৩. কমান্ডারের আচরণে চমকে গেল তিন গোয়েন্দা

0 Comments

গুপ্তচর শিকারি – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান
প্রথশ প্রকাশ: আগস্ট, ১৯৯৬

কমান্ডারের এহেন আচরণে চমকে গেল তিন গোয়েন্দা। হাঁ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

কিন্তু, স্যার, বলল রবিন, এই খানিক আগে অপিনিই…

স্যার স্যার করতে হবে না আর! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কমান্ডার। মুঠো চাল ছেলেদের দিকে। যাও এখন। বেরোও। আমাকে একা থাকতে দাও।

রবিনের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল কিশোর, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, বোঝানো যাবে না কমান্ডারকে।

ফিরে চলল তিনজনে।

গুহার কাছ থেকে সরে এসে মুসা বলল, ও ব্যাটা পাগল। বদ্ধ উন্মাদ! একা থাকতে থাকতে মাথাটা পুরোপুরিই গেছে!

হুঁ! কিশোর বলল, যতই দেখছি নোকটাকে, ততই অবাক হচ্ছি। সন্দেহ বাড়ছে আমার।

কোন ব্যাপারে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

তা জানি না। তবে মন বলছে, রহস্য একটা অবশ্যই আছে এখানে।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের আসল রহস্যের তো কিনারা হলো না। একটা করতে এসে আরেকটাতে জড়িয়ে পড়ছি। হ্যারিস গেনারের খোঁজ নেয়ার দরকার না?

কার কাছে নেব?

তার আমি কি জানি? হাত ওল্টাল রবিন।

একটা ব্যাপার কিন্তু হতে পারে, হয়তো শিপরিজে এ সব গুহাতে খোঁজ নেবার কথাই বলেছে গেনার। গুহাগুলোতে যে রহস্য আছে, তার প্রমাণ তো ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি আমরা। একটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল কিশোর, ঠিক আছে, চলো আগের কাজ আগে সারি, তারপর অন্য কথা। প্রথমে রিক ডেলভারের কাছে যাব খাবার চাইতে। তার কাছে না পেলে শিপরিজে দোকানে যেতে হবে।

মনে কোরো তো এবার, বড়শিটা নিয়ে আসব এবার, মুসা বলল। ঝড়-বৃষ্টির পর মাছে খায় ভাল। মাছ পেলে খাবারের সমস্যা অনেকটা মিটবে।

কেন, আসার সময় বড়শি তো নিলে দেখলাম? রবিনের প্রশ্ন। কোথায় ফেললে?

আমারও মনে হচ্ছে এনেছি, কিন্তু সকালবেলা খুঁজতে গিয়ে দেখি নেই। হয় খাবার চোরই ওগুলো গাপ করে দিয়েছে, নয়তো ভুলে আনিইনি। গাড়িতে ফেলে এসেছি। ঠিক মনে করতে পারছি না। গুহার কাছে এসে জিজ্ঞেস করুল মুসা, আমাদের জিনিসপত্রগুলো কি করব? এখানে ফেলে গেলে না ওগুলোও চুরি হয়ে যায়।

মনে হয় না, কিশোর বলল, তাহলে রাতেই চেষ্টা করত। কেবল খাবারের ওপরই নজর ছিল চোরের।

ঠিক আছে, সব জিনিস ফেলে গেলেও ডিটেক্টরটী ফেলে যাচ্ছি না। যাওয়ার সময় খুঁজতে খুঁজতে যাব, খোঁজাও হবে, সময়ও কাটবে।

কি খুঁজবে তুমি? রবিনের প্রশ্ন।

কি করে বুলব? মাটির নিচে, পাহাড়ের খাঁজে কত জিনিসই থাকতে পারে। জলদস্যুর গুপ্তধনও থাকতে পারে। এই যে খানিক আগে একটা নতুন পিস্তল পেয়ে গেলাম, এটা কি কম কথা?

পিস্তলের কথায় মনে পড়ল কিশোরের, ওহহো, কোথায় ওটা?

লুকিয়ে রেখেছি, মুসা জানাল। কেন, দরকার?

না। লুকানো আছে, থাক। বলা যায় না, ওটা একটা জরুরী সূত্র হতে পারে।

রওনা হলো ওরা। ডিটেক্টরটাকে লাঠির মত করে সামনে বাড়িয়ে ধরে হাঁটছে মূসা। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেইবিকট চিৎকার করে উঠল।

আগে আগে হাঁটছিল রবিন আর কিশোর। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল।

পাহাড়ের দেয়ালের কাছে উন্মাদ নৃত্য জুড়েছে মু। কড়কড় কড়কড় করছে ওর যন্ত্র। যেন পাল্লা দিয়ে চিৎকার করছে মনিবের সঙ্গে।

চিৎকার করে বলল সে, এখানে একটা-দুটো পিল নয়, পুরো এক অস্ত্রাগার রয়েছে। যন্ত্রটাকি ভাবে চিৎকার করছে দেখো।

যন্ত্রের চেয়ে তো বেশি চেঁচাচ্ছ তুমি, কিশোর কাল। চুপ করো না। দেখোই না আগে কি আছে।

পাহাড়ের গোড়ায় একটা পাথরের কাছে যন্ত্রটা নিয়ে গেলেই শব্দ করছে। পাথরটা সরানোর জন্যে হাত বাড়াল কিশোর আর রবিন। যন্ত্র ধরে রেখেছে মুসা, ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে লুকানো হাড়ের সন্ধান পেয়েছে ক্ষুধার্ত ককর।

পাখরটা সরাতেই দেখা গেল একটা গর্ত। ভেতরে একটা বস্তা। তার ভেতর থেকে বেরোল ওদের খাবারের টিনগুলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।

এই তো আমার বড়শি বলে উঠল মুসা। তারমানে ঠিকই এনেছিভুলিনি, খাবারের সঙ্গে এগুলোও চুরি করেছিল ব্যাটা।

জিনিসগুলো তাহলে বের করেই ছাড়লে, হাসতে হাসতে বলল কিশোর।

যন্ত্রটার গায়ে আদর করে হাত বুলিয়ে মুসা বলল, পয়সা উসুল। এত … উপকার করবে এটা কল্পনাও করিনি। বাঁচালি তুই, ডিটেক্টর। উফ, পাহাড় ডিঙানোর কথা ভাবতেই হাত-পা সেধিয়ে যাচ্ছিল আমার পেটের মধ্যে।

খাবার দেখেই খিদে মাথা চাড়া দিল ওর। গুহায় ঢুকে আগুন জ্বেলে, ফ্রাইং প্যান বের করে রাখতে বসে গেল। মাংস ভাজার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।

রবিন আর কিশোর আলোচনা করছে বস্তাটা গর্তে কে রাখল, সেটা নিয়ে। কমান্ডারের প্রসঙ্গ উঠল।

তাকে প্রশ্নগুলো করা হলো না, কিশোর বলল, দাঁড়াতেই দিল না আমাদের।

দেবে কি? পাগল তো। মুসার কথাই ঠিক–ওর মাথায় বড় রকমের গোলমাল আছে, তাতে আমারও কোন সন্দেহ নেই।

হতে পারে, আবার নাও হতে পারে, রহস্যময় স্বরে বলল কিশোর। যাই হোক, প্রশ্নগুলো ওকে করতেই হবে, যেভাবেই হোক।

মাংস ভাজা সেরে ডিম ভাজছে মুসা।

সেদিকে একবার তাকিয়ে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, কি প্রশ্ন করবে? মেরিন ডিগকে এদিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে কিনা?

খাবার রেডি, ঘোষণা করল মুসা। দেরি করলে ভাগে কম পাবে।

তাড়াতাড়ি যার যার প্লেট মেলে দিল কিশোর আর রবিন। খাবার তুলে দিল মুসা।

এক চামচ ডিম মুখে ফেলে আগের প্রশ্নটাই করল কিশোরকে রবিন, কই, বললে না কি প্রশ্ন করবে?

কিন্তু জবাব দিল না কিশোর। অন্যমনস্ক হয়ে রইল।

মুসা বলল, ডিগ আর কমান্ডারকে নিয়ে যত খুশি গবেষণা করো তোমরা, খাওয়ার পর আমি আর এসবে নেই। আমি যাব মাছ ধরতে। খাবার চুরি করে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে শাস্তি দেয়ার সুযোগ আর দেব না চোরটাকে।

কোথায় ধরবে? জানতে চাইল রবিন।

ঢালের নিচে চলে যাব। অনেক লম্বা সুতো; ঢালের ওপরে বসলেও বেড় পাওয়া যাবে।

আবার চোরের আলোচনায় ফিরে এল রবিন। নিজে খাওয়ার জন্যে নিয়ে যায়নি, বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে চুরি করল কেন?

আমাদের এখান থেকে তাড়ানোর জন্যে; সহজ জবাব, কিশোর বলল। সে চায় না আমরা এখানে থাকি।

কমান্ডারকে সন্দেহ হয় তোমার? মুসার প্রশ্ন।

এক মুহূর্ত চুপ থেকে জবাব দিল কিশোর, ওই লোক হতে পারে, কিংবা অন্য কেউ। একজন হতে পারে, কিংবা একাধিক।

এটা তো কোন জবাব হলো না।

ঠিক। জবাবটা জানলে তো দেব।

যাই হোক, রবিন বলল, দ্বিতীয়বার আর চুরি করতে দিচ্ছি না ওকে। খাদের পাশে পাহাড়ের গায়ে একটা খাজ দেখে এসেছি। ওর মধ্যে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখব। হাজার খুঁজলেও আর পাবে না ব্যাটা।

খাওয়া শেষ করে আগুন নেভাল ওরা। বেরিয়ে পড়ল। ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে চলল মুসা। কিশোর আর রবিন খাবারের টিনগুলো নিয়ে চলল খাদের ধারে পাহাড়ের খাজে লুকাতে।

লুকানো সেরে রবিন জিজ্ঞেস করল, কমান্ডারের ওখানে যাবে নাকি। আবার?

মাথা ঝাঁকাল কিশোর, যাব।

যদি মারতে আসে?

 পালিয়ে আসব। তবে প্রশ্নগুলো না করা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।

কমান্ডারের গুহায় রওনা হলো দুজনে।

দূর থেকেই দেখল, গুহার সামনে কি যেন করছে বুড়ো নাবিক। কাছে গিয়ে দেখল, একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে কিছু আঁকছে সে। ওদের সাড়া পেয়ে জুতো দিয়ে ডলে তাড়াতাড়ি মুছে ফেলল। হাক দিল, এই যে ছেলেরা, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?

পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। আরেকবার অবাক করেছে। ওদের কমান্ডার।

কিশোর জবাব দিল, হ্যাঁ। আমাদের চিনতে পেরেছেন?

 পারব না কেন, নিশ্চয় পেরেছি।

কই, তখন তো পারলেন না?

পারিনি নাকি? কি জানি! মাথা চুলকাল কমান্ডার, মাঝে মাঝে মাথাটার মধ্যে কি যে হয়ে যায়…যাকগে, তোমাদের আরেক বন্ধু কোথায়?

মাছ ধরতে গেছে। পাহাড়ের ঢালের নিচে।

ও। ওদিকটায় যাওয়া ঠিক হয়নি। জায়গা ভাল না।

 কেন ভাল না, জিজ্ঞেস করল রবিন। জবাব পেল না।

আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে, পিঠের ওপর দুহাত নিয়ে গিয়ে, একহাত দিয়ে আরেক হাতকে আঁকড়ে ধরে গুহামুখের সামনে পায়চারি শুরু করল কমান্ডার।

কমান্ডার মরিস, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার গুহার সামনে কোন লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন?

যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল কমান্ডার। চোখ সরু করে তাকাল কিশোরের দিকে। দেখো, আমি একজন সন্ন্যাসী, জায়গাটা অতিরিক্ত নির্জন দেখে একা বাস করতে এসেছি এখানে। আমার কাছাকাছি কেউ আসে না। ওরা ভাবে আমি পাগল।

গেনার আর ডিগের চেহারার বর্ণনা দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এ রকম কাউকে দেখেছেন?

বললাম না কেউ আসে না!

তবু, একটু ভাল করে ভেবে যদি বলেন…চোখে হয়তো পড়েছিল, ভুলে

না, ভুলিনি…দাঁড়াও, দাঁড়াও… ভাবতে গিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল কমান্ডার।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল দুই গোয়েন্দা। ভাবছে, গেনারকে কি দেখেছে সত্যি?

কাকে দেখেছেন? জানতে চাইল কিশোর। যে দুজনের কথা বললাম, তাদের কোনজন?

প্রথমজন।

গেনার?

হ্যাঁ, একবার ওরকম চেহারার একজনকে দেখেছিলাম বটে। ফিলিপাইনে আমার ক্রুজারের মেট হয়েছিল।

হতাশায় মুখ বাঁকাল রবিন। এই পাগলের কাছ থেকে কোন তথ্য আদায় করার চেষ্টা বৃথা।

কমান্ডার বলতে থাকল, ওর নাম মনে পড়েছে আমার, গেনারই ছিল। আমাকে জাহাজ ছাড়তে বাধ্য করেছিল সে। জংলীরা এসে ঢাক বাজানো। শুরু করল। ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শেষে আনারস গাছে চড়ে বাঁচলাম।

কিশোরের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল রবিন, আবার গেছে ওর মাথাটা। আর কথা বলে লাভ নেই।

বকবক করেই চলেছে কমান্ডার। কোন দিকে খেয়াল নেই।

পাগলকে প্রশ্ন করে কি হবে!। কিশোর বলল, ঠিক আছে, কমান্ডার, আমরা এখন যাই।

ওর কথার জবাব না দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল কমান্ডার, সাঁতার। কাটতে যেতে হবে আমাকে। প্রচণ্ড গরম। আফ্রিকার কাছাকাছি এলেই এ রকম গরম লাগে। কারও দিকে তাকাল না সে। আর একটাও কথা না বলে ঘুরে গিয়ে ঢুকল তার গুহায়।

সৈকতে ফিরে চলল দুই গোয়েন্দা। শুহামুখের কাছ থেকে সরে এসে রবিনের হাত ধরে একটা বড় পাথরের আড়ালে তাকে টেনে নিয়ে এল কিশোর।

অবাক হলো রবিন। কি ব্যাপার?

দাঁড়াও, ও কি আসলেই পাগল, না আমাদের দেখলে ভান করে, সেটা বুঝতে চাই। পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দিল কিশোর।

কি দেখছ?

ও বেরোয় কিনা।

বেরোলে কি করবে?

জবাব দিল না কিশোর। তাকিয়ে আছে গুহার দিকে।

কয়েক মিনিট পরই গুহা থেকে বেরিয়ে এল কমান্ডার। পরনে শুধু হাফপ্যান্ট। এদিক ওদিক তাকাল। তারপর এগিয়ে আসতে শুরু করল। ভাবভঙ্গিতে এখনও বোঝা যাচ্ছে না পাগল না ভালমানুষ।

রবিনকে নিয়ে পাথরের আড়ালে আরেকটু সরে গেল কিশোর।

পাশ দিয়ে চলে গেল কমাণ্ডার। দেখতে পেল না ওদের।

ফিসফিস করে রবিন বলল, যাচ্ছে কোথায়, বলো তো? সত্যি সাঁতার কাটবে নাকি?

যাক যেখানে খুশি। এসো। এত তাড়াতাড়ি সুয়োগ দেবে কল্পনাই করিনি।

কিসের সুযোগ।

ওর গুহায় ঢোকার। চলো, জলদি!

পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে একছুটে কমান্ডারের গুহার কাছে চলে এল ওরা। ঢুকে গেল ভেতরে।

বাপরে! গভীর কত! রবিন বলল। পেছনের কিছুই দেখা যায় না।

কিশোর খুঁজছে একদিকে, রবিন আরেক দিকে। পাথরের একটা তাকের কাছে চলে এল সে। চিৎকার করে বলল, দেখে যাও!

রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর। একনজর তাকিয়েই বলে উঠল, বাহ, বন্দুকও আছে! রহস্যময় গুলির শব্দের রহস্য ভেদ হলো। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তাকের কাছে। শটগানটার কাছে পড়ে আছে পুরানো একটা নোটবুক আর একটা ক্যাপ। ক্যাপটা হাতে নিয়ে কি যেন ভাবল সে। আগের জায়গায় রেখে দিয়ে নোটবুকটা তুলে নিল।

কোডবুক! পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল সে। দূর, আলো এত কম, কিচ্ছু দেখি না। বাইরে চলো।

কি লেখা আছে জানার জন্যে অস্থির হয়ে গেল রবিনও।

গুহামুখের দিকে রওনা দিল দুজনে।

কিন্তু বেরোনোর আগেই মুখ জুড়ে দাঁড়াল কমান্ডার। আলো আসার একমাত্র পথটা আটকে দিয়ে আরও অন্ধকার করে দিল গুহা। ওদের দেখে চিৎকার করে উঠল, চোর! চোর কোথাকার! চুরি করতে ঢুকেছ আমার গুহায়! নোটবুকের জন্যে হাত বাড়াল, দাও ওটা!

দিল না কিশোর। চট করে সরে গেল ভেতরে।

 ওকে ধরার চেষ্টা করল না কমান্ডার। দৌড় দিল তাকের দিকে।

সাবধান, কিশোর, চেঁচিয়ে বলল রবিন, বন্দুক আনতে যাচ্ছে ও!

.

গুহামুখের দিকে দৌড় দিল কিশোর। পেছনে রবিন।

ওরা বেরোনোর আগেই তাকের কাছে পৌঁছে গেল কমাণ্ডার। বন্দুক তুলে হুমকি দিল, খবরদার, এক পা নড়লেই গুলি খাবে?

হোঁচট খেয়ে যেন দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। তার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রবিন।

ফিরে তাকাল দুজন।

ওদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখে এগিয়ে এল কমান্ডার। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তাহলে এই নোটবই চুরি করার জন্যেই আমার গুহায় ঢুকেছিলে। আস্তে করে মাটিতে রেখে দাও ওটা। চালাকি করতে গেলে মরবে।

চালাকি করতে গেল না কিশোর। পাগলের হাতে শটগান-ভয়ানক ব্যাপার, কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাইল না সে। যা করতে বলা হলো, করল।

রবিন বলল, নোটবই চুরি করতে না, এমনি ঢুকেছিলাম। স্রেফ কৌতূহল।

আচমকা প্রশ্ন করল কিশোর, ক্যাপটা কার, কমাণ্ডার?

 ভুরু কুঁচকে ফেলল কমান্ডার। মানে?

মানে, ওটা কার জিজ্ঞেস করছি। আপনার বলে তো মনে হয় না। নাবিকেরা এ জিনিস পরে না।

তাহলে কে পরে?

আর কেউ আছে নাকি এখানে?

থাকলে সে এখন কোথায় গেল? ধমকে উঠল কমাণ্ডার।

 সেটা তো আপনি বলবেন।

আমি কিছুই বলতে পারব না, কারণ আমি কিছু জানি না।

এই ক্যাপটা কোথায় পেলেন?

একমুহূর্ত চিন্তা করে নিল কমাণ্ডার। জবাব দেবে কিনা ভাবল বোধহয়। বলল, শিপরিজে হ্যারির দোকান থেকে কিনেছি। কুইন্স নেভি রসদ পাঠাতে ভুলে গিয়েছিল। শেষে দোকান থেকে জিনিসপত্র কিনে আনতে বাধ্য হলাম।

ওর কথার একবর্ণ বিশ্বাস করল না কিশোর। প্রকাশ করল না সেটা। পাগল খেপালে বিপদ। কি করে বসে ঠিকঠিকানা নেই।

আবার গুহায় ঢুকলে ভাল হবে না–শাসিয়ে দিয়ে, ওদের বেরিয়ে যেতে বলল কমান্ডার।

বেরোতে সামান্যতম দেরি করল না দুজনে। নিজেদের গুহার দিকে এগোচ্ছে, এই সময় দেখল মুসাও আসছে। হাতে ছিপ আর কাঁধে বিশাল এক মাছ ঝুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে এল সে। কাছে এসে বলল, দেখো কি ধরেছি!

হেসে বলল রবিন, কি এটা, তিমির বাচ্চা?

সী ব্যস।

কি করে মাছটা ধরেছে সেই বীরত্বের কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনা করতে গিয়ে খেয়াল করল মুসা, তার কথায় বিশেষ মনোযোগ নেই কিশোরের। কি হয়েছে জানতে চাইল সে।

জানাল কিশোর।

মাথা নেড়ে মুসা বলল, আজব লোক। এখানে করছে কি আসলে লোকটা?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না, কিশোর বলল।

ক্যাপটা কার? গেনারের না তো?

সে রকমই সন্দেহ করছি।

 তুমি বলতে চাও, সে এখানেই কোন গুহার মধ্যে আটকে আছে?

অসম্ভব কিছু না। তবে যেটা ধারণা করছি সেটা হলো, সে আর ডিগ এসেছিল এখানে। দেখতে পেয়ে গুলি করেছিল মরিস। পালিয়েছিল দুজনে। পালানোর সময় তাড়াহুড়োতে ক্যাপটা খুলে পড়ে যায় গেনারের মাথা থেকে, তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পায়নি।

এটা যে ওরই ক্যাপ, কি করে বুঝলে?

গুহায় ফিরে ছবিটা দেখে নিয়ো, ব্যাগের মধ্যে রেখেছি, তাহলেই বুঝবে।

হুঁ, নাটক তাহলে জমে উঠেছে, মাথা দোলাল মুসা। জানো, আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। দেখলে তোমরাও অবাক হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে একটা ধাতুর খনিটনি আবিষ্কার করে বসেছি।

শুনেই অবাক হয়ে গেল রবিন, ধাতুর খনি!

সোনার খনিও হয়ে যেতে পারে, মুসা বলল। এমন হতে পারে, খনিটার খোঁজ পেয়েই এখানে এসে হাজির হয়েছে কমান্ডার। সোনা তুলে নিয়ে যেতে চায়। অন্য কাউকে আসতে দেখলে রেগে যায় সেজন্যে। নোটবইটাতে হয়তো খনির নকশা আঁকা আছে।

ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে কিশোর আর রবিন।

কি ঘটেছে, খুলে বলল মুসা। মাছটা ধরার পর মেটাল ডিটেক্টরটা ব্যবহারের ইচ্ছে হয়েছিল ওর। মাটির নিচে বিশাল কিছু থাকার সঙ্কেত দিয়েছে যন্ত্র।

কিশোর বলল, চলো তো দেখি।

 আগে খনি দেখবে, না মাছের কাবাব খাবে?

খাওয়া-টাওয়া পরে। চলো আগে, তোমার খনি দেখব।

এক মিনিট দাঁড়াও। চট করে মাছটা গুহায় রেখে আসি আমি।

ডিটেক্টরটা কোথায়?

 পাহাড়েই ফেলে এসেছি। জানি তো, তোমরা দেখতে যাবে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই খাদ পেরিয়ে আবার পাহাড়ের ওপর এসে উঠল তিনজনে। জায়গাটা দেখিয়ে দিল মুসা।

ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে যন্ত্রটা মাটির কয়েক ইঞ্চি ওপরে ধরল রবিন। শুনতে শুনতে চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। ইয়ারফোনটা কান থেকে খুলে কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সাংঘাতিক কাণ্ড! সত্যি কিছু আছে। এখানে। কানের মধ্যে মনে হলো মেশিনগানের গুলি ফুটল।

যন্ত্রটা হাতে নিয়ে কিশোরও পরীক্ষা করে দেখল। ডান থেকে বাঁ দিকে সরে যেতে লাগল। সরতে সরতে কয়েক গজ চলে গেল, তাও শব্দ বন্ধ হয় না। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, আশ্চর্য! ঘটনাটা কি? কি আছে এখানে? মাটির তলা দিয়ে সোজাসুজি চলে, গেছে লম্বা কোন জিনিস।

পাইপটাইপ না তো? রবিন বলল।

কিসের পাইপ? মুসা বলল। এমন একটা জায়গায় পানির পাইপ কসাতে আসবে কে? আভাউড ড্রেনেরও কোন প্রয়োজন নেই এখানে।

যাই থাক, নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর, জিনিসটা গেছে পুর থেকে পশ্চিমে, সাগরের তীর থেকে মহাসড়কের দিকে।

দাঁড়াও, কি আছে ওদিকে রাস্তার ধারে, দেখছি, রবিন বলল।

কয়েকটা পাইন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে জমে আছে একজায়গায়। তারই একটাতে চড়ল সে। পশ্চিমে তাকাল।

কি আছে? নিচে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

একটা বাড়ি। ডিশদেখেমনে হচ্ছে রাডার স্টেশন।

 আর কিছু না?

আর কিছু না।

নেমে এল রবিন।

খুড়ে দেখলে হত নিচে কি আছে, মুসা বলল।

তার জন্যে শাবল-কোদাল দরকার। কোথায় পাবে? রবিন বলল।

সেটা অত সমস্যা নয়। ব্রিক ডেলভারের কাছে গেলেই পাওয়া যাবে। রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। চলো, গিয়ে নিয়ে আসি। মুসা ততক্ষণে মাছটার একটা ব্যবস্থা করে ফেলক।

মুসা চলে গেল গুহার দিকে। কিশোর আর রবিন রওনা হলো ডেলভারের কেবিনে।

আসার সময় অচেনা পর্ব ছিল, তার ওপর ঝড়বৃষ্টি, সেজন্যে বড় বেশি দাম আর অনেক লম্বা মনে হয়েছিল পথ। এখন তার অর্ধেকও লাগল না। অল্প সময়েই চলে এল ডেলভারের কেবিনে।

বুড়োকে পাওয়া গেল না। মাছ ধরতে গেছে। তবে মহিলা আছে বাড়িতে। চমৎকার একটা হাসি উপহার দিয়ে তার কাছ থেকে একটা শাবল আর একটা কেলচা চেয়ে নিল রবিন। আবার রওনা হলো গুহার দিকে।

গুহায় ফিরে দেখল গনগনে আগুনের সামনে বসে আছে মুসা। মাছের কাবুব ঝমানো হয়ে গেছে প্রায়। গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।

দুই দুইবার পাহাড় ডিঙিয়ে এসে প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে কি, মার রবিনের। গপ গপ করে খেতে শুরু করল ও।

খাওয়ার পর আগুন নিভিয়ে দিয়ে তিনজনে মিলে রওনা হলো জায়গাটা খুঁড়ে দেখতে।

খুঁড়তে খুঁড়তে তিন ফুট খুঁড়ে ফেলেও ধাতব জিনিসটার দেখা মিলল না।

বেলচায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রবিন বলল, কই, মুসার খনির তো চিহ্নও নেই। কিশোর, ঘটনাটা কি বলো তো? ধাতব জিনিস না থাকলে তো সাড়া দিত না যন্ত্র।

চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, আমিও বুঝতে পারছি না। বিদ্যুতের তার গেছে হয়তো মাটির নিচ দিয়ে। সেসবের পাইপ হতে পারে। কত নিচে আছে কে জানে। অহেতুক কষ্ট না করে শিপরিজে গিয়ে খোঁজ নেয়া দরকার।

সুতরাং রওনা হলো ওরা।

শাবল আর বেলচা ফেরত দিতে প্রথমে ডেলভারের বাড়িতে এল। এবার পাওয়া গেল ওকে। হাসিমুখে বেরিয়ে এসে স্বাগত জানাল ছেলেদের, ভূতের। গুহা থেকে তাহলে ভালয় ভালয়ই ফিরলে।

হ্যাঁ, হেসে জবাব দিল কিশোর, দেখতেই পাচ্ছেন।

এগুলো নিয়েছিলে কেন? হাত তুলে শাক আর বেলচা দেখাল বুড়ো। বাড়ি ফিরে বেগম সাহেবের কাছে শুনলাম তোমরা এসেছিলে।

মুসার একটা মেটাল ডিটেক্টর আছে। পাহাড়ের ওপর খুঁজতে গিয়ে ওর মনে হয়েছে মাটির নিচে সোনার খনি আছে। তাই খুঁড়ে দেখলাম আরকি।

বুড়োর চোখে অবিশ্বাস। এই এলাকায় সোনার খনি? অভিব! থাকলে কবে বেরিয়ে যেত।

আমারও তাই ধারণা, বলল কিশোর। মনে হয় মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের তারটার গেছে, সেগুলোর পাইপ..

হুঁ, তাই হবে। এখন কোথায় যাচ্ছ?

হ্যারির দোকানে। কয়েকটা জিনিস দরকার।

জিনিস দরকার মানে? আবার গুহায় যাবে নাকি?

বলতে পারি না। তবে গেলেও আর বোধহয় ভয়ের কিছু নেই। রাতে তে থাকলাম, গুহাতেই, ভূতে তো কিছু করল না।

বুড়োকে গুডবাই জানিয়ে গাড়িতে চড়ল ওরা। রওনা হলো হ্যারির স্টোরে।

দোকানেই আছে হ্যারি। তিন গোয়েন্দাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে এল, কি, বলেছিলাম না? নিশ্চয় বিপদে পড়েছিলে গুহায় ঢুকে।

কে বলল বিপদে পড়েছি, হাত নেড়ে বলল কিশোর।

বেশ, বিপদে হয়তো পড়েনি। কিন্তু কিছুই ঘটেনি এ কথা আমাকে অন্তত বিশ্বাস করাতে পারবে না। তোমাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। উত্তেজিত হয়ে আছ। কিছু একটা তো নিশ্চয় ঘটেছে।

মিথ্যে বলব না, ঘটনা সত্যিই ঘটেছে। তবে ভুতুড়ে কিছু নয়, হ্যারির টেলিফোন্টা দরকার, তাই তার কাছে সব কিছু চেপে গেল না কিশোর। আচ্ছা, টাউন ইঞ্জিনিয়ারের অফিসটা কোথায়, বুলবেন? কয়েকটা ম্যাপ আর সার্ভে রিপোর্ট দেখতে চাই।

ম্যাপ? ভুরু কোঁচকাল হ্যারি। ব্যাপারটা কি, বলো তো?

মুসার সোনার খনি আবিষ্কারের সম্ভাবনার কথা জানলি কিশোর।

ডেলভারের মতই অবিশ্বাসের হাসি হাসল হ্যারি। বলল, দেখো, ভাগ্য খোলে নাকি! তবে ম্যাপ দেখার জন্যে ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে যাওয়া লাগবে। না। আমি শিপরিজের মেয়র। এখানেই আর্কাইভ আছে, ডান হাতের বুড়ো। আঙুল দিয়ে দোকানের পেছনের একটা দরজা দেখাল সে।

ওখানে? অবাক হলো রবিন।

ওটা মেয়র আর টাউন ইঞ্জিনিয়ারের অফিস।

হ্যারির পেছন পেছন ঘরটায় এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। ছিমছাম সাজানো-গোছানো। একটা ডেস্ক, একটা ফাইলিং কেবিনেট আছে। দেয়ালে ঝোলানো একটা বড় ম্যাপ।

ওটার সামনে এসে দাঁড়াল তিনজনে। খুঁটিয়ে দেখতে লাগল রবিন আর কিশোর। মুসা এ সব বোঝে না, ওর ভালও লাগে না।

পাহাড়টা বের করতে দেরি হলো না কিশোরের। মাটির নিচ দিয়ে যাওয়া পানির পাইপ বা বিদ্যুতের পাইপের চিহ্ন নেই ম্যাপে। মাথা নেড়ে সরে এল ওটার কাছ থেকে।

অফিসের বাইরে বেরোতে হ্যারি জিজ্ঞেস করল, কই, পেলে তোমাদের সোনার খনি?

মাথা নাড়ল কিশোর, নাহ। রসিকতার সুরে বলল, আবিষ্কারই করলাম। আমরা আজ, ম্যাপে থাকবে কোত্থেকে। তবে এরপর ম্যাপ আকলে থাকবে অবশ্যই।

জবাবে হ্যারিও হাসল। হুঁ, তা বটে। আর কি করতে পারি তোমাদের জন্যে?

কিছু জিনিস লাগবে। মূসা আর রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, তোমরা নাও ওগুলো, আমি একটা ফোন সেরে নিই। হ্যারিকে জিজ্ঞেস করল, অসুবিধে নেই তো?

না না, অসুবিধে কিসের? করো।

.

 ল্যারি কংকলিনকে ফোন করল কিশোর।

ওকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। মেরিন ডিগের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে। কিনা জিজ্ঞেস করল কিশোর। ওপাশের কথা শুনতে শুনতে কপাল কুঁচকে গেল তার।

ব্যাপারটা চোখ এড়াল না রবিনের। কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে এত নিচু স্বরে কথা বলছে কিশোর, কিছুই শুনতে পেল না সে। দোকান। থেকে বেরিয়েই জিজ্ঞেস করল কি জেনেছে।

সাংঘাতিক তথ্য, বলল কিশোর। ভাল ছাত্র ছিল মেরিন ডিগ। ভাল ফ্যামিলির লোক। ওর বিরুদ্ধে কোন খারাপ রিপোর্ট নেই। বেড়াতে ভালবাসে। তিন বছর বেড়িয়ে বহুদিন কাটিয়ে এসেছে বিদেশে।

কিশোর চুপ করতে রবিন বলল, এর মধ্যে সাংঘাতিক তথ্যটা কোথায়?

বলিনি এখনও। গত গ্রীষ্মে একটা বিশেষ দেশে বেড়াতে গিয়েছিল সে।

কোন দেশ?

হ্যারিস গেনার যেখানে পড়তে গিয়েছিল সেখানে।

তাতে কি? বুঝতে পারল না মুসা।

রবিন বলে উঠল, আমি বুঝেছি! ওই দেশের কোন প্রতিষ্ঠান ওদের দুজনকে ধরে ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছে, যাতে ওরা ওদের হয়ে কাজ করে।

গুপ্তচরগিরি?

এ ছাড়া আর কি? কিশোর, ঠিক না?

আমি ভাবছি, ধীরে ধীরে বলল কিশোর, মতের অমিল হয়নি তো দুজনের?

মানে?

মানে, একজনকে ব্রেন ওয়াশ করেছে–ধরা যাক, ডিগের; গেনারের করতে পারেনি, কিন্তু ব্যাপারটা সে জানে। তাকে দলে আনার চেষ্টা করেছে ডিগ। পারেনি। হয়তো কথা ঁ থেকে ঝগড়া। শেষমেষ গায়েব করে দেয়া হয়েছে গেনারকে। ওর নিরুদ্দেশের এটা একটা জোরাল যুক্তি হতে পারে।

হুঁ, তা পারে, একমত হয়ে মাথা দোলাল রবিন। তবে কি লায়ন। কাবসদের দিয়ে ভয় দেখিয়ে ডিগই আমাদের তাড়াতে চেয়েছে যাতে গেনারের ব্যাপারে তদন্ত করতে না পারি?

হয়তো। তোমরা এখানে দাঁড়াও, আমি আরেকটা ফোন সেরে আসি।

আবার কাকে?

আরলিঙটনের পুলিশ চীফকে। তাকে অনুরোধ করব ডিগের ওপর নজর রাখার ব্যবস্থা করার জন্যে।

মুসা আর রবিনকে গাড়ির কাছে রেখে আবার গিয়ে দোকানে ঢুকল কিশোর। কয়েক মিনিট পর বেরিয়ে এল উত্তেজিত হয়ে। খবর জানাল, এইবার মেরিন ডিগ গায়েব! তাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

শিস দিয়ে উঠল মুসা, দারুণ! তার সঙ্গে আবার কার মতের মিল হলো না?

তাকে না ধরতে পারলে আর সেটা জানা যাবে না।

কি করে ধরা যায়?

সেটা পুলিশ জানে। তাদের কাজ।

তা ঠিক। তো আমাদের কাজ তাহলে এখন কি? আবার গুহায় ফিরে যাওয়া?

তা তো বটেই। আর কি করব? আমাদের মিশন এখনও শেষ হয়নি। গেনারকে খুঁজে পাইনি আমরা।

কিন্তু গুহায় ফিরে লাভ কি? ওখানে তো নেই গেনার। দুটো গুহার একটাতেও লুকিয়ে রাখা হয়নি তাকে, তাহলে কি আর দেখতাম না?

কমাণ্ডারের গুহাটার ব্যাপারে সন্দেহ এখনও যায়নি আমার। মন বলছে, সব রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ওই গুহায়। ভেতরে ঢুকে ভালমত খুঁজে দেখতে পারলে কিছু না কিছু পাবই।

তোমার কি মনে হয় গেনারের গায়েব হওয়ার পেছনে কমান্ডারের কোন। হাত আছে? প্রশ্ন করল রবিন।

হাত না থাকলেও যোগাযোগ যে একটা আছেই, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নইলে গেনার শিপরিজের কথা লিখে রেখে গায়েব হবে কেন? আর গুহার মধ্যে রহস্যময় কাণ্ডকারখানাই বা ঘটবে কেন? দুটোর মধ্যে মিল দেখতে পাচ্ছি আমি।

তাহলে ফিরে যেতে বলছ? জানতে চাইল মুসা।

হ্যাঁ, যাও।

 গাড়ি স্টার্ট দিল মুসা।

রিক ডেলভারের বাড়ির সামনে পৌঁছে গাড়ি থামাল সে। মালপত্র নিয়ে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা।

শব্দ শুনে বেরিয়ে এল ডেলভার। ওরা আবার গুহায় ফিরছে শুনে বাধা

কিন্তু শুনল না ওরা। জোর দিয়ে বলল কিশোর, গুহার রহস্য ভেদ না করে কিছুতেই নিরস্ত হবে না সে।

আগের বারের মত ডেলভারের বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে হেঁটে রওনা হলো তিন গোয়েন্দা।

রাত হয়ে গেছে।

সৈকত থেকে আকাশের পটভূমিতে বিশাল দৈত্যের মত লাগছে পাহাড়ের চুড়াটা। এগিয়ে গিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল ওরা।

আকাশে কয়েক দিনের চাঁদ, আলো এখনও উজ্জল হয়নি, ঘোলাটে কমলা রঙ। সেই আলোয় পথ দেখে এগেল ওরা।

গিরিখাতটা চোখে পড়ল একসময়। আরও এগিয়ে কালো গুহামুখটা চোখে পড়ল। সেদিকে তাকিয়ে গা ছমছম করে উঠল মুসার। মনে হলো যেন কোন দানবের খুলি থেকে চেয়ে আছে কালো অক্ষিকোটর।

গুহামুখটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল কিশোর, কি করছে এখন। আমাদের কমান্ডার মরিস? নিশ্চয় নাক ডাকিয়ে ভয় পাওয়াচ্ছে গুহার ইদ্রগুলোকে।

কিংবা ভূতকে, আড়চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল রবিন। গুহায় ভূত থাকে। ইঁদুরদের মতই রাত জাগে ওরাও। আর আমার তো ধারণা ওই রকম একটা কমান্ডারকে ভূতেও ভয় করে চলবে।

কেঁপে উঠল মুসার কণ্ঠ, চুপ! চুপ! কি যে বলো আর না বলো, তাও এমন জায়গায় এসে…

জোরে হেসে উঠল রবিন।

হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। ঝট করে বসে পড়ল ওরা। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল, কমান্ডারের গুহার কাছ থেকে জ্বলেছে আলোটা, তীব্র উজ্জ্বল আলোর রশ্মি গিয়ে পড়েছে সাগরের পানিতে।

ফিসফিস করে কিশোর বলল, সার্চলাইট!

বার দুই জ্বলল-নিভল আলোটা, তারপর নিভে গিয়ে আর জ্বলল না।

 আরেকটু হলেই দেখে ফেলত আমাদের, মুসা বলল।

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, আর কত চমক জমা আছে কমান্ডারের ভাঁড়ারে? সার্চলাইট! একজন সন্ন্যাসীর কি দরকার এই জিনিস? সন্দেহ আরও জোরাল হচ্ছে আমার।

সন্ন্যাসী না ছাই, ঝাঁজের সঙ্গে বলল রবিন, ব্যাটা আস্ত ভণ্ড। পাগলামিটাও তার অভিনয়।

আলো জ্বালল কেন? মূসার প্রশ্ন। কি দেখল?

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, যে ভাবে আলোটা নাড়ল, মনে হলো কোন রকম সঙ্কেত দিল।

কাকে? রবিনের প্রশ্ন।

কি জানি। কোন জাহাজ হয়তো নোঙর করেছে এখন তীর থেকে দূরে। ওটাকে সঙ্কেত দিয়েছে।

কেন?

কারণ তো নিশ্চয় আছে। আরও তথ্য না পেলে সেটা জানা যাবে না। তবে সবার আগে দেখতে হবে, জাহাজ সত্যি আছে কিনা।

উঠে পড়ল ওরা। চুপচাপ এসে গুহায় ঢুকল।

রান্না করে খেয়ে নিয়ে আলোচনায় বসল। কিভাবে কি করা যায়, তার নানারকম ফন্দি আঁটতে লাগল।

মুসা বলল, বাইরে কোথাও লুকিয়ে থেকে সাগরের দিকে নজর রাখলে কেমন হয়?

মন্দ হয় না, কিশোর বলল। চলো যাই। জাহাজ থেকে বোটটোট পাঠালে দেখতে পারব।

কিন্তু গুহা থেকে বেরিয়েই ওরা পড়ে গেল কমান্ডারের সামনে। মনে হলো যেন আড়ি পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল লোকটা। ওদেরকে দেখে কেমন থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, তোমাদের কাছেই যাচ্ছিলাম…

কেন? জানতে চাইল কিশোর।

এই এমনি…ইয়ে, তোমরা আর কতদিন আছ এখানে… কথা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেল কমান্ডার।

আমরা চলে গেলে খুশি হন মনে হয় আপনি? ফস করে বলে বসল মুসা।

না না…তা কেন? কয়েকজন পোড় খাওয়া নাবিক পড়শী হলে বরং ভালই লাগে। মনে নেই সেই দ্বীপটার কথা? তোমাদের নিয়ে নামলাম…তারপর..তারপর কি যেন ঘটল?

কি আর ঘটবে? মগজে গোলমাল! বলে দিল মুসা। মাথার ছিটে খোঁচা লাগল।

মানে? রেগে উঠল কমান্ডার।

তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, না না, আপনি রাগবেন না। আমরা কাল সকালেই চলে যাচ্ছি।

চুপ হয়ে গেল কমান্ডার। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কিশোরের মুখের দিকে। যেন তার কথা বুঝতে পারছে না। তারপর আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল নিজের গুহার দিকে।

বড় একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসল তিন গোয়েন্দা।

রাত দুটো পর্যন্ত বসে থেকেও সাগরের দিক থেকে কোন জাহাজ বা বোট আসতে দেখল না। ঘন ঘন হাই তুলছে তিনজনেই। প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে।

মুখের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে রবিন বলল, নাহ, আজ রাতে আর কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না।

ঘটার আশাও করিনি।

তবে শুধু শুধু বসে রইলে কেন?

 শিওর হয়ে নিলাম, আমার সন্দেহ ঠিক আছে কিনা।

কি বুঝলে?

 ঠিকই আছে।

তোমার কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, কিশোর, মূসা বলল। এই ভোররাতে অত হেয়ালি ভাল্লাগছে না। যা বলার পরিষ্কার করে বলো।

একটা ব্যাপার তো অবশ্যই খেয়াল করেছ, কিশোর বলল, কমান্ডার চায় না আমরা এখানে থাকি। কায়দা করে জানতে এসেছিল, আমরা কখন যাব। বলে দিলাম, কাল যাব। সুতরাং আজ রাতে যেটা ঘটাতে চেয়েছিল, সেটা কাল ঘটাবে সে। আজ আমরা আছি বলে অপেক্ষা করবে। কাল আর থাকব না…

না থাকলে দেখব কি করে কি ঘটাচ্ছে?

বুড়ো ডেলভারের সাহায্য নিতে হবে।

কিভাবে?

সেটা কালই দেখো। চলো, এখন আর বকবক না করে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

.

পরদিন খুব সকালে ওর মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখে কমান্ডার দাঁড়িয়ে আছে সৈকতে। ওদের দেখে হেসে জিজ্ঞেস করল, তাহলে চলেই যাচ্ছ?

হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর, একজায়গায় আর কত। দেখারও নেই তেমন কিছু।

আমার কিন্তু ভালই লাগে এখানে।

আমাদেরও লাগা শুরু করেছিল, কিন্তু থাকতে আর দিলেন কই?-বলার ইচ্ছে ছিল মুসার, কিন্তু চেপে গেল। মুখে বলল, দূর, এই পাগলের আড্ডায় কে থাকে। তা ছাড়া খাবার নেই, কিছু না, আনতে গেলেও বিরাট ঝামেলা…

কমান্ডারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিরিখাতের দিকে এগোল ওরা। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেত মুখে মুচকি হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে কমান্ডার।

পাহাড় পেরিয়ে ডেলভারের বাড়িতে পৌঁছল ওরা। তখনও মাছ ধরতে বেরোয়নি বুড়ো। ওদের দেখে অবাক হলো। কি ব্যাপার? এত সকাল সকাল? চোখমুখের অবস্থা দেখে তো মনে হয় না রাতে ভাল ঘুম হয়েছে। ভূতের পাল্লায় পড়েছিলে নাকি?

মুসা জবাব দিল, ভূত নাহলেও পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম…

কনুইয়ের গুঁতো মেরে ওকে থামিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, গুহাটার একটা রহস্য আছে, মিস্টার ডেলভার, ঠিকই বলেছিলেন আপনি। রোখ চেপে গেছে আমার। এর রহস্য ভেদ না করে ছাড়ব না। এ জন্যে আপনার সাহায্য দরকার আমাদের।

চোখ কপালে উঠল বুড়োর। আমার সাহায্য! দেখো বাবা, আর যাই করতে বলো, গুহার কাছে যেতে বোলো না আমাকে, দুহাত নেড়ে বলল সে, আমি সেটা পারব না।

না, গুহার কাছে যেতে বলব না আপনাকে আশ্বস্ত করল কিশোর। মাছ ধরতে বেরোবেন না আজ?

বেরোব। নাস্তাটা সেরেই। তোমরা খেয়েছ?

 না।

তাহলে এসো, বসে যাও আমার সঙ্গে।

হ্যাঁ। বসব। আপনার সঙ্গে মাছ ধরতে বেরোব আজ আমরাও আপত্তি আছে?

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বুড়ো। তারপর মাথা নাড়ল, না, আপত্তি নেই। আরও অনেক কথা আছে তোমার পেটে, বুঝতে পারছি। এসো, খেতে খেতে ঢেলে দাও।

.

অতি পুরানো একটা মোটর বোট। ইঞ্জিনটাও আদিম। তবু ওটারই গায়ে আদর করে হাত বোলাল বুড়ো ডেলভার। গর্ব করে বলল, এটা আমার তিরিশ বছরের সঙ্গী। একসঙ্গে সাগরে বেরিয়েছি আমরা, কত মাছ ধরেছি!

ডোবাবে না তো আমাদের? মুসা বলল।

আহত হলো ডেলভার। কি যে বলো! তোমাদের কাজ যদি কেউ উদ্ধার করে দিতে পারে, আমার এই বোটটাই পারবে।

আর কথা না বলে দড়ি ধরে টান দিল সে। একটানেই স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। মৃদু হেসে গর্বিত চোখে মুসার দিকে তাকাল বুড়ো। নীরব ইশারা করে বুঝিয়ে দিল, কেমন বুঝলে?

ঢ্যাঙ্ক- ঢ্যাঙ্ক – ঢ্যাঙ্ক -ঢ্যাঙ্ক করে ইঞ্জিনের বিচিত্র আওয়াজ তুলে ঢেউ কেটে এগিয়ে চল বোট। কোনদিকে যেতে হবে বলে দিয়েছে কিশোর। সেদিকেই চালাল বুড়ো।

উপকূল একপাশে রেখে তীরের বেশ খানিকটা দূর দিয়ে এগিয়ে চলল বোট। ডেকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে রইল তিন গোয়েন্দা। গুহা থেকে নজর রাখলেও ওদের দেখতে পাবে না কমান্ডার।

গুহার কাছ থেকে অনেক দূরে নোঙর ফেলল বোট, যাতে কমান্ডারের সন্দেহ না হয়। বুড়ো ডেলভার মাছ ধরতে লাগল, আর বিনকিউলার দিয়ে গুহার দিকে নজর রাখল গোয়েন্দারা।

আচমকা শক্ত হয়ে গেল রবিন। অ্যাই কয়েকজন লোক!

 পাশ থেকে কিশোর বলল, আমিও দেখতে পাচ্ছি।

মুসা বলল, সামনের লোকটা কে? কমান্ডার মরিস না?

মনে হয়। ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।

কমান্ডারের সঙ্গে আরও তিনজন লোক রয়েছে। একটা বাক্স ধরাধরি করে নিয়ে গুহার ভেতর চলে গেল।

এরপর দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেল। বিনকিউলার ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দার। কিন্তু নোকগুলো আর বেরোয় না।

রবিন বলল, নেমে গিয়ে দেখব নাকি ভেতরে কি করছে ওরা?

না, এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না, কিশোর বলল, দেখে ফেলতে পারে।

আকাশের অবস্থা ভাল না। বারবার দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছে ডেলভার। পানির রঙ গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে। বড় হচ্ছে ঢেউগুলো। বাতাস বাড়ছে। দিগন্তেরকালো মেঘের ভেতরে বিদ্যুৎ চমকাল একবার।

ঝড় আসছে, ঘোষণা করল বুড়ো। ফিরে যেতে হবে আমাদের।

আর কয়েক মিনিট থাকা যায় না? অনুরোধ করল রবিন।

না, লক্ষণ খুব খারাপ। এখুনি রওনা হতে হবে আমাদের।

ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ডেলভার।

ঠিক এই সময় গুহা থেকে বেরিয়ে এল কমান্ডার। লোকগুলো নেই সঙ্গে। সৈকত দিয়ে পানির দিকে এগেলি সে।

কিন্তু কি করে সে, দেখার সুযোগ হলো না গোয়েন্দাদের। তার আগেই বাঁকের আড়ালে সরে এল বোট।

ঢ্যাঙ্ক-ঢ্যাঙ্ক করে এগিয়ে চলেছে বোট। বাতাস আর ঢেউ যে হারে বাড়ছে তাতে সময়মত জেটিতে পৌঁছতে পারবে কিনা সন্দেহ হলো মূসার। জিজ্ঞেস করল, স্পীড আর বাড়ানো যায় না?

না, মাথা নাড়ল ডেলভার, সাধ্যমত চলছে এটা।

বিশাল এক ঢেউ এসে ভেঙে পড়ল বোটের ওপর। পানির ছিটে ভিজিয়ে দিল আরোহীদের।

ঢেউয়ের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যেন এগিয়ে চলেছে বৃদ্ধ জল্যানটা। দমছে না কোনমতেই।

আকাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কালো মেঘ। কয়েক মিনিট পর আঘাত হানল বৃষ্টি।

মুসার মনে হতে লাগল, আজ ওদের ডুবিয়েই ছাড়বে বোট। সাগরের যা অবস্থা, এখন বোট ডুবলে মরতে হবে, বাঁচার কোনই আশা নেই।

কিন্তু বুড়োর কথাই ঠিক, ডুবল না বোট। ধুকতে ধুকতে প্রায় ডুবন্ত অবস্থায় এসে তীরে ভিড়ল। দড়ি আর শেকল দিয়ে শক্ত করে বোট বেধে নেমে পড়ল ডেলভার আর তিন গোয়েন্দা। বৃষ্টির মধ্যে মাথা নিচু করে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল।

বিকেলের দিকে ঝড় থামল, কমে এল বৃষ্টি। পরিষ্কার হতে লাগল। আকাশ। পেটভরে খেয়ে আয়েশের ঢেকুর তুলে চেয়ারটা ঠেলে পেছনে সরাল ডেলভার। পাইপ ধরাল। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, ঝড় তো থামল। এবার কি করার ইচ্ছে?

গুহার কাছে যাব, কিশোর বলল, কি ঘটে ওখানে দেখব।

দাঁতের ফাঁকে পাইপটা চেপে ধরল ডেলভার। ধোঁয়া টানা থামিয়ে দিয়েছে। চোখে ভয়। রাতের বেলা!

হ্যাঁ। অন্ধকার নামলেই বেরিয়ে পড়ব আমরা। রাত বারোটার মধ্যে ফিরে আসব। টর্চটা বের করে ব্যাটারিগুলো খুলে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর।

যা বলছে তাই করবে ছেলেগুলো, এতদিনে বুঝে ফেলেছে ডেলভার, ওদের ঠেকানো যাবে না। তাই বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না আর। তবে কয়েকবার করে সাবধান করল। বলল, যেতে বাধা দেব না, তবে আমার একটা পরামর্শ শোনো। সবার একসঙ্গে গিয়ে কাজ নেই। যে কোন দুজন। যাও। একজন আমার এখানে থাকো। সময়মত যদি না ফেরো তোমরা, সাহায্য করতে পারবে সে।

পরামর্শটা মনে ধরল কিশোরের। রাজি হলো।

সন্ধ্যা হতেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল সে আর মুসা। রবিন রয়ে গেল ডেলভারের বাড়িতে। যদিও এভাবে একা পড়ে থাকার ইচ্ছে তার ছিল না। তবু নেতার নির্দেশ, মানতেই হয়।

পাহাড়ে উঠতে শুরু করল দুই গোয়েন্দা। বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল আর নরম হয়ে আছে মাটি। অন্ধকার হলে এ পথে চলার সাহস করত না ওরা। চাঁদের আলো আছে বলে এগোতে পারছে।

নিরাপদেই ওপরে উঠে পাহাড়ী পথ ধরে হেঁটে চলল দুজনে। গিরিখাতটা দেখা গেল একসময়। ওটা ধরে চলে বেরিয়ে এল সৈকতে।

পৌঁছে গেছে। ওখানে বসে জিরিয়ে নিল কয়েক মিনিট। তারপর উঠে পাহাড়ের দেয়ালে গা মিশিয়ে পা টিপে টিপে এগোল কমান্ডারের গুহার দিকে।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিশোর।

তার গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা। কি হলো!

 হাত তুলে দেখাল কিশোর।

মুসাও দেখল। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে অস্পষ্টভাবে বেরিয়ে এল, খাইছে!

তীর থেকে তিনশো গজ দূরে সমুদ্রের পানিতে মিটমিট করে জ্বলছে একটা লাল আলো, যেন কোন একচোখো সাগর-দানবের চোখ। কিন্তু চাঁদের আলোয় লাল আলোর নিচের কালো অবয়বটাকে চিনতে ভুল হলো না। একটা সাবমেরিনের কনিং টাওয়ার।

.

প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেল দুজনে। এই তাহলে ব্যাপার। কমান্ডার মরিস কোন ধরনের গোপন দলের নেতা, বেআইনী কিছু করছে এই পাহাড়ের গুহায় থেকে। সাবমেরিনে করে রসদপত্র নিয়ে আসা হয়েছে।

গুহামুখের কাছ থেকে আগের রাতের মত সার্চলাইট জ্বলে উঠল। সাবমেরিনের দিকে তাকিয়ে দুবার জলল-নিভল আলোটা।

ধীরে ধীরে পানির ওপর ভেসে উঠল সাবমেরিনের পুরো পিঠ, অতিকায়। একটা মাছের মত। লাল আলোর নিচে কালো শরীর, অন্ধকারে ভয়ঙ্কর লাগছে অবয়বটা।

আলোর সাহায্যে ওটাকে সঙ্কেত দিল কমান্ডার, কিশোর বলল। ইস্, একটা বোট যদি পেতাম গিয়ে দেখে আসতাম সাবমেরিনে কি ঘটছে।

মুসা বলল, এক কাজ করি, সাঁতরে চলে যাই আমি ওটার কাছে। বেশি দূর তো না। তুমি বসে থাকো এখানে।

কিশোর বাধা দেয়ার আগেই কাপড় খুলতে আরম্ভ করল সে।

সাবধানে যেয়ো, শুধু বলল কিশোর।

পাহাড়ের দেয়ালের সঙ্গে মিশে এগোল মুসা। পানির কাছে এসে ফিরে তাকাল একবার। কিশোরকে দেখা যায় না। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে আছে সে। ধীরে ধীরে পানিতে নেমে এল মুসা। মাথাটা কেবল ভাসিয়ে রেখে নিঃশব্দে সাঁতরে চলল সাবমেরিনের দিকে।

সেও পৌঁছল ওটার কাছে, সাবমেরিনের হ্যাচও খুলে গেল। পিচ্ছিল খোলসের গায়ে ধরার মত কিছু পেল না মুসা। ওটার গায়ে গা ঠেকিয়ে শুধু নাকটা পানির ওপরে ভাসিয়ে তাকিয়ে রইল হ্যাঁচের দিকে।

ছয়জন মানুষ বেরোল। কথা বলছে একটা অপরিচিত ভাষায়।

দশ ফুট দূর থেকে দেখছে মুসা। দুরুদুরু করছে বুক। ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ইংরেজিতে বলে উঠল একজন, আমার মনে হয়। এখানে আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলা উচিত না। কেউ শুনে ফেললে সন্দেহ করবে।

কে আর আসছে এখানে দেখতে, ইংরেজিতেই বলল আরেকজন।

তবু…এটা আমেরিকা, আমাদের সমঝে চলাই উচিত। অভ্যাস বদলাতে হবে।

ওদের সঙ্গে একটা রবারের ভেলা। ভেলাটা পানিতে ভাসিয়ে তাতে চড়ে বসল লোকগুলো। দাঁড় তুলে নিল দুজন। বেয়ে চলল তীরের দিকে।

বন্ধ হয়ে গেল হ্যাচ।

আর কিছু দেখার নেই এখানে। ভেলার পিছু পিছু মূসাও আবার তীরে ফিরে চলল। সাবধান রইল যাতে কোনমতেই লোকগুলোর চোখে পড়ে না। যায়।

কিছুদূর এসে কি মনে হতে ফিরে তাকাল। দেখল, পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে কনিং টাওয়ার। লোকগুলোকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে সাবমেরিন।

আবার জ্বলে উঠল সার্চলাইট। ভেলার দিকে মুখ করে জ্বলল-নিভল দুবার।

মাথা যতটা সম্ভব নিচে নামিয়ে ফেলল মূসা। আলো নেভার পর আবার মাথা তুলে শুনল ভেলার একজন বলছে, মরিস জ্বেলেছে।

আরেকজন জবাব দিল, হ্যাঁ। তা ছাড়া এই পাহাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থেকে আর সঙ্কেত দিতে আসবে কে?

তীরে পৌঁছল ভেলা। লোকগুলোকে চলে যাওয়ার সময় দিল মুসা। তারপর সেও উঠে এল সৈকতে। পাহাড়ের গা ঘেষে ফিরে এল পাথরটার কাছে, যেখানে কিশোর লুকিয়ে আছে। সবকথা জানাল ওকে।

পা টিপে টিপে কমান্ডারের গুহার কাছে চলে এল দুজনে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, লোকগুলোকে স্বাগত জানাচ্ছে মরিস। এক এক করে হাত মেলাচ্ছে ওদের সঙ্গে।

একটা ব্যাপার দৃষ্টি আকর্ষণ করল দুজনেরই, বদলে গেছে মরিসের চেহারা। অনেক বেশি তরুণ মনে হচ্ছে তাকে। কেন এমন দেখাচ্ছে সেটা কিশোর প্রথম বুঝতে পারল। ওদের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে লোকটার, ততবার পরচুলা পরে ছিল। এখন কুচকুচে কালো ওর মাথার চুল। এগুলোই আসল, পরচুলা খুলে ফেলেছে। মুখের ভাজও এখন অদৃশ্য, তারমানে মেকআপও নিত দিনের বেলা।

হাত মেলানো শেষ করে লোকগুলোকে নিয়ে গুহার পেছন দিকে চলে গেল কমান্ডার। সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে যাওয়াতেই বোধহয় মিলিয়ে গেল ওর হাতের আলো।

চলো, আমরাও ঢুকে পড়ি, কিশোর বলল।

ভেতরে ঢুকল দুজনে। গুহার গভীর থেকে ভেসে আসছে কথা বলার মৃদু শব্দ। অনেকটা গুঞ্জনের মত শোনা যাচ্ছে। খুব সাবধানে এগোল ওরা। ফিসফিস করে মুসাকে বলল কিশোর, দেখো তো, সুড়ঙ্গের মুখে কেউ আছে। কিনা? গার্ড রেখে যেতে পারে।

ভাল করে দেখল মুসা, অন্ধকারে কাউকে চোখে পড়ল না। কোন নড়াচড়া নেই। কাউকে দেখছি না।

আবার এগোল দুজনে। মিলিয়ে গেল কথার শব্দ। আলো ছাড়া আর এগোনো অসম্ভব। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে লোকগুলোকে আরও ভেতরে চলে যাওয়ার সময় দিয়ে যা থাকে কপালে ভেবে কোমর থেকে টর্চ খুলে নিয়ে জ্বালল কিশোর। আলোর রশ্মি ঘুরিয়ে আনল একবার চারপাশে। 

তাকের ওপর আগের মতই পড়ে আছে শটগানটা। পাশে নোটবইটাও আছে, তবে ক্যাপটা নেই। বোধহয় সরিয়ে ফেলেছে কমান্ডার। নিচে জড় করে রাখা খাবারের টিন।

লোকগুলো যেদিকে গেছে সেদিকে এগোল দুজনে। যতই ভেতরে ঢুকল বিস্ময়ে হা হয়ে গেল মুখ। গুহার পেছন থেকে বৈদ্যুতিক তারের মোটা পাইপ চলে গেছে সুড়ঙ্গের ভেতরে।

তোমার কথাই ঠিক, মুসা বলল। এই পাইপই আমার যন্ত্রে ধরা পড়েছিল। কিন্তু এ সব দিয়ে এখানে কি করছে ব্যাটারা?

চলো, গেলেই দেখতে পাব। আমার মনে হয় ওরা কোন দেশের স্পাই। রাডার স্টেশনটার দিকে লক্ষ। ওটাকে কিছু করতে চায়। ও কিন্তু ডিগ আর গেনারের ব্যাপারটা তাহলে কি? ওরা এর মধ্যে আসছে কি করে?

এখনও বুঝতে পারছি না। চলো, এগোই…

কিন্তু কিশোরকে কথা শেষ করতে দিল না একটা কণ্ঠ, অন্ধকার থেকে বলে উঠল, আর এগোনোর দরকার নেই। থাকো ওখানেই।

চমকে গেল কিশোর। আপনাআপনি টর্চ ধরা হাতটা ঘুরে গেল, আলো গিয়ে পড়ল লোকটার হাসি হাসি মুখের ওপর।

মেরিন ডিগ!

বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন মুসার শরীরে। তিন লাফে চলে গেল তাকের কাছে। আবছা অন্ধকারে আন্দাজেই থাবা দিয়ে তুলে নিল শটগানটা। তাক করল ডিগের দিকে।

কিন্তু পরক্ষণেই আকাশ ভেঙে পড়ল যেন ওর মাথায়। পেছন থেকে শক্ত কিছু দিয়ে সজোরে বাড়ি মারা হয়েছে। অন্ধকারে আরও একজন লোক লুকিয়ে ছিল।

টলে পড়ে গেল মুসা।

.

জ্ঞান ফিরলে দেখল সে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গুহার মেঝেতে পড়ে আছে। কিশোরকে একইভাবে বেধে ফেলে রাখা হয়েছে ওর পাশে। কাছেই পিস্তল হাতে বসে আছে ডিগ। একটা ল্যাম্প জ্বলছে, তার আলোয় কুৎসিত লাগছে। ওর মুখটা।

যাক, ঘুম তাহলে ভাঙল, হেসে বলল ডিগ। আমি জানতাম তোমরা এমন কিছু একটা করবে, আসবে, তাই লুকিয়ে ছিলাম তোমাদের অপেক্ষায়।

তা তো বুঝলাম, নিজের কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল মুসা, কোলাব্যাঙের স্বর বেরোচ্ছে তার গলা দিয়ে। কিন্তু এ ভাবে কতক্ষণ আটকে রাখবেন আমাদের?

বেশিক্ষণ না। এই আর কয়েক ঘণ্টা, ততক্ষণে আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে।

তারপর ছেড়ে দেবেন? ফিরে গিয়ে যদি পুলিশকে সব কথা বলে দিই আমরা?

সেজন্যেই তো ছাড়ব না। আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাব। তোমাদের দিয়ে কাজ হবে। বুদ্ধিমান ছেলে তোমরা, ব্রেন ওয়াশ করে নিলে অনেক কাজ করাতে পারব।

কোথায় নিয়ে যাবেন আমাদের? জানতে চাইল কিশোর।

সেটা বলা যাবে না। গেলেই দেখতে পাবে।

এখানে কি, করছেন আপনারা, সেটা তো বলা যাবে? রাডার স্টেশনটাতে কিছু করছেন, তাই না?

হাসল ডিগ। অতটা আন্দাজ করে ফেলেছ! হ্যাঁ, ওখানেই…

কথা শেষ হলো না তার। একসঙ্গে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল অনেক লোক। কঠিন গলায় আদেশ হলো, খবরদার, নড়বে না কেউ! পুলিশ!

 স্তব্ধ হয়ে গেল ডিগ। হাত থেকে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখল পিস্তলটা।

উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল কয়েকটা, পুলিশের ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক ল্যাম্প।

হাসিমুখে মুসা আর কিশোরের পাশে এসে বসল রবিন। এগিয়ে এল ডেলভার।

বাঁধনের দড়ি কাটতে কাটতে রবিন বলল, সময়মতই এসে পড়েছি, তাই? তোমাদের জন্যে কাটায় কাটায় বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি আমরা। তারপর থানায় গেছি।…তা ভাল আছ তো তোমরা? মারধর করেনি?

করেনি বললে ভুল হবে, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। মাথায় বাড়ি দিয়ে বেঁহুশ করে ফেলেছিল আমাকে…

.

 পরদিন বিকেল। রকি বীচে তিন গোয়েন্দার ওঅর্কশপে বসে আছে ওরা। এই সময় একটা গাড়ি ঢুকল ইয়ার্ডে। গাড়ি থেকে নামল একজন লম্বা, সুদর্শন, লোক। গোয়েন্দাদের খোঁজ করল। নিজের পরিচয় দিল-ফিন রিগসন, এফ বি আইয়ের লোক। জানাল, হ্যারিস গেনারের নিরুদ্দেশের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে।

তিন গোয়েন্দাও আগ্রহী হলো। ডেকে নিয়ে গিয়ে বসাল ওঅর্কশপের ভেতর।

ভদ্রলোককে দেখে সেরাতে গুহায় ঢোকার কথা মনে পড়ল কিশোরের। একজন স্পাইও পালাতে পারেনি। দল বেঁধে সুড়ঙ্গে ঢুকেছে পুলিশ। ঢোকার আগে হেডকোয়ার্টারে ওয়্যারলেস করে বলে দিয়েছে একজন অফিসার, বাইরে থেকে যাতে রাডার স্টেশনটা ঘিরে ফেলা হয়।

সেইমত কাজ করেছে হেডকোয়ার্টার থেকে আসা পুলিশ বাহিনী। অতএব কেউ পালাতে পারল না। স্টেশনের নিচের একটা গুপ্তকক্ষ থেকে সব কজন স্পাইকে গ্রেপ্তার করা হলো। গুহাটা থেকে প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ বেরিয়ে চলে গেছে স্টেশনের দিকে। মূল সুড়ঙ্গ থেকে আরেকটা শাখা-সুড়ঙ্গ খুঁড়ে স্টেশনের নিচে চলে আসার ব্যবস্থা করেছে স্পাইরা। একটা কক্ষ বানিয়ে নিয়েছে যাতে ওখান থেকে ওপরে উঠে গোপনে স্টেশনের কাজকর্ম দেখতে পারে।

সাবমেরিন থেকে আসা সব কজনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ, সেই সঙ্গে কমান্ডার মরিস আর মেরিন ডিগকেও। যাকে উদ্দেশ্য করে এই তদন্তের শুরু, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে গুহা বা সুড়ঙ্গের কোথাও পাওয়া গেল না।

ডিগকে বার বার করে জিজ্ঞেস করা হলো, কিন্তু জবাব পাওয়া গেল একটাই–সে কিছু জানে না।

কিন্তু নিরাশ হলো না অফিসার। থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কথা আদায়ের চেষ্টা করা যাবে।

সে ব্যাপারেই হয়তো কিছু বলবে, ভাবল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, হ্যারিস গেনারের কোন খোঁজ পাওয়া গেছে?

মাথা ঝাঁকাল রিগসন, গেছে। ওকেও পাওয়া গেছে। হাসপাতালে আছে এখন।

তাই নাকি! খুব খারাপ অবস্থা?

শরীর ঠিকই আছে, তবে বোধহয় মাথায় কোন গোলমাল হয়েছে। একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। ওষুধের রিঅ্যাকশনও হতে পারে।

তার বোন ইভা গেনারকে খবর দেয়া হয়েছে?

সেজন্যেই তো তোমাদের কাছে এলাম, ঠিকানা জানার জন্যে।

ও, চলুন তাহলে, আগে তাকে গিয়ে খবরটা দিই। তারপর একসঙ্গে হাসপাতালে যাব গেনারকে দেখতে। তা কোথায় পেলেন ওকে?

সাবমেরিনের মধ্যে, রিগসন জানাল। ওকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল ওটা। স্পাইগুলোকে ধরার পর তোমাদের কথামত সাবধান করে দেয়া হয়েছিল কোস্টগার্ডকে। নৌবাহিনীর সহায়তায় সাবমেরিনটাকে ধরে ফেলা। হয়েছে। তার ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে গেনারকে। গুহাতেই রাখা। হয়েছিল ওকে। ওখান থেকে সাবমেরিনে পাচার করা হয়েছে।

ও তো নিশ্চয় কিছু বলতে পারেনি? জানতে চাইল রবিন।

আবার মাথা নাড়ল রিগসন।

কিশোর জিজ্ঞেস করল, রাডার স্টেশনটাতে কি করছিল ওরা জানা। গেছে?

দুটো উদ্দেশ্যে ব্ল্যাক হোল কেভে আস্তানা গেড়েছিল ওরা। ওই উপকূলে গুপ্তচরদের একটা ঘাটি বানিয়েছিল। ওখানে লুকিয়ে থেকে নানা রকম ধ্বংসাত্মক কাজকারবার চালানোর পরিকল্পনা করেছিল ওরা দেশের ভেতর। সেই সঙ্গে রাডার স্টেশনটাকেও অকেজো করে রাখার চেষ্টা চালাত। তাতে বিমান আর নৌবাহিনীর অনেক বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারত।

রাডার স্টেশন অকেজো করত কিভাবে? জানতে চাইল মুসা।

একটা বিশেষ যন্ত্র গুহার ভেতর থেকে রাতের বেলা বাইরে ঠেলে দিত, রিগসন জানাল, তাতে বাধা পেত রাডার সিগন্যাল, জ্যাম হয়ে যেত।

বাপরে বাপ, কত্তবড় শয়তান, ব্যাটারা!

হ্যাঁ, লোক খুব খারাপ ওরা। মজার ব্যাপার হলো, কমান্ডার জিন মরিস নিজেকে জাহাজের কমান্ডার বলে পরিচয় দিলেও কোনদিন নাবিক ছিল না সে। অল্প বয়সে কিছুদিন এক তৃতীয় শ্রেণীর থিয়েটারে অভিনয় করেছে। বিদেশে একটা সাংস্কৃতিক ভ্রমণ করার সময় স্পাইয়ের খপ্পরে পড়ে খারাপ হয়ে যায়, বিদেশী সংস্থার হয়ে নিজের দেশের বিরুদ্ধে বেঈমানী শুরু করে…

বাধা দিল রবিন, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে?

আরে নাহ, ইংল্যান্ড কোথায়? আমেরিকা। ও আমেরিকান। কোনকালেই ইংরেজ ছিল না, শরীরে কোনভাবেই ইংরেজ রক্ত আসেনি, মায়ের দিক থেকেও না, বাপেরও না। ব্রিটিশ জাহাজের কমান্ডার বলে ফাঁকি দিয়েছে তোমাদেরকে। আরও বহুজনকে দিয়েছে। পাগলের অভিনয় করাও তার আরেকটা ফাঁকিবাজি। মহাধড়িবাজ লোক।

হ্যাঁ, মুসা বলল, আমরা তো সত্যি সত্যি পাগল ভেবে বসেছিলাম। ভেবেছি একলা থাকতে থাকতে মাথাটা ওর বিগড়ে গেছে।

পাগলামি করাতে অবশ্য সুবিধেই হয়েছে আমাদের, কিশোর বলল, সন্দেহটা তাড়াতাড়ি জেগেছে। আচ্ছা, মুসা যে পিস্তলটা পেয়েছে, ওটার। ব্যাপারে কিছু জেনেছেন নাকি? অস্ত্রটা মরিসেরই, তাই না?

হ্যাঁ, রিগসন বলল, মরিস সব স্বীকার করেছে। তোমাদের গুহা থেকে যে রাতে খাবার চুরি করেছে, সে রাতে ওটা হারিয়ে ফেলেছিল। অন্ধকারে তাড়াহুড়োয় আর খুঁজে পায়নি। খাবার চুরি করেছিল তোমাদের তাড়ানোর জন্যে। ভেবেছিল, খাবার না পেলে আপনিই চলে যাবে তোমরা।

সেটা তখনই বুঝতে পেরেছি।

ক্যাপটা কার? নিশ্চয় গেনারের?

মাথা ঝাঁকাল রিগসন। হ্যাঁ।

সে ওই গুহায় কি করে গিয়েছিল, কিছু জেনেছেন?

ডিগের কথাবার্তায় সন্দেহ হয়েছিল তার, ব্ল্যাক হোল গুহায় কিছু ঘটছে। একরাতে গোপনে ওর পিছু নিয়ে চলে যায় সেখানে। কিন্তু মরিসের চোখে পড়ে যায়। পালানোর চেষ্টা করে গেনার। কিন্তু বন্দুকের ফাঁকা গুলি করে তাকে ভাঁড়কে দেয় মরিস। আটকে ফেলে।…যাই হোক, কথা তো অনেক হলো। চলো এবার, গেনারের বোনকে খবরটা দেয়া যাক।

রিগসনের সঙ্গে বেরোল তিন গোয়েন্দা।

  খবর শুনে তো কেঁদেই ফেলল ইভা। তখুনি ওদের সঙ্গে রওনা হলো হাসপাতালে।

ঘোর কেটেছে গেনারের। তবে অতিরিক্ত দুর্বল। দুজন পুলিশ অফিসার বসে আছে, তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্যে।

তিন গোয়েন্দা কি করেছে শুনে কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে এল তার। ধরা গলায় বলল, তাহলে তোমরাই আমাকে বাঁচিয়েছ! সময়মত সাবমেরিনটাকে আটকাতে না পারলে আমাকে কোথায় যে নিয়ে যেত ওরা কে জানে! সারাজীবনে হয়তো আর দেশের মুখ দেখতাম না। হয়তো ব্রেন ওয়াশ করে মাথাটাই বিগড়ে দিত চিরকালের জন্যে। কি বলে যে ধন্যবাদ দেব তোমাদেরকে…

Categories: