গুপ্তচর শিকারি – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথশ প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৯৬
মোটেলে ফেরার পথে রবিন বলল, শিপরিজের কথা শুনে অমন চমকে উঠল কেন? আমার মনে হয় কিছু লুকাচ্ছে ডিগ।
কি জানি, চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, হতে পারে গেনারের প্রশ্নপত্রে শিপরিজের নামটা সেও আবিষ্কার করে ফেলেছে। কিন্তু কথা হলো, সে জানে আমরা গোয়েন্দা, আবিষ্কারই যদি করে থাকে, আমাদের সেকথা জানাল না কেন?
নিজেই যেতে চায় হয়তো ওখানে। বন্ধুকে খুঁজে বের করে সবাইকে চমকে দেয়ার জন্যে।
মাথা নাড়ল কিশোর, আমার তা মনে হয় না। লোকটার ব্যাপারে সাবধান থাকা দরকার।
কি করে থাকব? মুসার প্রশ্ন। আমরা তো চলেই যাচ্ছি এখান থেকে।
জবাব দিল না কিশোর। ভাবনায় ডুবে গেল।
মোটেলে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে লাগল রবিন আর মুসা, কিশোর ফোন করল রকি বীচে, গোয়েন্দা ভিকটর সাইমনের পাইলট ল্যারি কংকলিনকে। বাড়িতেই পাওয়া গেল ওকে। মেরিন ডিগের কথা তাকে। জানিয়ে অনুরোধ করল কিশোর, লোকটার ওপর সন্দেহ হচ্ছে আমাদের, ওর ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে আমাদের জানাবেন?
তোমাদের ঠিকানা বলো।
শিপরিজে যাচ্ছি। কোথায় উঠব বলতে পারছি না। আপনি খোঁজখবর নিন, আমি আবার ফোন করব।
টাকমাথা বাচাল ম্যানেজারকে অফিসে পাওয়া গেল। বিল মিটিয়ে দিল কিশোর। আবার তিনজনে গাড়িতে উঠতে মুসা বলল, তাহলে শিপরিজেই যাচ্ছি?
কেন, কোন সন্দেহ আছে নাকি তোমার? প্রশ্ন করল কিশোর।
না না, বলছিলাম কি ব্ল্যাকহোল গুহায় যাব নাকি?
দরকার পড়লে যাব।
হেসে বলল রবিন, ভয় করছে নাকি তোমার?
তা একটু-আধটু যে করে না তা নয়। আমি ভাবছি, আমার মেটাল ডিটেক্টরটা এবার কাজে লাগানো যাবে কিনা?
গুহার মধ্যে কি খুঁজবে? ভূত?
আরে দূর! জোরে হাত নাড়ল মুসা, এটা কি গোস্ট ডিটেক্টর নাকি? আমি বলছি গুপ্তধনের কথা। সোনার মোহর-টোহর যদি লুকানো থাকে…
তাহলে বড়লোক হয়ে যাবে, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। নাও, বকবকানি থামিয়ে এখন গাড়ি চালাও।
রওনা হওয়ার সময় আকাশটা ভালই ছিল, এখন যতই সামনে এগোচ্ছে ধূসর হয়ে আসছে আকাশের রঙ। একসময় কুয়াশায় ঢেকে গেল সবকিছু। হেডলাইট জ্বেলে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে মুসাকে। ঘন্টাখানেক পরই কুয়াশা কেটে গেল, হেসে উঠল উজ্জল রোদ। আবহাওয়ার এই যখন তখন পরিবর্তনে অবাক হলো না ওরা, এদিকে এ রকমই হয়, জানা আছে।
সাগর সমতল থেকে এখানে দুশো ফুট ওপরে রাস্তা। পাহাড়ের গা বেয়ে চলে গেছে। সাগরের দিকটায় কোথাও খাড়া, কোথাও ঢালু হয়ে নেমেছে পাহাড়ের দেয়াল। ঢালু অংশগুলোতে সাগর আড়াল করে দিয়ে ঘন হয়ে জন্মেছে গাছপালা, ঝোপঝাড়।
কিছুদূর এগোনোর পর সামনে ঢালু হয়ে এল পথ। লম্বা একটা পাহাড়ের কিনার দিয়ে নিচে নামতে নামতে একসময় চোখে পড়ল শিপরিজ। মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা অতি খুদে একটা গ্রাম। সৈকতের ধারে ছোট্ট জেটি তৈরি করেছে জেলেরা। শান্ত, সুন্দর গ্রাম। দেখে মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য। রাস্তার পাশে একটা পুরানো বাড়ি দেখা গেল। রোদ-বৃষ্টি আর নোনা হাওয়ায় রঙ এমন চটেছে, যতটা না পুরানো তার চেয়ে অনেক বেশি পুরানো মনে হয়।
দরজায় বড় করে সাইনবোর্ড লেখা:
HARRYS GENERAL STORE.
মুসাকে বলল কিশোর, থামো, কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে ক্যাম্প করার জন্যে।
বাড়িটার সামনে গাড়ি রেখে মুসা বলল, একটা করে বার্গার খেয়ে নিলে কেমন হয়?
মন্দ হয় না।
কাউন্টারের ওপাশেবসে আছে মাঝবয়েসী, ঝাড়ুর শলার মত খাড়া খাড়া গোঁফওয়ালা এক লোক। পত্রিকা পড়ছে।
সাড়া পেয়ে কাউন্টারের ওপর কাগজটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল সে। চশমার ভারি লেন্সের ওপাশ দিয়ে গভীর কৌতূহলের সঙ্গে তাকাল ওদের দিকে। ভঙ্গি দেখে মনে হয় যেন বহুদিন বাদে এই প্রথম মানুষ চোখে পড়েছে।
আপনিই মিস্টার হ্যারি? জানতে চাইল কিশোর।
হ্যাঁ, খসখসে গলায় জবাব দিল লোকটা, কি সাহায্য করতে পারি?
ব্ল্যাকহোলটা কতদূরে, বলতে পারেন?
চোখ বড় বড় হয়ে গেল হ্যারির, ব্ল্যাকহোল! ওখানে যাওয়ার জন্যে এসেছ নাকি?
হ্যাঁ, গুহার কাছে ক্যাম্প করতে চাই।
কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে সামনের দিকে গলা বাড়িয়ে দিল হ্যারি। ক্যাম্প করবে? ব্ল্যাকহোলে?
কেন, অসুবিধে আছে নাকি?
আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করল লোকটা, এখানে এই প্রথম এলে নাকি?
হ্যাঁ, রকি বীচ থেকে। বেড়াতে বেরিয়েছি।
শিপরিজ বেড়ানোর জন্যে খুব ভাল জায়গা।
গুহাটা কতদূরে, বলেননি কিন্তু।
এই রাস্তা ধরেই চলে যাও পাঁচ মাইল। তারপর খানিক হাঁটতে হবে।
কাউন্টারে কনুই ঠেকাল মূসা। বার্গার আছে নাকি?
আছে,হ্যারি বলল, খুব ভাল বার্গার। তাজা। তাজা জিনিস ছাড়া বেচি আমি।
দিন তাহলে। তিনটা।
প্লেটে করে বার্গার এনে দিল হ্যারি।
বার্গারের কাগজের মোড়ক ছাড়াতে ছাড়াতে জিজ্ঞেস করল রবিন, গুহার কাছে ক্যাম্প করার জায়গা আছে নাকি?
আছে। কাছেই একজন জেলে থাকে, নাম রিক ভেলভার। খাতির করে নিতে পারলে ওর বাড়ির কাছে তোমাদের থাকতে দেবে সে। তোক ভাল। গুহার কাছে না গিয়ে ওর বাড়ির কাছাকাছি থাকলেই ভাল করবে। এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে মুখ খুলল হ্যারি, আমি হলে অন্তত ওই গুহার কাছে ক্যাম্প করতে যেতাম না কিছুতেই।
শুধু ক্যাম্প করা নয়, আমরা তো ভাবছি গুহাটাতেই ঢুকব।
পাগল! ঢোক গিলল হ্যারি।
কেন, বেআইনী নাকি?
না। তবে সুস্থ মস্তিষ্ক কোন লোক এখন আর ওই গুহায় ঢুকতে চাইবে না।
কেন?
বললাম তো, মাথা খারাপ না হলে ওই গুহায় ঢোকার কথা ভাববে না কেউ, এমন ভঙ্গি করল হ্যারি, যেন এতেই সর প্রশ্নের জবাব হয়ে গেছে।
আপনার কথা কিছুই বুঝলাম না! রবিন বলল।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, গুহায় ঢোকাটা বিপজ্জনক নাকি?
নাহলে এত কথা বলব কেন? আমার পরামর্শ শুনলে, ওই গুহার ধারেকাছে যেয়ো না।
কাউন্টারে কনুই রেখে অধৈর্য হয়ে বলল রবিন, দয়া করে কারণটা কি আমাদের খুলে বলা যায়?
এক মুহূর্ত চিন্তা করে নিল হ্যারি। বেশ, না শুনে যখন ছাড়বে না..ইদানীং অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে গুহার মধ্যে।
এইবার টনক নড়ল মুসার। খাড়া করে ফেলেছে কান। বার্গার চিবানো বন্ধ হয়ে গেল। খাইছে! ভূত নাকি?
তা বলতে পারব না, মাথা নাড়ল হ্যারি। কয়েক দিন আগে আমার পরিচিত এক জেলে গিয়েছিল গুহার কাছে। এত ভয় পেয়েছিল, আরেকটু হলে হার্টফেল করেই মরত বেচারা। নেহাত হাটটা শক্ত আর নীরোগ বলে বেঁচে গেছে। গুহার ভেতরে আর আশোঁপাশে নাকি আজব আলো দেখা যায়, শব্দ শোনা যায়, গোলাগুলি চলে।
গোলাগুলি! ভুরু কুঁচকে ফেলল কিশোর।
হ্যাঁ। দুজন অতি উৎসাহী লোক গুহার আলোক-রহস্য জানতে গিয়েছিল, তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। আততায়ীকে দেখতে পায়নি ওরা।
কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো মুসা, আর যাই করুক, ভূতে গুলি ছোড়ে না। গলা টিপে ধরে, নয়তো ঘাড় মটকে দেয়। কোন কোন ভূত জীবন্ত মানুষের শরীর থেকেই চুপচাপ রক্ত খেয়ে চলে যায়।
আবার বার্গার খাওয়ায় মন দিল সে।
চট করে ভাবনাটা খেলে গেল কিশোরের মাথায়–ওই গুহার মধ্যেই ঢোকেনি তো হ্যারিস গেনার? জিজ্ঞেস করল, লোক দুজন কারা, এই এলাকার কেউ?
না, চিনি না। আগে নাকি কখনও এখানে দেখা যায়নি ওদের।
ওদের চেহারার বর্ণনা দিতে পারেন? তাদের মধ্যে কি হ্যারিস গেনার নামে একজন কলেজের লেকচারার আছেন?
তা বলতে পারব না। ওদের সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। যে জেলের কাছে গুহার কথা শুনেছি, লোকগুলোর কথাও সেই বলেছে।
জেলের নাম কি? ওকে কোথায় পাওয়া যাবে?
আপাতত পাওয়া যাবে না ওকে। ওর মায়ের শরীর খারাপ, তাকে দেখতে গেছে। অনেক দূরে থাকে ওর মা। কিশোরের চোখের দিকে তাকাল। হ্যারি। মনে হচ্ছে নোক দুজনকে তোমাদের দরকার?
না না, এমনি, গুহাটার ব্যাপারে কৌতূহল হচ্ছে তো, ওদের মুখ থেকেই সক শুনতাম, কোনমতে দায়সারা জবাব দিয়ে হ্যারির প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। সে।
ক্যাম্প করার জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো চাইল কিশোর। এগুলো নিয়ে, খাবার আর জিনিসের দাম মিটিয়ে, হ্যারিকে ধন্যবাদ দিয়ে দরজার দিকে এগোল।
গুহার কাছে না যাওয়ার জন্যে আরেকবার ওদেরকে সতর্ক করল দোকানদার।
.
মহাসড়ক ধরে মাইল পাঁচেক এগোনোর পর ডানে একটা সরু কাঁচা রাস্তা দেখা গেল। এবড়োখেবড়ো, নুড়িতে ভরা রাস্তাটা চলে গেছে সৈকতের ধারে তৈরি একসারি বাড়ির দিকে। জেলেদের বাড়ি ওগুলো।
রাস্তাটা ধরে গাড়ি চালাল মুসা। দুশো গজ দূরে পাহাড়ের গোড়ায় গিয়ে সৈকতটা যেখানে আচমকা শেষ হয়েছে সেখানে একটা ছোট বাড়ি। ওটার খানিক দূরে পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। বাড়ির পেছনে পাহাড়, একটা আঁকাবাঁকা পথ উঠে গেছে চুড়ার দিকে।
ওটাই সভবত রিক ডেলভারের বাড়ি, হাত তুলে দেখিয়ে কিশোর বলল।
যাব নাকি ওদিকে? জানতে চাইল মুসা।
যাও।
বাড়ির কাছ থেকে সামান্য দূরে এনে গাড়ি রাখল মুসা। নেমে গেল। কিশোর আর রবিন। ড্রাইভিং সীট থেকে মুসাও নেমে এসে এগোল ওদের পেছন পেছন।
দরজায় টোকা দিল কিশোর।
খুলে দিল একজন বেঁটে লোক। বুড়ো হয়ে গেছে। ভাঁজ পড়া, খসখসে মুখের চামড়া। তিন গোয়েন্দাকে দেখে অবাকই হলো। যেন ওদের মত কাউকে এখানে দেখতে পাবে আশা করেনি।
আপনি রিক ডেলভার? প্রশ্ন করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল লোকটা। হাসল।
মূসার গাড়িটা দেখিয়ে কিশোর বলল, গাড়িটা রাখলাম। কোন অসুবিধে হবে?
না, অসুবিধে হবে না। ঘুরতে যাবে নাকি? কতক্ষণ লাগবে তোমাদের? ঘণ্টাখানেক?
আসলে কয়েকদিন থাকব ভাবছি। যদি আপনার কোন অসুবিধে না হয়…
গুহা দেখতে আসোনি তো? মুখের ভাব বদলে গেছে বুড়োর। চোখ পিটপিট করে একবার এর দিকে, একবার ওর দিকে তাকাচ্ছে।
ঠিকই ধরেছেন, গুহা দেখতেই এসেছি।
হাসি চলে গেছে বুড়োর। ভারী গলায় বলল, ভাল চাও তত বাড়ি ফিরে যাও। গুহার অবস্থা ভাল না। খামোকা কেন প্রাণটা খোয়াতে যাবে।
কে, রিক? ঘরের ভেতর থেকে প্রশ্ন করল একটা মহিলাকণ্ঠ, কার সঙ্গে কথা বলছ?
এই তো, কয়েকটা ছেলে, বেড়াতে এসেছে, ফিরে তাকিয়ে জবাব দিল রিক। গুহা দেখতে যেতে চায়।
বলে কি! ভেতর থেকে বেরিয়ে এল গোলগাল এক মহিলা।
এত ভয় পাচ্ছেন কেন আপনারা? জিজ্ঞেস করল কিশোর। কি আছে গুহায়?
আলো আর গুলি! রহস্যময় স্বরে জবাব দিল বুড়ো।
লোকজন দেখেছেন? আছে ভেতরে?
কারও ছায়াও নেই।
তাহলে গুলি করে কারা?
জানি না!
অবাক কাণ্ড!
অবাক বলে অবাক! এক্কেবারে ভূতুড়ে কাণ্ড! খোদাই জানে এ কোন ধরনের ভূত, গুলিও চালায়!
হাঁ হয়ে গেছে মুসা। চট করে তাকাল চারপাশে। গায়ে কাঁটা দিল ওর। মনে হলো, গুহা থেকে বেরিয়ে এই বুঝি ওর ঘাড় মটকাতে এল কোন ভূত।
ওই গুহায় কখনও ঢুকেছেন আপনি, মিস্টার ডেনভার? জানতে চাইল কিশোর।
এত লম্বা নামের দরকার নেই, আমাকে শুধু রিক ডাকলেই চলবে, বুড়ো বলল। জানাল কয়েকদিন আগে নাকি রাতে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল। আবহাওয়া ভাল ছিল না। বাতাস আর সেই সঙ্গে বড় বড় ঢেউ। তীর থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ দেখল আলো। বুড়ো বলল, গুহার কাছে দুটো আলো দেখলাম। খানিক পর দুতিনটে গুলির শব্দ। চিৎকার করে উঠল কে যেন।
চিৎকারটা কেমন? আর্তনাদ? মানে কাউকে খুন করা হচ্ছে, এমন?
সে বলে বোঝানো যাবে না। এমন চিৎকার জীবনে শুনিনি আমি। ভয়ঙ্কর!
তারমানে বোঝা যাচ্ছে, বিড়বিড় করল রবিন, ভেতরে কেউ আছে। দোকানদার হ্যারির কাছেও শুনলাম এই গপ্পো। পুলিশকে জানালেই পারেন?
জানানো হয়েছে। পুলিশ এ সব বিশ্বাস করে না। বুড়ো জেলেদের কুসংস্কার বলে হেসে উড়িয়ে দেয়। একটিবার দেখতেও আসেনি গুহাটা।
ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করা গেল না তিন গোয়েন্দাকে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, গুহায় যাওয়ার সবচেয়ে সহজ পথটা বলতে পারেন?
কোনভাবেই নিরস্ত করতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল বুড়ো। জেলে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। তারপর নেমে এল দরজা থেকে। ওদেরকে নিয়ে সৈকত ধরে কিছুদূর চলার পর হাত তুলে পাহাড়ে উঠে যাওয়া রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, ওটা ধরে চূড়ায় উঠে যাও। নিচে তাকালে ওপাশে একটা খাদ দেখতে পাবে। ওই খাদ ধরে এগোতে থাকলে পেয়ে যাবে গুহাটা।
গাড়ির কাছে ফিরে এল ওরা। ক্যাম্প করার জিনিসপত্র বের করে কাঁধে তুলে নিল। জেলে দম্পতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হয়ে গেল পাহাড়ের দিকে।
দূর থেকে যতটা মনে হয়েছিল, তারচেয়ে খাড়া পাহাড়টা। চূড়ায় উঠতে পুরো একটা ঘণ্টা লেগে গেল।
এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল ওপর থেকে। অনেক নিচে সৈকতে জেলেদের ঘরগুলোকে খেলনার মত লাগছে। সাগরকে মনে হচ্ছে বিশাল এক নীল রঙের মেঝে, ঘরের মেঝের মতই সমান।
চুড়ার অন্যপাশে সাগরের দিকটার একেবারে কিনারে গিয়ে নিচে তাকাল রবিন। পাথরের খাড়া দেয়াল নেমে গেছে। নিচে আছড়ে পড়ছে। উত্তাল ঢেউ। শক্ত জাতের কিছু ঝোপঝাড় জন্মে রয়েছে এখানে ওখানে।
সৈকত ধরে হেঁটে গুহায় যাওয়া অসম্ভব, অনুমান করল সে। সাগরের দিক দিয়ে যেতে হলে নৌকায় করে যেতে হবে।
ঝোড়ো বাতাসে ভর করে ভেসে এল মেঘের শুড়গুডু। আকাশের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, জলদি চলো। ঝড় আসছে। এখানে থাকলে মরব।
বড় বড় পাথরের চাঙড়ের মধ্যখান দিয়ে চলে গেছে সরু পায়ে চলা পথ। সেটা ধরে হাঁটতে শুরু করল ওরা। একটু পর পরই সরে গিয়ে নিচে তাকাচ্ছে রবিন। গিরিখাদটা দেখতে পাচ্ছে না। অবিশ্বাস্য দ্রুত মেঘে ঢেকে ফেলছে। আকাশ। অন্ধকার করে ফেলেছে। এর মধ্যে খাদটা চোখে পড়বে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। হয়তো দেখা যাবে হঠাৎ করেই ওটাতে নেমে পড়েছে। ওরা।
মুখে এসে পড়ল বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা। কালো আকাশকে চিরে দিয়ে ছুটাছুটি শুরু করল বিদ্যুতের তীব্র উজ্জ্বল নীলচে-সাদা সাপগুলো। কানফাটা বিকট শব্দে ঘন ঘন বাজ পড়তে লাগল। শুরু হলো ঝমঝম করে মুষলধারে বৃষ্টি।
তা বাড়ছে বাতাসের বেগ। অনেক নিচে পাথুরে দেয়ালে কামানের গর্জন তুলে ভাঙছে ঢেউ। চলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছে গোয়েন্দারা। সামনের পথ ঠিকমত চোখে পড়ছে না। ভোতা গোঁ গোঁ শব্দ তুলছে বাতাস, আকাশে বিদ্যুতের চমক, আর চলছে একনাগাড়ে বজ্রপাত।
আগে আগে চলেছে মুসা। মাঝে কিশোর, সবার শেষে রবিন। বৃষ্টি আর বাতাসের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে মাথা নুইয়ে রেখেছে। বুঝতে পারছে না এই দুর্যোগের মধ্যে আদৌ খুঁজে পাবে কিনা গিরিখাদটা।
হঠাৎ কি মনে হতে ফিরে তাকাল কিশোর। ধড়াস করে উঠল বুক। চিৎকার করে উঠল, আরি, রবিন গেল কোথায়!
উধাও হয়েছে রবিন। শত চিৎকার করেও তার সাড়া পাওয়া গেল না।
.
গেল কোথায়? বিমূঢ় হয়ে গেছে মুসা।
প্রবল বৃষ্টি আর অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টি চলে ভালমত। কয়েক গজ দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না।
ফিরে যাওয়া দরকার, কিশোর বলল। কোন কারণে আমাদের কাছ থেকে পিছিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। কিংবা ক্লান্ত হয়ে গিয়ে কোথাও বসে বিশ্রাম নিচ্ছে।
বলল বটে, কিন্তু কথাটা সে নিজেও বিশ্বাস করল না।
প্রায় গা ঘেষাঘেঁষি করে ভেজা পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে ফিরে চলল দুজনে। বার বার চিৎকার করে রবিনের নাম ধরে ডাকছে। জানে, ঝড়ের গর্জনের মধ্যে এই চিৎকার রবিনের কানে পৌঁছার সম্ভাবনা খুব কম।
অ্যাই, শঙ্কিত হয়ে বলল মুসা, পা পিছলে পড়েটড়ে যায়নি তো! হাত পা ভেঙে পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে হয়তো কোথাও এখন।
থমকে দাঁড়াল কিশোর। হতে পারে। দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি। কান পেতে শুনতে লাগল কোথাও কিছু শোনা যায় কিনা।
বাতাসের শব্দকে ছাপিয়ে আগে মুসার কানে ঢুকল শব্দটা। অতি মৃদু চিৎকার।
খাইছে! শুনছ!
কিশোরও কান পাতল।
আবার শোনা গেল চিৎকার, মুসা! কিশোর!
পিছলে পড়ার ভয়কে পরোয়া না করে পাহাড়ের কিনারে ছুটে গেল দুজনে। উঁকি দিয়ে নিচে তাকাল। ফুট চারেক নিচে একটা কালো দেহ চোখে পড়ল।
রবিন, কোন সন্দেহ নেই। একটা ঝোপ আঁকড়ে ধরে ঝুলছে। ওদেরকে উঁকি দিতে দেখে প্রায় ককিয়ে উঠল, জলদি করো! গাছের গোড়া উপড়ে আসছে।
ধরে রাখো! মুসা বলল। রবিনকে ধরে তুলে আনার চেষ্টা করল। নাগালই পেল না। দমে গেল সে।
এ ভাবে পারবে না, কিশোর বলল। দাঁড়াও, ব্যবস্থা করছি।
দড়ি বের করল সে। এক মাথা পাথরের সঙ্গে বেঁধে আরেক মাথা ঝুলিয়ে দিল রবিনের নাগালের মধ্যে।
এক হাত বাড়িয়ে থাবা দিয়ে দড়িটা ধরে ফেলল রবিন। একেবারে শেষ মুহূর্তে। সেও দড়ি ধরল, ঝোপের গোড়াটাও উপড়ে এল পাহাড়ের গা থেকে। ধক করে উঠল বুক। একটা হার্টবীট মিস হয়ে গেল তার।
দড়ি ধরে টেনে ওকে ওপরে তুলে আনল মুসা আর কিশোর।
ওপরে উঠে ভেজা মাটিতেই গড়িয়ে পড়ল রবিন। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। ভীষণ ক্লান্ত।
ওখানে গেলে কি করে? জানতে চাইল মুসা।
একটু শান্ত হওয়ার পর রবিন বলল, জুতোর ফিতে ছিঁড়ে গিয়েছিল। হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে বসে ছেঁড়া মাথাটা বাধলাম। উঠে দেখি তোমরা নেই। ধরার জন্যে দৌড়াতে শুরু করলাম। এত কিনারে যে চলে গিয়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একটা পাথর ভেঙে সরে গেল পায়ের নিচ থেকে। পিছলে পড়ে গেলাম। গাছটা কখন কিভাবে ধরেছি বলতে পারব না।
কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার এগিয়ে চলল তিন গোয়েন্দা। এবার আর কেউ পেছনে পড়ে রইল না। দেয়ালের বেশি কিনারেও গেল না।
আচমকা চিৎকার করে উঠল মুসা, পেয়ে গেছি। খাদ!
হুড়াহুড়ি করে তার দুপাশে চলে এল অন্য দুজন। সামনে গলা বাড়িয়ে তাকাল। পাহাড়ের গায়ে গভীর একটা ক্ষতের মত হয়ে আছে খাদটা।
সাবধানে তিনজনেই পা রাখল ওটাতে। অনেক নিচে আবছাভাবে চোখে পড়ল সৈকত। বড় বড় ঢেউ আছড়ে ভাঙছে তীরে। চওড়া একটা বিরাট ফাটলের মত পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে গিরিখাদ। পথ গেছে তার মধ্যে দিয়েই। নামতে শুরু করল তিনজনে।
সবার আগে নিচে নামল রবিন।
ওই দেখো! গুহা! হাত তুলে চিৎকার করে বলল সে।
কিশোর আর মুসাও দেখল। সাগরের আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সামান্য দূরে পাহাড়ের খাড়া দেয়ালে একটা কালো ফোকর।
গুহার দিকে আগে এগোনোর সাহস হলো না মুসার। কোমরে ঝোলানো টর্চ খুলে পা বাড়াল কিশোর। আগে আগে চলল। তার পেছনে এগোল অন্য দুজন।
গুহামুখে দাঁড়িয়ে ভেতরে আলো ফেল কিশোর। তিনজনেই দেখল, গুহা না বলে ওটাকে সুড়ঙ্গ বলা ভাল। কালো কক্ষটার পেছন দিকটা হারিয়ে গেছে ভেতরের ঘন কালো অন্ধকারে।
ইচ্ছে করলে কি আছে ভেতরে এখনই দেখা যায়, কিশোর বলল।
মাথা খারাপ! আঁতকে উঠল মুসা। রাতের বেলা এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে যাব গুহায় ঢুকতে!
গুহার ভেতরে তো আর বৃষ্টি নেই।
তাতে কি? বাইরে তাঁবু পাতব আগুন জ্বালতে হবে। ভিজে একেবারে হাত-পা সিটিয়ে গেছে।
দেখো, গুহায় থাকলে আরামে থাকতে পারতাম…
এখন আমি ঢুকতে পারব না, সাফ মানা করে দিল মুসা।
আগুন জ্বালার লাকড়ি পাবে কোথায়? প্রশ্ন করল রবিন।
তাই তো? একথা তো ভাবেনি। জবাব দিতে পারল না মুসা। আশোঁপাশে গাছপালা আছে, লাকড়ির অভাব হত না, কিন্তু সব ভিজে চুপচুপে।
লাকড়ির যা হোক একটা ব্যবস্থা করো তোমরা, কিশোর বলল, আমি আসছি। গুহায় ঢোকার জন্যে পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না সে। টর্চ হাতে ঢুকে পড়ল। কয়েক পা এগিয়েই চিৎকার করে উঠল, অ্যাই, দেখে যাও কাণ্ড!
তার চিৎকারে মুসাও সাবধান হবার কথা ভুলে গেল। রবিনের সঙ্গে ছুটে এল।
কি দেখেছে টর্চের আলো নেড়ে দেখাল কিশোর, লাকড়ি! শুকনো?
সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা লাকড়ির স্তূপটা দেখল রবিন। কে রাখল?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না!
আ-আমি জানি…
ভূতে…
তাড়াতাড়ি রবিনের মুখে হাতচাপা দিল মুসা, খবরদার, ওই নাম মুখে এনো না! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল সে।
ওদের কথায় কান না দিয়ে এগিয়ে গেল কিশোর। একটা লাকড়ি হাতে তুলে নিল। খটখটে শুকনো। হাসিমুখে ফিরে তাকিয়ে বলল, এবার আর আগুন জ্বালতে কোন অসুবিধে নেই।
কিন্তু কার লাকড়ি? জোরে কথা বলতে সাহস করছে না মুসা।
যারই হোক, আমাদের এখন দরকার, নিয়ে আগুন জ্বালব। তারপর দেখা যাবে।
তারমানে গুহাতেই থাকবে তুমি?
তো কি বাইরে গিয়ে সারারাত ধরে ভিজব নাকি? বোকামি করতে ইচ্ছে করলে তুমি করোগে, আমি যাচ্ছি না।
আমিও না,বলে দিল রবিন।
অগত্যা আর কি করে মুসা। বাইরে একা থাকার চেয়ে ভূতের ভয় নিয়েও গুহায় থাকা ভাল। সঙ্গে অন্তত দুজন সঙ্গী তো থাকছে। কোন কথা না বলে লাকড়ি জড় করে আগুন জালার ব্যবস্থা করতে লাগল সে। খিদে পেয়েছে।
ব্যাকপ্যাক খুলে ভেজা কাপড় খুলতে শুরু করল রবিন।
আগুন ধরিয়ে ফেলল মুসা। ধোঁয়া উঠছে অগ্নিকুণ্ড থেকে। ভুরু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিশোর আগুন তো জ্বালা হলো, ধোঁয়া যাবে কোথায়? বেরোনোর পথ না থাকলে অক্সিজেন শেষ করে দিয়ে দম আটকে মারবে ওদের।
কিন্তু স্বস্তির সঙ্গে দেখল, সোজা ওপরে উঠে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া। তারমানে ফাটল আছে পাহাড়ের গায়ে, চিমনির কাজ করছে।
ভেজা কাপড় বদলে, শরীরে কম্বল জড়িয়ে, আগুনে হাত-পা সেকে গরম করতে লাগল ওরা। কিশোর ভাবছে, কে লাকড়ি রাখল এখানে? এর সঙ্গে কি রহস্যময় চিৎকার আর গুলির কোন সম্পর্ক আছে?
উঁকি দিয়ে গিয়ে গুহার বাইরেটা দেখে এল রবিন। বৃষ্টি একবিন্দু কমেনি। কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি জোয়ারের পানি ঢোকে?
মনে হয় না। মেঝে তো শুকনোই দেখছি।
খাবারের টিন আর ফ্রাইং প্যান বের করে রান্না করতে বসল মুসা। তাকে সাহায্য করল রবিন। মাংস ভাজার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। মুসার ক্ষুধা দশগুণ বাড়িয়ে দিল। চমৎকার জমল খাওয়া। গুহার মাঝখানে অগ্নিকুণ্ড, দেয়ালে আর ছাদে লালচে আলোয় ছায়ার নাচন, বাইরে ঝড়বৃষ্টি। দারুণ এক পরিবেশ। আগুনের সামনে বসে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করল তিনজনেই।
রবিন বলল, কম্বলের বদলে এখন পশুর ছাল পেলে ভাল হত। গুহামানব হয়ে যেতাম।
খাওয়ার পর কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। সারাদিনে প্রচুর পরিশ্রম করেছে। বুজে আসছে চোখ। কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল বলতে পারবে না।
চড়চড়, ফুটফাট, নানা রকম বিচিত্র শব্দ করে পুড়তে থাকল লাকড়ি।
এক ঘণ্টা কাটল।
দুই ঘন্টা।
হঠাৎ জেগে গেল রবিন। অলস ভঙ্গিতে ঘুরে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে পুরো সজাগ হয়ে গেল। পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছে।
কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা তুলে কে আসছে দেখার চেষ্টা করল। আগুন নিভে গেছে। পুড়ে শেষ হয়ে গেছে কাঠ। কেবল কয়লার আগুন লালচে একটা আভা তৈরি করে অতি সামান্য আলো দিচ্ছে।
কাউকে না দেখে ভাবল রবিন, কিশোর উঠেছে বুঝি, প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্যে। ডেকে জিজ্ঞেস করুল, কে, কিশোর?
সাড়া দিল না কিশোর। জবাবে চাপা শব্দ করে উঠল কে যেন। মনে হলো খুব অবাক হয়েছে। মেঝের ওপর দিয়ে দ্রুত ছুটে গেল পদশব্দ।
.
কে? লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল রবিন।
জবাব নেই।
কিশোর! মুসা! জলদি ওঠো! অন্ধকারে টর্চটার জন্যে হাতড়াতে শুরু করলা সে।
কি হয়েছে? ঘুমজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মুসা। সকাল হয়ে গেল নাকি? এত তাড়াতাড়ি
ওঠো, জলদি! কে জানি ঢুকেছে!
কি করে বুঝলে?
হাঁটতে শুনলাম।
কিশোর হবে হয়তো। টয়লেট করতে বেরিয়েছিল।
আমি বেরোইনি, জবাব দিল কিশোর।
খাইছে? তাহলে কে? চমকে উঠে বসল মুসা। বদলে গেছে কণ্ঠস্বর। আগুনটার কি হলো টর্চ জালছ না কেন?
হাতের কাছেই টর্চ রেখেছে কিশোর তুলে নিয়ে জালল। আলোর রশ্মি ঘুরিয়ে আনল গুহার দেয়ালে, ছাদে। অপরিচিত কাউকে দেখা গেল না।
চোখ পিটপিট করছে মুসা। রবিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি শুনেছিলে, বলো তো?
খুলে বলল রবিন ৷
সামনের দিকে গেছে? জানতে চাইল কিশোর।
মাথা নাড়ল রবিন, না, পেছনে। সুড়ঙ্গের ভেতরে।
ওঠো, দেখে আসি।
এই এখন, অন্ধকারের মধ্যে..চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার।
সুড়ঙ্গের মধ্যে দিনের বেলাও যা রাতেও তাই, সব সময়ই অন্ধকার, ভোরের জন্যে বসে থেকে লাভ নেই।
উঠে পড়ল কিশোর। টর্চ হাতে এগোল গুহার পেছন দিকে।
তিরিশ কদম এগোনোর পর সামনে একটা খিলান দেখা গেল, ওপরটা ধনুকের মত বাকা। গুহা থেকে সুড়ঙ্গে ঢোকার প্রবেশপথ। পেছনে তাকিয়ে দুই সহকারীর দিকে নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। সামনে টর্চ অব্রে রেখে সাবধানে এগোল। খেয়াল রাখল যাতে চোরা গর্তে না পড়ে।
খুব খাটো সুড়ঙ্গ, লম্বায় বড়জোর পনেরো ফুট, মেঝে থেকে ছাদ ছয় ফুট উঁচু কঠিন পাথুরে মেঝেতে পায়ের ছাপ পড়ে না। সুতরাং কেউ এসে থাকলেও ছাপ দেখে বোঝার উপায় নেই।
সুড়ঙ্গটা দিয়ে আরেকটা গুহায় ঢোকা যায়।
রবিন বলল, মনে হয় অনেক গুহা আছে এখানে। সুড়ঙ্গ দিয়ে যুক্ত। কোনটা দিয়ে কোনটায় ঢুকে গেছে লোকটা কে জানে।
আলো ফেলে দেখতে লাগল কিশোর। বিশাল এক গুহায় ঢুকেছে। চারপাশের দেয়ালে অনেক গর্ত, সুড়ঙ্গমুখ ওগুলো, বুঝতে অসুবিধে হলো না।
ঠোঁট কামড়াল কিশোর। আনমনে বিড়বিড় করল, একডজন গর্ত। কোনটা দিয়ে ঢুকেছে লোকটা, কি করে বুঝব?
চলো, প্রথমে সবচেয়ে বড়টা ধরেই যাই, পরামর্শ দিল মুসা। না পেলে ফিরে এসে বাকিগুলোতে ঢুকে দেখব।
ভাল বলেছ। চলো।
সোজা এগিয়েছে বড় সুড়ঙ্গটা। কিছুদূর এগিয়ে থমকে দাঁড়াল কিশোর।
আরেকটু হলে তার গায়ের ওপর এসে পড়ত মুসা। কি হলো?
দেখো! মাটির দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।
ওর কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বলে উঠল মুসা, আরি, পায়ের ছাপ।
পাহাড়ের গভীরে সুড়ঙ্গের মেঝেতে এখানে পাথর নেই, বালি। তার ওপর ভেজা ভেজা। সুতরাং ছাপ পড়েছে। স্পষ্ট বসে গেছে বুটের ছাপ।
মনে হয় ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা, কিশোর বলল। এসো।
উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তিনজনেই। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ঢুকল আরেকটা গুহায়। এটাও বিশাল। এখানে যতগুলো দেখেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। তিনটে টর্চের মিলিত আলোতেও দেয়াল বা ছাদের সমস্ত জায়গী একবারে দেখা গেল না।
পাথরের ছড়াছড়ি এখানে। মেঝেতে পাথর স্তূপ হয়ে আছে। দেয়ালে অসংখ্য সুড়ঙ্গমুখ।
আলো আরও বেশি হলে ভাল হত, রবিন বলল, ভাল করে দেখতে পারতাম।
আলোর ব্যবস্থা হয়তো করা যায়, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কিন্তু কত সুড়ঙ্গ দেখেছ? পাহাড়ের নিচে জালের মত বিছিয়ে আছে। সবগুলো দেখতে হলে অনেক সময় লাগবে। ততক্ষণ বসে থাকবে না লোকটা, যার পেছনে লেগেছি।
তবু আরেকটু খুঁজে দেখা দরকার।
আলোর ব্যবস্থা কি করে করবে? জানতে চাইল মুসা।
লাকড়ি দিয়ে মশাল বানাতে পারি, জবাব দিল কিশোর। তিনজনের হাতে তিনটে মশাল থাকলে অনেক আলো হবে। তা ছাড়া টর্চের ব্যাটারি ফুরানোরও ভয় থাকবে না।
চলো তাহলে, বানিয়ে নিয়ে আসি।
প্রথম গুহাটায় ফিরে এল ওরা।
লাকড়ির স্তূপের দিকে এগোতে গিয়ে ভুরু কুঁচকে গেল রবিনের। চেঁচিয়ে উঠল, একি!
কি হলো? একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল কিশোর আর মুসা।
তাকিয়ে আছে রবিন। টর্চের আলো ফেলেছে যেখানে ওদের জিনিসপত্র রেখেছিল সেখানে। খাবারের টিনগুলো সব গায়েব। পড়ে আছে কেবল খাওয়া পাউরুটির খানিকটা অবশিষ্ট আর মাছের একটা খালি টিন।
নিয়ে গেছে! কিশোর বলল।
নিশ্চয় সেই লোকটা, বলল রবিন, যার পেছনে আমরা লেগেছি। আমরা জেগে যাওয়ায় লুকিয়ে পড়েছিল। যেই আমরা গুহা থেকে বেরিয়েছি, চুপচাপ বেরিয়ে এসে খাবারগুলো সব চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।
খাবার আমাদের দরকার নেই আপাতত, কিশোর বলল, ওব্যাপারে চিন্তা না করলেও চলবে। চলো, যা করছিলাম, করি। লোকটাকে খুঁজে পেলে খাবারগুলোও ফেরত পাব।
ওর সঙ্গে কথা আছে আমার, রাগ চেপে বলল মুসা।
কথা আমাদেরও আছে।
কিন্তু গেল কোনদিকে? রবিনের প্রশ্ন।
জুতোর ছাপ যেখানে পেয়েছি, তার আশোঁপাশেই আছে হয়তো। যেখান থেকে এইমাত্র ফিরে এলাম ওদিকেই খুজব।
বাইরে চলে গিয়ে থাকে যদি?
মাথা নাড়ল কিশোর, মনে হয় না। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বোঝা নিয়ে বাইরে বেরোবে না সে। লুকিয়ে আছে এই পাহাড়ের নিচেই কোথাও।
হাতে কয়েকটা করে লাকড়ি নিয়ে বড় গুহাটায় আবার এসে ঢুকল তিনজনে। মশালের আলোয় ভাল করে দেখতে লাগল গুহাটা। এত বেশি সুড়ঙ্গমুখ আর ফাটল দেখা গেল, সবগুলোতে ঢোকার কথা ভেবে দমে গেল ওরা।
তবে হাল ছাড়ল না। একধার থেকে খোঁজা শুরু করল। কোনটা ছোট সুড়ঙ্গ, কোনটা বেশ লম্বা। কোন কোন ফাটলের ওপাশে কয়েক হাত দূরেই দেয়াল।
কোনখানেই লোকটার আর কোন চিহ্ন দেখা গেল না।
হতাশ হয়ে মুসা বলল, অহেতুক খুঁজে আর লাভ নেই। চলো, চলে যাই।
প্রথম গুহাটায় ফিরে চলল আবার ওরা।
.
বাকি রাতটা নিরাপদেই কাটল।
ঘুম ভাঙতে দেখল ওরা, ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। গুহা থেকেই চোখে পড়ল সাগরের রোদ ঝলমলে নীল জল! পর
পেটে মোচড় দিল মুসার। জিজ্ঞেস করল, কি করব? খাবার তো একদম নেই। আনতে যেতে হবে না?
হবে, বলে চুপ করে ভাবতে লাগল কিশোর।
রবিন বলল, লোকটাকে এখন আরেকবার খুঁজতে বেরোলে কেমন হয়?
ওকে পেলেই সমস্যা চুকে যায়, খাবারগুলো আদায় করে নিতে পারব।
মাথা নাড়ল কিশোর। লাভ হবে বলে মনে হয় না। রাতেই যখন পাইনি, ও কি আর এখন আমাদের জন্যে বসে আছে নাকি?
মুসা বলল, অ্যাই, কিশোর, এক কাজ তো করতে পারি, আমার মেটাল ডিটেক্টরটাকে কাজে লাগাতে পারি…
তাতে কি হবে? বাধা দিল রবিন। তুমিই তো সেদিন বললে এই যন্ত্র মানুষ খুঁজে বের করতে পারে না…
মানুষ না পাক, সূত্র তো খোঁজা যায়। এমনও তো হতে পারে, টিনগুলো সঙ্গে না নিয়ে আশপাশেই কোথাও লুকিয়ে রেখে গেছে লোকটা? ভারী বোঝা, একার পক্ষে বয়ে বেশিদুর নেয়া কষ্টকর।
ওর কথায় যুক্তি আছে। তবে অতটা আশা করতে পারল না বলে চুপ করে রইল কিশোর।
রবিন বলল, দেখো আধাঘণ্টা, তারপর না পেলে অহেতুক সময় নষ্ট না করে খাবার আনতে যাওয়াই উচিত হবে আমাদের। শরীরে শক্তি থাকতে থাকতে যাওয়া ভাল, এই পাহাড় পেরোনো চাট্টিখানি কথা না। কি বলো, কিশোর?
মাথা ঝাঁকিয়ে তার সঙ্গে একমত হলো কিশোর।
মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে কাজে লেগে গেল মুসা। তার ইচ্ছে কোনভাবে যন্ত্রটাকে ব্যবহার করা, খাবার পাক আর না পাক।
তবে কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই ওদেরকে অবাক করে দিয়ে সঙ্কেত দিতে শুরু করল যন্ত্রটা। গুহামুখের কাছে যেখানে সঙ্কেত দিল সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মুসা। একটা পাথরের আড়াল থেকে বের করল জিনিসটা। তুলে দেখাল সঙ্গীদের।
তাকিয়ে আছে রবিন, কি জিনিস?
পিস্তল! খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে মুসার। জলদস্যুর জিনিস, কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয় জাহাজডুবি হয়ে এখানে এসে উঠেছিল ওরা। বহুদিন আগে।
দেখি তো? হাত বাড়াল কিশোর।
হাতে নিয়ে ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আবার মুসাকে ফেরত দিতে দিতে বলল, বেশি পুরানো তো মনে হচ্ছে না।
রবিনও দেখল। তাই তো। একেবারেই মরচে পড়েনি। কোম্পানির নামটাও পড়া যাচ্ছে-স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন।
হ্যাঁ, স্পেনের তৈরি, কিশোর বলল।
আচ্ছা, এটা দিয়েই গুলি করা হয়নি তো? কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। গুহার মধ্যে রহস্যময় যে গোলাগুলির কথা বলল জেলেরা?
ওদের কথাবার্তায়, অবাক হয়ে দুজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। মূসা। এ সব বলে কি বোঝাতে চাইছ তোমরা?
বোঝাতে চাইছি, পিস্তলটা অত পুরানো নয়, যতটা তোমার মনে হচ্ছে।
তারমানে জলদস্যু নয়? আধুনিক পিস্তল দিয়ে আধুনিক কাজকারবার করছে কোন আধুনিক মানুষ?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
কাকে সন্দেহ হয় তোমার? মুসার প্রশ্ন 1 রহস্যময় হ্যারিস গেনার? মেরিন ডিগ?
হতে পারে, এখনও জানি না। তবে ডিগকেই বেশি সন্দেহ হয়।
সেই পিস্তলটা ফেলে গেছে এখানে?
তাও জানি না।
কেন ফেলবে?
সেটা জানলে তো অনেক প্রশ্নের জবাবই পেয়ে যেতাম।
দারুণ! একটা জটিল রহস্যের সূত্র খুঁজে বের করে দিলাম, দেখা যাক। আরও পারি কিনা। ক্ষুধার কথা ভুলে গিয়ে মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে আবার কাজে লেগে গেল মুসা।
খুঁজতে খুঁজতে গুহা থেকে বেরিয়ে সৈকতে চলে এল। বালিতে ঢাকা জায়গাটা সরে গেছে বিশাল কালো একটা পাথরের টিলার দিকে। সেটা ঘুরে আসতেই পাহাড়ের গায়ে একটা ফোকর দেখা গেল।
আরেকটা গুহা! ভুরু কুঁচকে ফেলল কিশোর।
ডিটেক্টর হাতে হাসিমুখে ওটার দিকে এগোল মুসা। এক গুহার মুখে পেয়েছে পিস্তল, আরেকটার মুখেও যদি কিছু পাওয়া যায়, এই আশায়।
গেল পাওয়া, সত্যিই! তবে ওটা পেতে ডিটেক্টর লাগল না, খালি চোখেই দেখা গেল গুহামুখের ঠিক ভেতরে একটা কাঠের তক্তা পুতে তাতে কাগজে কি যেন লিখে আঠা দিয়ে সাটিয়ে দেয়া হয়েছে। নিচের দিকের আঠা ছুটে গিয়ে বাতাসে ফড়ফড় করছে কাগজটা। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে টেনে সোজা করে পড়ল রবিন। কালো কালি দিয়ে বড় বড় করে লেখা হয়েছে:
প্রবেশ নিষেধ।
বিনা অনুমতিতে ঢুকলে সেটাকে
বেআইনী বলে গণ্য করা হবে।
লেখাটা তিনজনকেই অবাক করল। মুসা বলল, শিপরিজের পুলিশ চীফ হয়তো লাগিয়ে দিয়ে গেছে।
পুলিশের কি ঠেকা পড়েছে? রবিন বলল। মজা করেছে কেউ। ট্যুরিস্ট হতে পারে।
ভেতরে উঁকি দিল কিশোর। ঢুকবে কি ঢুকবে না ঠিক করতে পারছে না যেন। শেষে বেআইনী বলে গণ্য হওয়ার প্রতিই ঝোঁক বেড়ে গেল তার। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল, রসিকতা নয়, সত্যি এখানে নোক বাস করে!
অনুমতি নেয়ার জন্যে কাউকে দেখা গেল না। কৌতূহল না ঠেকাতে পেরে শেষে বেআইনী কাজ করে বসল তিনজনেই। ঢুকে পড়ল ভেতরে। গুহায় আলো তেমন নেই, গুহামুখ দিয়ে সামান্য যা ঢুকছে। আনাড়ি হাতে তৈরি একটা কাঠের টেবিল পড়ে আছে এককোণে। মাটিতে বিছানো একটা মলিন গদি, তার ওপর কম্বল পাতা। সাবানের বাক্সের কাঠ দিয়ে তৈরি একটা আলমারি রাখা হয়েছে একটা চ্যাপ্টা পাথরের ওপর। তাতে ভরা টিনের খাবার।
যাক বাবা, বাঁচা গেল, খুশি হয়ে বলল মূসা, আমাদের একজন পড়শী আছে, তার কাছে খাবারও আছে। খালি পেটে পাহাড় পেরোতে হলো না আর।
আস্তে! সাবধান করল রবিন। ফিসফিস করে বলল, ওই যে, আসছে আমাদের পড়শী।
সৈকত ধরে হাঁটতে দেখা গেল একজন লম্বা মানুষকে। ধূসর চুল। গায়ে নীল শার্ট, পরনের ওভারঅলের পা দুটো ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে উঁচু গোড়ালিওয়ালা রবারের বুটের ভেতরে। বা হাতে একটা বিউগল। সাগরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল। বিউগল ঠোঁটে লাগিয়ে ফুঁ দিল জোরে। একবার বাজিয়ে বিউগল নামিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছল, তারপর ঘুরে এগিয়ে আসতে শুরু করল গুহার দিকে।
গুহামুখে বেরিয়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা। ওদের দেখে থমকে দাঁড়াল সে। নিজের অজান্তেই যেন বিউগল বাজাল আরেকবার। আবার পা বাড়াল।
আমি কমান্ডার জিন মরিস, কুইন্স নেভি, অবসরপ্রাপ্ত, ছেলেদের কাছে এসে ঘোষণা করল সে। আমাকে তোমাদের স্যালুট করা উচিত ছিল। বুঝতে পারছি, নেভির নিয়ম-কানুন কিছুই জানেন না তোমরা। স্যালুট করতে জানো?
নিখুঁত ভাবে স্যালুট করল তিন গোয়েন্দা।
খুশি হলো লোকটা, জিজ্ঞেস করল, বাহ, জানো তো দেখি। কিন্তু নাবিক বলে তো মনে হচ্ছে না।
হেসে জবাব দিল কিশোর, নাবিকরাই কি শুধু স্যালুট দেয়?
তাও বটে। তা ছাড়া সবাইকেই নাবিক হতে হবে, এমনও কোন কথা নেই।
এই গুহাতে আপনিই বাস করেন নাকি? জানতে চাইল রবিন।
হ্যাঁ, ডাঙায় আপাতত এটাই আমার ঘর। তোমাদেরকে তো চিনলাম না?
পরিচয় দিল তিন গোয়েন্দা।
হাত মেলানোর পালা শেষ করে কমান্ডার বলল, সচরাচর এখানে কেউ আসে না। আর না এলেই ভাল। আমি একা থাকতেই ভালবাসি। লোকের কোলাহল আমার ভাল লাগে না।
জায়গাটা একেবারেই নিরিবিলি, কিশোর বলল।
আছে, তবে অতটা না। যাতায়াতের অসুবিধে খুব বেশি নেই তো, পাহাড়টা পেরোলেই হলো, মাঝেসাঝে চলে আসে লোকে। গুহা দেখতে আসে টুরিস্ট, জেলেরা নামে বিশ্রাম নিতে। আমার জন্যে সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল দক্ষিণ সাগরের সেই দ্বীপটা, যেখানে নির্বাসিত হয়েছিলাম আমি।
মানুষটার ব্যাপারে নতুন করে কৌতূহল দেখা দিল তিন গোয়েন্দার।
খাইছে! মুসা বলে উঠল। নির্বাসিত হয়েছিলেন?
কোন অপরাধে? কে দিল নির্বাসন? প্রশ্ন করল রবিন।
কেউ দেয়নি। নিজে নিজেই হয়ে গেলাম। বেশ কয়েক বছর আগে একটা ডেস্ট্রয়ারে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলাম। দক্ষিণ সাগর দিয়ে চলছিল জাহাজ। খাওয়ার পানি নেয়ার জন্যে একটা ছোট দ্বীপে নোঙর করলাম। ম্যাপে নেই ওই দ্বীপ, নাম খুঁজে পাবে না। গরমও পড়েছিল সেদিন, সাংঘাতিক গরম। ছায়ার মধ্যেও একশো ডিগ্রির বেশি। আমার লোকেরা যখন পানি তুলছে জাহাজে, আমি বসলাম একটা ক্যাকটাসের ছায়ায় জিরাতে। কখন ঘুমিয়ে গেলাম বলতে পারব না।
আপনাকে ওখানে ফেলেই চলে গেল নাবিকেরা? আন্দাজ করল রবিন।
হ্যাঁ।
কিন্তু কমান্ডারের খোঁজ করল না একবারও?
ওরা জানতই না আমি নিচে নেমেছি। গাছের গোড়ায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছি এটা কল্পনাই করতে পারেনি কেউ। ঘুম ভাঙলে দেখলাম, জাহাজটা চলে গেছে, সিন্দবাদ নাবিকের মত আমি একা পড়ে আছি ওই দ্বীপে।
দারুণ ব্যাপার তো! তারপর? জানতে চাইল মুসা। বাচলেন কি করে?
কি করব বুঝতে পারলাম না প্রথমে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটার পর মনে হলো, ফেলে গেছে, ভালই হয়েছে। রবিনসন ক্রুসো হয়ে কাটাব। একটা কুঁড়ে বানিয়ে ছয়টা মাস একা কাটিয়েছি ওই দ্বীপে। একেবারে একা, শুধু আমি।
আপনাকে নিতে ফিরে যায়নি জাহাজটা?
যায়নি। পরে জেনেছি দ্বীপটা নাকি খুঁজে পায়নি ওরা। তবে আমার বিশ্বাস, মিথ্যে কথা বলেছে। যায়ইনি ওরা! জাহাজের কোয়ার্টার মাস্টার, যে আমার জায়গাটা দখল করেছিল সে আর খুঁজে বের করতে যায়নি। তাহলে আবার তাকে কমান্ডারের পদটা হারাতে হত।
দ্বীপে থাকতে খেয়েছেন কি?
খাওয়ার অভাব ছিল না। শুয়াপোকা থেকে শুরু করে পাখি আর কচ্ছপের ডিম, যা পেয়েছি সব খেয়েছি। আদিবাসীরা যদি এ সব খেয়ে তাগড়া জোয়ান হয়ে বেঁচে থাকতে পারে, আমি পারব না কেন?
তা বটে। অথৈ সাগর অভিযানে বেরিয়ে দক্ষিণ সাগরের দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে বেচে থাকার জন্যে এ সব আজেবাজে জিনিস খাওয়ার অভিজ্ঞতা তিন গোয়েন্দারও আছে। অবাক হলো না ওরা।
তবে খাবারের কথা উঠে পড়ায় সুযোগটা ছাড়ল না মুসা, বলে বসল, আমাদের খাবার ফুরিয়ে গেছে। আপনার কাছে কি কিছু ধার পাওয়া যাবে?
চুপচাপ উঠে চলে গেল কমান্ডার। ফিরে এল একটা পাউরুটি আর একটিন মাছ নিয়ে। মুসার হাতে দিতে দিতে বলল, চলবে এতে?
চলবে মানে! কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আরও দুচারটা টুকটাক কথাবার্তার পর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের গুহার দিকে রওনা হলো গোয়েন্দারা। সকালে নাস্তাটা তেমন জমেনি, খিদে পেয়ে গেছে। টিন থেকে মাংস বের করে রান্না করতে বসে গেল মুসা।
খাওয়ার পর বলল সে, এখন নিশ্চিন্তে রওনা হওয়া যায়।
কোথায়? আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কোথায় আবার, খাবার আনতে। একবেলা খেয়েই কি শেষ হয়ে গেল নাকি? খানিক পরেই তো আবার খিদে লাগবে।
ওর দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন দুতিনবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এখনই যাব? অন্যমনস্ক হয়ে আছে ওর ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল।
এখনই তো যাওয়া উচিত। দেরি করলে রোদ চড়বে, খিদে লাগবে…
আচ্ছা লোকটাকে তোমাদের কেমন লাগল?
জিন মরিসের কথা বলছ? রবিন বলল, মোটেও ইংরেজ মনে হয়নি। আমার। ব্রিটিশ নেভিতে চাকরি করার কথাটা বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমিও না, কিশোর বলল। চিন্তাটা সেজন্যেই হচ্ছে
আচ্ছা, আমাদের খাবার এই লোকই চুরি করেনি তো?
কথাটা আমারও মনে হয়েছিল। ভাল করে দেখেছি। তার খাবারের ভাঁড়ারে আমাদের টিনগুলো নেই।
লোকটাকে অবশ্য এতটা খারাপ মনে হয়নি আমার।
তবু কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারলে ভাল হত। বলা তো যায় না কার মনে কি আছে।
চলো তাহলে, যাই আবার।
এখনই?
গেলে এখনই। দেরি করলে আমাদের রওনা হতে দেরি হয়ে যাবে।
বেশ। চলো।
আবার কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে চলল ওরা। গুহার ভেতরে আগুনের ধারে বসে আছে সে। পাশে পড়ে আছে একটা ফ্রাইং প্যান। এইমাত্র খাওয়া শেষ করেছে বোঝা গেল।
শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল কমান্ডার। ভোঁতা গলায় ধমকে উঠল, কে তোমরা?
আমরা! অবাক হয়ে বলল কিশোর, আরে আমরা, চিনতে পারছেন না? তিন গোয়েন্দা, একটু আগেই তো দেখা হলো…
যাও, ভাগো এখান থেকে! এখানে ঘুরঘুর করা আমার পছন্দ না।