গেনার।

তারমানে আপনি বলতে চান স্মৃতি হারানো কি পাগল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক না? জিজ্ঞেসকরুল কিশোর।

মাথা নাড়ল ডিগ, একেবারেই না।

এটা অবশ্য নতুন তথ্য; তবে এর বেশি আর কিছু জানাতে পারল না। ডিগ। গেনারের সুরটা দেখিয়ে দেয়ার জন্যে ওকে অনুরোধ করল কিশোর।

এসো, উঠে দাঁড়াল ডিগ, এই তো, পাশের ঘরটাই।

গেনারের ঘরের চাবি আছে তার কাছে। খুলে দিল। দুই গোয়েন্দার সঙ্গে ভেতরে ঢুকে বলল, দেখেছ, কি রকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন? সব ঠিকঠাক। বোঝাই যায় না পালানোর প্ল্যান করছিল গেনার। আমিও কিছু বুঝতে পারিনি।

কিন্তু বিয়ে করার জন্যে একটা লোক পালাবে কেন, এটাও তো মাথায় ঢুকছেনা, রবিন বলল।

আমার মাথায়ও না।

এগুলো কি? টেবিলে হাত রেখে কুঁকে দাঁড়িয়ে কতগুলো কাগজের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। আপনি বলতে পারবেন?

অবশ্যই পারব। পরীক্ষার প্রশ্ন। নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে এগুলো তৈরি করেছিল গোনার…

কিশোর আর রবিন মিলে পুরো ঘরটা তন্নতন্ন করে খুঁজল। সঙ্গে সঙ্গে থেকে চিলের নজর রাখল ডিগ, তার সামনে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল ওরা। কিন্তু লোকটাকে সরানোর কোন ছুতো বের করতে পারল না। অগত্যা ওর সামনেই খুঁজতে হলো। কোন সূত্র পেল না। পাওয়ার আশাও অবশ্য করেনি, কারণ এর আগে পুলিশ এসে খুঁজে গেছে।

থ্যাংক ইউ, কিশোর কলল, এখন যাই। সময় করে আবার আসব। আরেকবার খুঁজে দেখব ঘরটা।

যখন খুশি এসো, নির্দ্বিধায় স্বাগত জানাল ডিগ। এক কাজ করো না বরং, আমার এখানেই থেকে যাও। আলাদা বিছানা আছে, থাকার অসুবিধে হবে না।

হেসে মাথা নেড়ে বলল কিশোর, না, না, ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। লোক বেশি আমরা, সঙ্গে আরও একজন আছে। যাই। পরে আসব।

 গাড়িতে ফিরে এল ওরা। উদিত হয়ে অপেক্ষা করছে মুসা, ওরা কি খবর আনো শোনার জন্যে। যা জানল, তাতে তেমন খুশি হতে পারল না। তদন্তের অগ্রগতি হয়নি প্রায় কিছুই। এখনও এমন কোন জরুরী সূত্র পায়নি যেটা গেনারকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।

মোটেলে ফিরে চলল ওরা।

হঠাৎ জিজ্ঞেস করল রবিন, ডিগলোকটাকে কেমন মনে হলো তোমার?

উ। চিন্তিত ভঙ্গিতে ফিরে তাকাল কিশোর, কি জানি, ঠিক বুঝতে পারছি না।

আজব চরিত্র মনে হয়নি?

আজব কিনা জানি না, তবে হাঁটার ভঙ্গি দেখলে ভাঁড় বলবে ওকে লোকে, আবার চিন্তায় ডুবে গেল কিশোর।

ঘরে যাওয়ার আগে কোথাও কিছু খেয়ে নিলে হয় না? গাড়ি চালাতে চালাতে আচমকা প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল মুসা।

তা যায়, রাজি হলো কিশোর।

রবিন বলল, আমারও খিদে পেয়েছে।

একটা ফার্স্টফুড শপ থেকে হালকা খাবার খেয়ে নিল ওরা। ফিরে এল মোটেলে। ঘরের দরজা খুলেই থমকে দাঁড়াল কিশোর। দুজন বয়স্ক মানুষ বসে আছে–একজন পুরুষ, আরেকজন মহিলা। লোকটা খবরের কাগজ পড়ছে, মহিলা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।

মাফ করবেন, ভদ্রকণ্ঠে রবিন বলল, আপনারা বোধহয় ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছেন।

হ্যাঁ, এটা আমরা ভাড়া নিয়েছি, বলল কিশোর। সাত নম্বর।

ফিরে তাকিয়ে হাসল মহিলা, তোমরা নিশ্চয় তিন গোয়েন্দা? তোমাদের মালপত্র বের করে নিয়ে গেছে ম্যানেজার। অসুবিধে নেই, সব পাবে ওর কাছে।

কেন, নেবে কেন? কিশোর অবাক। আমরা এটা ভাড়া নিয়েছি। রেজিস্টারে নাম সই করে চব্বিশ ঘণ্টার ভাড়াও অগ্রিম দিয়েছি।

বলেই বুঝল, এদেরকে, প্রশ্ন করে লাভ নেই, ঠিকও হবে না, কারণ দোষটা এদের নয়। যা করার ম্যানেজার করেছে। চাবি না দিলে এরা খুলতে পারত না। নিশ্চয় কোন গোলমাল হয়েছে, কিছু একটা ঘটেছে, নাহলে ম্যানেজারও এ রকম করত না। কি ঘটল?

জানার জন্যে উত্তেজিত হয়ে ম্যানেজারের অফিসে ছুটল তিন গোয়েন্দা।

ওদের দেখে চওড়া হাসি হাসল টেকো লোকটা। এসো, এসো, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি আমি। মালপত্র তোমাদের ঘরে পৌঁছে গেছে। ভাল জায়গা পছন্দ করেছ। আগেই বলেছিলাম, কটেজ নাও…তুবে আগে সাধারণ রূমটা দেখে নিয়ে ভালই করেছ, নিজেরা বুঝে নিয়েছ, আমি চাপাচাপি করলে। ভাবতে জোর করে গছাতে চাইছি…

মানে? অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।

যা করতে বলেছ তাই করেছি। তোমাদের মেসেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কটেজ ঠিক করে, রূম থেকে তোমাদের মালপত্র বের করে এনে ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি, টাকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ম্যানেজার। যাও, সব ঠিকঠাক পাবে। একটা জিনিসও খোয়া যাবে না। এ সব দিকে আমার কড়া নজর। ম্যানেজারি করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললাম…

টাকমাথা লোকটার মুখে চুল পাকানোর কথা শুনতে কেমন হাস্যকর লাগল। মুসার তো শুধরেই দিতে ইচ্ছে করল–বরং বলুন, চুল খসিয়ে ফেললাম; কিন্তু বলল না কিছু, চুপ করে রইল।

বোকা হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল তিনজনে। কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

বকবক করে চলেছে ম্যানেজার, কটেজ, নিয়ে ভাল করেছ। আরামে থাকবে, শান্তিতে থাকবে, রুমের চেয়ে ভাড়াও তেমন বেশি না, অথচ দুটো জায়গায় পার্থক্যটা অনেক। যে তিনজন বন্ধুকে পাঠালে তোমরা, ওরা এসে মেসেজটা দিয়ে বলল, আগের ঘরটা পছন্দ হয়নি তোমাদের, নিরিবিলি থাকতে চাও, একটা কটেজ যেন রেডি করে রাখি আমি। তা রেখেছি। তোমাদের আসতে দেরি হবে জেনেও একমুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। বোর্ডাররা বিরক্ত হয় এমন কোন কাজ আমাকে দিয়ে হবে না…

তা কটেজটা কোথায়? কিছুটা রেগে গিয়েই জানতে চাইল মুসা।

ওর রাগটা বোধহয় ধরতে পারল না ম্যানেজার। হাত তুলে ছোট ছোট বাড়িগুলো দেখিয়ে বলল, অসুবিধে নেই, খুব সুন্দর, গিয়ে দেখোই না…

আবার ছুটল তিন গোয়েন্দা। কটেজের কাছে এসে জানালা দিয়ে দেখল ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে গাট্টাগোট্টা এক তরুণ, ওদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই রেগে চিৎকার করে উঠল মুসা, এ সবের অর্থ কি?

ঘুরে দাঁড়াল তরুণ। কালো একটা মুখোশে মুখের ওপরের অংশ ঢাকা, বড় বড় ফুটো দিয়ে চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা বড় আলমারির দরজা। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আরও চারটে মুখোশধারী ছেলে।

আরি, হচ্ছেটা কি! কে আপনারা? চিৎকার করে উঠল রবিন।

তার কথার জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করল না ছেলেগুলো। তিনজনকে মেঝেতে ফেলে চেপে ধরে বেধে ফেলল। বয়ে এনে তুলল একটা গাড়িতে। মোটেল থেকে বেরিয়ে মহাসড়ক ধরে কয়েক মাইল এগোল গাড়িটা। তারপর মোড় নিয়ে একটা সরু রাস্তায় নামল। সেটা ধরে মাইলখানেক এগোতে দেখা গেল রেললাইন।

তিন গোয়েন্দাকে বয়ে আনা হলো লাইনের ধারে। ছোট ছোট ঝোপঝাড় জন্মে আছে ওখানে। ওগুলোর জন্যে রাস্তা থেকে লাইনটা ভালমত চোখে পড়ে না। তিনটে তক্তায় ওদেরকে চিত করে বেঁধে ওগুলো লাইনের ওপর আড়াআড়ি ফেলে চলে গেল ছেলেগুলো।

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। রাতের অন্ধকার। এগিয়ে আসছে। ছেলেগুলো সরে যেতেই বাধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল তিন গোয়েন্দা। টানাটানি করতে করতে ঘেমে গেল, কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ঘাম। কিন্তু বাধন ঢিল করতে পারল না একচুল।

ঠিক এই সময় কলজে কাঁপিয়ে দিয়ে দূরে শোনা গেল রেলইঞ্জিনের বাঁশি।

.

মাথা ঘুরিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিনজনে। প্রাণপণে আরেকবার বাধন খোলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। আর কোন আশা নেই। কপালে মৃত্যুই আছে বুঝি এবার।

এগিয়ে আসছে ইঞ্জিনের ভারি শব্দ। ওদের ধ্বংস করে দিতে ছুটে আসছে যেন এক ভয়াল দানব। আতঙ্কে অবশ হয়ে আসছে হাত-পা।

এসে গেছে। আর একশো গজ দূরেও নেই। শেষবারের মত পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। যেন নীরবে শেষ বিদায় জানাল একে অন্যকে।

এসে গেল ইঞ্জিন। তারপর যেন কোন অলৌকিক কারণে ওদের গায়ের ওপর দিয়ে না গিয়ে কানফাটা ভয়ানক শব্দ আর প্রবল কম্পন তুলে পাশ দিয়ে। চলে গেল। বেঁচে আছে, বিশ্বাস হতে চাইল না ওদের। কি করে ঘটল ঘটনাটা? ঘটারং-ঘট ঘটারং-ঘট করে এখনও পার হচ্ছে একের পর এক মালবাহী ওয়্যাগন।

থরথর করে কাঁপছে শরীর। বেঁচে গেছে এটা যখন বিশ্বাস হলো মুসার, বাঁধন খোলার চেষ্টা চালাল আবার সে। বড় ধাক্কাটা কেটেছে, ওদেরকে লাইনের ওপর ফেলে রেখে যাওয়ার পর এই প্রথম মাথাটা আবার ঠিকমত কাজ করতে আরম্ভ করেছে। আড়চোখে অস্পষ্টভাবে দেখল লাইনের একটা মোটা পেরেকের চোখা মাখা বেরিয়ে আছে। শরীরটা আঁকাবাকা করে ঝাঁকাতে লাগল সে। তিল তিল করে ওর মাথার দিকটা এগিয়ে চলল পেরেকের দিকে। অনেক কষ্ট করে, লাইন আর পাথরের ঘষায় শরীরের কয়েক জায়গার চামড়া ছিঁড়ে-কেটে অবশেষে হাতের বাঁধন পেরেকটার কাছে নিয়ে যেতে পারল। দড়ি ঘষতে লাগল পেরেকের সঙ্গে। এক সুতা এক সুতা করে কাটতে লাগল দড়িটা।

আবার শোনা গেল ট্রেনের শব্দ। আরেকটা ট্রেন আসছে। একবার বেঁচেছে বলেই যে আবার বাচবে এমন সম্ভাবনা নেই। তাড়াহুড়া শুরু করল। সে। অবশেষে যেন দীর্ঘ কয়েক যুগ পর দড়িটা কাটতে সক্ষম হলো।

দড়িটা ছাড়িয়ে নিয়েই উঠে পড়ল সে। পকেটনাইফ বের করে পায়ের বাঁধন কাটল। তারপর কেটে দিল কিশোরের হাতের বাঁধন।

তিনজনেই মুক্ত হয়ে সরে গেল লাইনের ওপর থেকে। অনেক কাছে এসে গেছে দ্বিতীয় ট্রেনটা।

 বিমূঢ় ভাব কাটেনি এখনও রবিনের। কব্জি ডলতে ডলতে বলল, এপারে আছি তো? না মরণের ওপারে চলে গিয়ে অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখছি?

চলে যেতাম, যদি পাশের লাইনটা দিয়ে না যেত ট্রেনটা, কিশোর বলল। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্যে হাত-পা ঝাড়ছে।

চাঁদের আলোয় চকচক করছে কয়েক গজ দূরের আরেকটা লাইন। সেদিকে তাকিয়ে তারপর আবার ওদের পায়ের কাছের লাইনটার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল সে, দেখো, এটায় মরচে পড়া।

তাতে কি? মুসার প্রশ্ন।

 এটা সাইডলাইন, জবাব দিল কিশোর, পুরানো। ব্যবহার হয় না।

তারমানে আমাদের ভাগ্যের জোরে ওরা ভুল করে বাতিল লাইনে ফেলে গেছে আমাদের।

আমার তা মনে হয় না, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কিশোর, জেনেশুনে ইচ্ছে করেই ফেলে গেছে। হয়তো কেবল ভয় দেখানোর জন্যে। মারতে চায়নি।

 দাঁতে দাঁত চাপল মুসা, কায়দা মত পেয়ে নিই! ভয় দেখানো ওদের আমি বের করব!

পাঁচজনের সঙ্গে পারব না আমরা, মুসা, মনে করিয়ে দিল রবিন।

সে দেখা যাবে। ওরা আমাদের সঙ্গে এ রকম করতেই থাকবে আর আমরা মুখ বুজে সহ্য করব, কিছুই না করে ছেড়ে দেব, এটা ভাবলে মহাভুল করবে ওরা।

 কি করবে তাহলে?

আপাতত মোটেলে ফিরে যাব, জবাব দিল কিশোর।

লাইন ধরে কয়েক মিনিট হাটার পর সরু রাস্তাটা চোখে পড়ল ওদের। সেটা ধরে এগিয়ে এসে উঠল মহাসড়কে। রাতের বেলা জোয়ান ছেলেছোকরা হাত তুললে গাড়িগুলো থামতে চায় না। সবাই বা ডাকাতিকে ভয় পায়। তবে একজন ট্রাক ড্রাইভারের মনে হলো, ছেলেগুলো খারাপ নয়। থামল সে। কোথায় যাবে জানতে চাইল। লিফট দিতে রাজি হলো।

ড্রাইভারের পাশে গাদাগাদি করে বসল তিনজনে। মুসার পাশের দরজাটা খোলা রাখতে হলো, নইলে বসা যায় না। তার অর্ধেকটা শরীরই বেরিয়ে রইল।

ড্রাইভার যখন গাড়ি চালাচ্ছে, নিচুস্বরে কিশোরের সঙ্গে কথা বলল রবিন, আচ্ছা, ওরা কোন ভুল করেনি তো? ভুল করে আমাদের শাস্তি দিয়েছে হয়তো। স্কুলের দলাদলি হতে পারে।

ভ্রূকুটি করল কিশোর। অন্ধকারে কারও চোখে পড়ল না সেটা। বলল, উঁহু, ভুল ওরা করেনি। ভয় দেখাতে চেয়েছে আমাদের, যাতে গেনারকে খোঁজাখুঁজি না করে আরলিংটন থেকে কেটে পড়ি আমরা।

তারমানে তোমার ধারণা গেনারকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?

হওয়াটা কি অসম্ভব? হয়নি যে তেমন কোন সূত্র তো এখনও পাইনি আমরা।

ওদের আলোচনায় যোগ দিল না ড্রাইভার। বেশি কথা বলার মানুষ না সে। নীরবে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছল আরলিংটনে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। সোজা রওনা হলো ম্যানেজারের অফিসে।

টেকোকে ভালমত চেপে ধরার সময় হয়েছে এখন, ভারি গলায় বলল কিশোর। আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে ওকে।

দরজা বন্ধ। বেল টিপে ধরল কিশোর। কয়েকবার করে টেপার পর আলো জ্বলল ভেতরে। দরজা খুলে দিল ম্যানেজার। ঘুমে জড়ানো ফোলা ফোলা চোখ, চকচকে টাক, পায়জামা আর গেঞ্জি পরা পৈটমোটা লোকটাকে হাস্যকর লাগছে এখন। মেজাজ খারাপ না থাকলে হেসে ফেলত মুসা।

রাত দুপুরে ঘুমন্ত মানুষকে বিছানা থেকে টেনে তোলার অর্থ কি, আঁ? কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করল ম্যানেজার। অফিসের চেয়ারে বসা বিগলিত হাসিওয়ালা সেই লোকটার সঙ্গে একে মেলানো যায় না। যেই মনে করেছে, ওরা কটেজ ছেড়ে দিচ্ছে, ওদের সঙ্গে ব্যবসা শেষ, অমনি বদলে গেছে আচরণ। মোটেল ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন কিছু করতে পারব না।

আর কিছু না পারেন, আমার কিছু প্রশ্নের জবাব আপনাকে দিতে হবেই, কিশোরও সমান তেজে বলল আমাদেকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ারই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

থমকে গেল ম্যানেজার। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল ঘরে ঢোকার জন্যে। সব শোনার পর বলল, ছেলেগুলোকে চিনতে পেরেছে। আরলিঙটন কলেজে পড়ে। এই এলাকারই ছেলে খুব পজি মারামারি, দলাদলি এ সূৰ্ব করে বেড়ায়।

মনে হয় নতুন মুখ দেখে তোমাদের সঙ্গে একটু মজা করতে চেয়েছিল ওরা, ম্যানেজার বলল।

মনে করা ওদের বের করব এবার গজগজ করতে লাগল মুসা।

পুলিশকে খবর দিতে যাচ্ছি আমরা, কিশোর কাল। নাম কি ওদের? কোথায় থাকে?

সুব্রার নাম জানে না ম্যানেজার। দুতিনজনের জানে, ওদের নাম আর ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিল। পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে একটা বাড়িতে ঢু মেরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। মুসাকে বলল সেদিকে যেতে। নীরব রাতে বিকট শব্দ তুলে ছুটল জেলপি। পর্ব আকাশে অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। ভোর হতে দেরি নেই।

বাড়ির সামনে এসে আগের মতই গাড়িতে বসে রইল মুসা, রবিন আর কিশোর নেমে গেল। কলিং বেলের বোতাম টিপল কিশোর। সাড়া না পেয়ে দরজায় থাবা মারতে লাগল রবিন।

অবশেষে দরজা খুলে দিল পায়জামা পরা একটা ছেলে। খালি পা। ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলল, মাঝরাতে এত ডাকাডাকি কিসের? আমরা তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না।বলে দরজা লাগিয়ে দিতে গেল।

চট করে একটা পা ঢুকিয়ে দিয়ে আটকাল কিশোর, মজা করতে আসিনি আমরা। বব বোম্যান কোথায়?

বড় করে হাই তুলল ছেলেটা, ওকে জাগানো যাবে না।

যাবে না কেন? কিশোরের কাঁধের কাছ থেকে বলে উঠল মুসা, গাড়িতে বসে থাকতে পারেনি, কি ঘটছে এখানে দেখার জন্যে চলে এসেছে। জোরেজোরে ধাক্কা দাওগে, জেগে যাবে।

কিন্তু তোমরা বুঝতে পারছ না, ও আমাদের প্রেসিডেন্ট…

কিশোরকে সরিয়ে তার জায়গায় চলে এল মুসা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নাকি ও? যাও, জুলদি গিয়ে উঠতে বলো নাকি থানায় যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে?

ভেতরে চলে গেল ছেলেটা। উত্তেজিত কথা আর ধমক শোনা গেল। বেরিয়ে এল গাট্টাগোট্টা আরেকটা ছেলে। পরনে লাল-সাদা স্ট্রাইপের পায়জামা। তিন গোয়েন্দার ওপর চোখ পড়তেই থমকে গেল। দুচোখে বিস্ময়।

তোমরা…

ওকে কথা শেষ করতে দিল না মুসা, বলল, হ্যাঁ, আমরা। নরক থেকে প্রেতাত্ম হয়ে বেরিয়ে এসেছি তোমার চোয়ালের হাড্ডি কখান ভাঙার জন্যে। আরও কাছে এসো, কোনখান থেকে শুরু করা যায় বুঝে দেখি..

ওর কাঁধে হাত রেখে বাধা দিল কিশোর, দাঁড়াও, পেটে কি কি কথা লুকিয়ে আছে, আগে বের করি, তারপতেমাকে একটা চান্স দেয়া যাবে…

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে আরও এক পা এগিয়ে এল বব। কি করবে বুঝতে পারছে না।

ওর দিকে এগিয়ে গেল কিশোর। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, রেললাইনের ওপর আমাদের ফেলে আসার মানেটা কি? মোটেলে আমাদের ঘর থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করেছ কেন?

এমন ভঙ্গি করছ তোমর, যেন আমি তোমাদের শত্রু, ছেলেটা বলল। একটু পরখ করতে চেয়েছিলাম, যে যাচাই করে নেয়া, আর কিছু তো না। এত রাগীর কি হলো?

রেললাইনের ওপর ফেলে এসেছ মরার জন্যে, আর বলছ যে যাচাই? মানেটা কি এসবের?

মারার জন্যে ফেলে আসিনি, বব বলল, যেটাতে রেখে এসেছিলাম, ওটা বাতিল লাইন, ট্রেন চলাচল করে না। তারপরেও আড়াল থেকে নজর রেখেছিলাম, বাই চান্স যদি কোন বিপদ ঘটে যায় সাহায্য করার জন্যে। দেখলাম, তোমরা নিজেরাই নিজেদের জন্যে যথেষ্ট, সাহায্যের কোন প্রয়োজনই নেই। তোমরা আরলিংটনে ভর্তি হতে এসেছ, তাই না?

না, জবাব দিল রবিন।

আমাদের কি পরখ করছিলে? আবার প্রশ্ন করল কিশোর। কার হুকুমে?

প্রশ্নটা দ্বিধায় ফেলে দিল ববকে পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। ফিরে তাকাল সে। এই অসময়ে কার সঙ্গে কথা বলছে দেখার জন্যে আরও কয়েকটা ছেলে নেমে আসছে দোতলা থেকে।

 কিশোরের দিকে ফিরল বব, এর জবাব তোমাকে দিতে পারব না আমি।

যদি কথা দিই, মুখ খুলব না? কাউকে বলব না ওর কথা?

কিশোরের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বব বলল, আমরা ভেবেছি তোমরা লায়ন কাবসে যোগ দিতে এসেছ, কসম—

লায়ন কাবসটা কি?

আমাদের তরুণদের একটা সংঘঠন। তোমাদের পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলাম। আমরা ভেবেছি তোমরা আরলিঙটনে ভর্তি হবে, তাই আগে থাকতেই আমাদের দলে টানতে চেয়েছি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত ববের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ওর মনে হলো সত্যি কথাই বলছে ছেলেটা। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার হাতের সুখ মেটাতে পারলে না, মুসা। অন্য সময় দেখা যাবে। চলো এখন, যাই।

সারারাত ঘুমায়নি, তার ওপর নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর পরিশ্রম, ঘুমে ভেঙে আসতে চাইছে চোখ। তবু মোটেলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আরও খাকিটা তদন্ত সেরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর।

বাইরে এসে সঙ্গীদের বলল, ডিগ ঘুম থেকে ওঠার আগেই গেনারের ঘরটা আরেকবার দেখব, চলো।

হাতঘড়ি দেখল রবিন, ছটা বাজে। এত সকালে নিশ্চয় ঘুম থেকে ওঠেনি ডিগ। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, চলো।

গেনারের কোয়ার্টারের দিকে রওনা হলো ওরা। পথে কয়েকটা দুধের গাড়ি আর একজন খবরের কাগজের হকারকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না। এত ভোরে অন্য কেউ নেই রাস্তায়। কলেজের কোয়ার্টার গুলোতেও প্রাণের সাড়া নেই, ঘুমন্ত।

কোয়ার্টারের সামনে এসে আগের মতই গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল মুসা। কিশোর আর রবিন নেমে গেল।

সোজা গেনারের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। পকেট থেকে মাস্টার কী বের করে তালা খুলতে একটা মিনিটও লাগল না তার। রবিনকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল। ডিগ যে পাশে থাকে সেপাশের দেয়ালে কান ঠেকিয়ে শুনল। নীরব।

এখনও স্বপ্নের জগতেই আছে, ফিসফিস করে রবিনকে বলল সে।

কি দেখতে এসেছ?

 জানি না। এসো, খুঁজি।

বাতি জ্বালতে হলো না। সামনের দুটো জানালা দিয়ে দিনের আলো ঢুকছে। এখনও অস্পষ্ট, তবে ঘরের জিনিসপত্র সব দেখা যায়। রবিনকে আসবাবগুলো পরীক্ষা করতে বলে নিজে ডেস্কে রাখা নোট আর বইগুলো দেখতে এগোল কিশোর।

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও নতুন কিছু পেল না ওরা, গেনারের কি হয়েছে বা ও কোথায় গেছে এ ব্যাপারে সামান্যতম সুত্র পাওয়া গেল না।

পুলিশ এত করে খুঁজে যাওয়ার পর আর কিছু পাওয়ার কথাও না, হাল ছেড়ে দিয়ে বলল রবিন। আসলে কি খুজছ তুমি, কিশোর?

জবাব না দিয়ে একটা প্রশ্নপত্রের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ঘনঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। গভীর মনোযোগ। কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চেহারা।

এগিয়ে গেল রবিন। কিছু পেয়েছ মনে হচ্ছে?

 দেখো এটা! উত্তেজনায় গলা কেঁপে উঠল কিশোরের।

.

ওর কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রবিন। কই, কি আছে এতে? কয়েকটা প্রশ্ন ছাড়া তো আর কিছু দেখছি না।

হ্যাঁ, এই প্রশ্নগুলোর মধ্যেই রয়েছে একটা জরুরী সূত্র, কিশোর বলল।

আমি কিছুই দেখছি না।

প্রথম প্রশ্নটা দেখো…

দেখলাম। রাশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আমার।

আমারও না। পরের প্রশ্নটা দেখো।

আফ্রিকায় কি ঘটছে..তাতেই বা আমার কি?

আমারও না, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল কিশোর। রবিন বুঝতে পারছে না দেখে মজা পাচ্ছে সে।

দেখো, কিশোর, অধৈর্য হয়ে বলল রবিন, দোহাই তোমার, যা বুঝেছ, বলে ফেলো! না বোঝালে বুঝব না!

মোট কটা প্রশ্ন আছে?

দশটা।

 প্রতিটি প্রশ্নের প্রথম অক্ষরটা নিয়ে পর পর সাজাও কি হয়?

দ্রুত ওপর থেকে নিচে চলে গেল রবিনের চোখ। অক্ষরগুলো সাজালে হয়:

S-H-E-E-P-R-I-D-G-E

শিস দিয়ে উঠল সে, শিপরিজ! কোনও শহরের নাম!

হ্যাঁ, কিশোর বলল, বেশ চালাকি করে সূত্র রেখে গেছে গেনার। আমার ধারণা পুলিশ এটা বের করতে পারেনি। সম্ভবত গেমারের নিরুদ্দেশের ব্যাপারে তেমন গুরুত্বই দেয়নি পুলিশ।

তাতে আমাদেরই ভাল হয়েছে, রহস্যটার মীমাংসা করতে পারব। কিন্তু, আর তো দাঁড়াতে পারছি না, চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোন রকম চিন্তা-ভাবনা করতে পারব না এখন। মাখা কাজ করছে না।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে নাস্তা খেয়ে নিতে হবে, খালি পেটে ঘুম ভাল হবে না, কিশোর বলল। ঘুম থেকে উঠে পোস্ট অফিসে যাব শিপরিজটা কোথায় জানতে।

কমন নেম। পুরো আমেরিকায় অন্তত পঁচিশটা শিপরিজ পাওয়া যাবে। কটাতে খুঁজব? সবগুলোতে খুঁজতে গেলে খোঁজা শেষ হতে হতে আশি বছরের বুড়ো হয়ে যাবে গেনার। বড় করে হাই তুলল রবিন। তাড়াতাড়ি গিয়ে কান পাতল দেয়ালে।

শুনেছ নাকি কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

মনে হয় ডিগ উঠে পড়েছে। জলদি পালানো দরকার। ধরা পড়লে প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে জান খারাপ হয়ে যাবে।

বেরিয়ে এল দুজনে। দরজার তালাটা আবার লাগিয়ে দিল কিশোর। নিচে নেমে দেখল স্টিয়ারিঙে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে মুসা। ধাক্কাধাক্কি করেও তাকে জাগানো গেল না। তবে নাস্তার কথাটা কানের কাছে বলতেই মুহূর্তে পুরো সজাগ হয়ে গেল। স্টার্ট দিল গাড়িতে।

ক্যামপাসের ক্যাফেটেরিয়া এখনও খোলেনি। তাই শহরের একধারে একটা অল-নাইট কাফের সামনে গাড়ি রাখল মুসা।

ভরপেট খেয়ে কাফে থেকে বেরোল ওরা। মোটেলে ফিরে চলল।

ঘরে ফিরে একটানে জুতো খুলেই চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। কাপড় বদলানোর কষ্টও সহ্য করতে রাজি নয়। বলল, আমি গেলাম, আর পারছি না!

অন্য দুজনেরও একই অবস্থা। বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল তিনজনেই।

কয়েক ঘণ্টা টানা ঘুম দিয়ে জাগল ওরা। ঝরঝরে লাগছে এখন শরীর। হাতমুখ ধুয়ে, তৈরি হয়ে রওনা হলো ওরা। দরজা দিয়ে বেরিয়েই থমকে দাঁড়াল রবিন। ঘোষণা করল, ঝামেলা আসছে! লড়াইয়ের জন্যে তৈরি হও!

কি হয়েছে? রবিনের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিল কিশোর।

 মুসা এসে দাঁড়াল তার পেছনে।

রিজ মোটেলের চওড়া লন পেরিয়ে হেঁটে আসছে চারজন তরুণ। দলপতি বব বোম্যান।

লায়ন কাবস, বিড়বিড় করল মুসা। আজ যদি আবার সিংহগিরি দেখাতে এসে থাকে, ভাল হবে না। কেশর কেটে দিয়ে তবে ছাড়ব।

আগেই মারামারি শুরু করে দিয়ো না, সাবধান করল কিশোর, কি জন্যে এসেছে দেখি।

দরজা দিয়ে আগে বেরোল সে।

 এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলল বব, হাই! তোমাদের চমকে দিতে এলাম।

কিশোরের দুপাশ দিয়ে বেরোল মুসা আর রবিন।

মুসার মারমুখো ভঙ্গি ভাল ঠেকল না ববের, ওর হাতের কিলবিলে। পেশীগুলোর দিকে তাকাল চোখে সন্দেহ নিয়ে। বলল, দেখো, মারামারি করতে আসিনি আমরা।

তাহলে কি করতে এসেছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।

কি জন্যে এসেছে, বলল বব। তিন গোয়েন্দাকে ওর পছন্দ হয়েছে। সে চায় ওরা লায়ন কাবসে যোগ দিক।

কাজ নেই তো আর খেয়েদেয়ে, মানুষ থেকে শেষে পশুর বাচ্চা হতে যাই… বলে ফেলল মুসা।

অহেতুক ঝগড়া বাধাতে চায় না এখন কিশোর, তাই মুসাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, যোগ দিতে পারি, এক শর্তে। কাল রাতে কে আমাদেরকে লাইনের ওপর ফেলে আসতে বলেছিল, যদি তার নাম বলো।

দ্বিধায় পড়ে গেল বব। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বলতে চায় সে, কিন্তু কোন কারণে পারছে না। শেষে বলল, দেখো, বলতাম, সত্যি। কিন্তু একজন বন্ধুকে ফাঁসিয়ে দেয়া কি ঠিক?

তাহলে বোলো না।

 কিন্তু তোমরা তো তাহলে আমাদের দলে আসবে না।

শর্ত না মানলে কি করে আসব। এলে খুব ভাল হত। মুসার দিকে তাকাল বব, তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি, মুসা আমান। দারুণ বাস্কেটবল খেলো। তোমার খেলা দেখেছি। আরলিংটনের যে কোন টিম তোমাকে পেলে লুফে নেবে।

ধন্যবাদ, মুসা বলল, আপাতত আরলিঙটনের কারও লোফালুফির পাত্র হবার ইচ্ছে আমার নেই, এমনিতেই খুব ভাল আছি।

কোনমতেই তিন গোয়েন্দাকে লায়ন কাবসে ঢোকাতে রাজি করতে না পেরে হতাশ হয়েই ফিরে চলল বব। তবে বোঝা গেল, আশা ছাড়েনি সে। আবার আসবে চাপাচাপি করতে।

বেরিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। পোস্ট অফিসে ঢুকে একজন ক্লার্ককে অনুরোধ করতেই একটা পোস্টাল ডিরেক্টরি বের করে কাউন্টারের ওপর দিয়ে ঠেলে দিল। তার ওপরহুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর আর রবিন।

অনেকক্ষণ পাতা ওল্টানোর পর নিশ্চিত হলো, শিপরিজ অনেকগুলো আছে আমেরিকায়, তবে লস অ্যাঞ্জেলেসে আছে মাত্র একটা। কাজ সহজ হয়ে যাওয়ায় খুশি হলো ওরা। ডিরেক্টরিটা ক্লার্ককে ফেরত দিয়ে, তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পোস্ট অফিল থেকে বেরিয়ে এল।

মুসা জিজ্ঞেস করল, এবার কোথায়?

জবাব দিল কিশোর, অবশ্যই শিপরিজে, তবে তার আগে ক্যাম্পাসে যাও। ডিন আর মেরিন ডিগেরকাছ থেকে বিদায় নিতে হবে।

তার কোন প্রয়োজন আছে?

আছে।

আগেরবারের মতই শীতলভাবে ওদেরকে গ্রহণ করলেন ডিন ফলেট। ওরা চলে যাচ্ছে শুনে জানতে চাইলেন কোথায় যাচ্ছে।

জানাল কিশোর।

কোন ভাবান্তর হলো না তার। গেনারকে খোঁজার জন্যে ওদের একটা শীতল ধন্যবাদ জানিয়ে আবার কাজে মন দিলেন।

বেরিয়ে এল ওরা। ডিগের সঙ্গে দেখা করতে চলল।

 ঘরেই পাওয়া গেল তাকে।

কিশোর বলল, আমরা চলে যাচ্ছি। এখানে আমাদের কাজ শেষ।

হাত মেলাতে মেলাতে রবিন বলল, আপনার সাহায্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

দুঃখ একটাই, বলল কিশোর, আপনার বন্ধুকে খুঁজে বের করতে পারলাম না।

তাতে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, বিন্দুমাত্র উদ্বিয় মনে হলো না ডিগকে, বরং তিন গোয়েন্দা চলে যাচ্ছে শুনে যেন খুশিই হলো। আমার এখনও। বিশ্বাস, ইয়োরোপেই গেছে সে, বিয়ে করতে, হয়তো এতক্ষণে করেও ফেলেছে। হানিমুন করছে নতুন বউকে নিয়ে। হাহ হাহ হা! নিজের রসিকতায় নিজেই হাসল।

সেটা হলে তো ভালই। যাই হোক, অনেক সাহায্য করেছেন আমাদের। থ্যাংক ইউ।

তা কোথায় যাচ্ছ তোমরা? বাড়ি?

না, ইচ্ছে করেই সত্যি কথাটা জানিয়ে দিল কিশোর, ডিগের চোখের দিকে তাকিয়ে, ভাবছি শিপরিজটা একবার ঘুরে যাব-..

চমকে গেল মনে হলো ডিগ, কেন? ওখানে কেন? গুহাটা দেখতে নাকি?

গুহা! সতর্ক হলো কিশোর।

ও, জানো না। একটা বিখ্যাত গুহা আছে ওখানে, নাম ব্ল্যাকহোল। তবে বিখ্যাত না বলে কুখ্যাত বলাই ভাল…

আপনি দেখেছেন নাকি গুহাটা?

উ! থমকে গেল ডিগ। হাসল। দেখেছি। আমার এক চাচা থাকে ওখানে, তার কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম তো, ঠিক আছে, যাও। দেরি করিয়ে দিচ্ছি। আমারও কাজ আছে। লেকচারের জন্যে কিছু কাগজ রেডি করতে হবে।

কিশোরের মনে হলো, কোন কথা চেপে যাচ্ছে ডিগ। ওরা যে মেরিনকে খুঁজতে যাচ্ছে ওখানে সন্দেহ করেছে নাকি? সন্দেহ কাটানোর জন্যে বলল, শুনেছি, শিপরিজটা সুন্দর জায়গা, দেখার মত। গুহাটা যাওয়ার আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিল। গুহার ভেতরে রাত কাটানো খুব মজার, কি বলেন?

Categories: