দাঁড়াও, আবার বলল কিশোর, ওর আঁকা এখনও বাকি আছে।
আরও কয়েকটা কুকুরের ছবি আঁকল পিচার–একটা ককারেল স্প্যানিয়েল, একটা জার্মান শেফার্ড, আর দুটো হাউন্ড।
ওটা আবার কি আঁকছে? পিচারের পেন্সিলের দিকে তাকিয়ে বলল রবিন, একটা ধূসর কুকুর?
ধূসর কিংবা বাদামী, কিশোর বলল। দেখো, বা কানটা সাদা রেখে দিয়েছে।
খাইছে! বলে উঠল মুসা, ওটা তো পটির কুকুর! তারমানে ডবকেও চুরি করেছেন আরিগন!
বার বার আরিগন নামটা শুনেই বোধহয় মুখ তুলে একটা রাগত ভঙ্গি করল পিচার। তারপর রেখা টেনে টেনে সবগুলো কুকুরকে যোগ করে দিল মানুষটার ছবির সঙ্গে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল ছেলেটা। দৃষ্টি আর ভঙ্গি দেখে মনে হলো আরও কিছু বলতে চায়। আরিগনের ছবিতে আঙুল রাখল, তারপর ফগকে দেখাল। হঠাৎ একটা চেয়ারের নিচে চলে গিয়ে মুখ বের করে উঁকি দিল।
ও বলতে চায়, ব্যাখ্যা করল কিশোর, গাছের আড়ালে কিংবা ঝোপের। মধ্যে লুকিয়ে ছিল।
হাত টান টান করে দিল পিচার, আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে আবার বন্ধ করে বোঝাতে চাইল ভারি কিছু চেপে ধরেছে। লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল চেয়ারের নিচ থেকে। হাতের অদৃশ্য জিনিসটা দিয়ে ডোনারের ছবির মাথায় বাড়ি মারল, পরক্ষণেই হাতের কুকুরের বাচ্চাটাকে ছো মেরে কেড়ে নিয়ে ঘুরে দৌড় দেয়ার ভঙ্গি করল।
কি বোঝাতে চাইল বুঝল তিন গোয়েন্দা। সে লুকিয়ে বসে চোখ রাখছিল, আরিগন আসতেই তার মাথায় বাড়ি মেরে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিয়ে দৌড় দিয়েছে।
হু, চোরের ওপর বাটপাড়ি! মন্তব্য করল উত্তেজিত রবিন।
কিশোরের প্রশ্ন তখনও শেষ হয়নি, আজ বিকেলে আমাদেরকে পাথর ছুঁড়লে কেন?
আবার চেয়ারে বসল পিচার। কয়েক টানেই এঁকে ফেলল তিনটে ব্যাটল। সেক। ওগুলো দেখিয়ে মুসা আর রবিনের বুকে হাত রেখে ওদেরকে ঠেলে সরানোর ভঙ্গি করল।
হেসে বলল কিশোর, বলেছিলাম না, ও তোমাদের বাঁচাতে চেয়েছিল। সাপগুলো দেখেছিল। তার মানে আরিগনের দলে নয় সে।
আচমকা প্রশ্নটা জাগল রবিনের মাথায়, কুত্তাচোরের পেছন নিয়েই বিপদে পড়েননি তো ক্যাপ্টেন রিচটন?
পড়তে পারেন। তারও তো একটা কুকুর ছিল। আরিগন হয়তো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন পিছু নিয়েছিলেন তার। তারপর গোপন এমন কিছু দেখে ফেলেছিলেন, যেটা কাল হয়েছিল তার।
তখন তাকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো! পাতায় লেগে থাকা রক্তের কথা ভেবে বলল রবিন।
নতুন সম্ভাবনাটা নিয়ে এতই মজে গেল তিনজনে, নিঃশব্দে কখন যে দরজার কাছে চলে গেল পিচার, খেয়াল করল না। করল সে বেরিয়ে যাওয়ার পর। লাফিয়ে উঠে তার পিছু নিতে গেল মুসা, ধরে ফেলল কিশোর। যাক। ও আমাদের পক্ষেই আছে।
ওর জন্যে কিছু করতে পারলে ভাল হত, রবিন বলল। ছবি আঁকার। হাত দেখেছ? ট্যালেন্ট একটা! আর্ট স্কুলে ভর্তি হলে ফাটিয়ে ফেলবে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। সে-সব পরের ভাবনা। আগে এই রহস্যের একটা কিনারা করা দরকার। বুঝলে, কর্নেল হুমবাকে মন থেকে তাড়াতে পারছি না আমি, আরিগনের সঙ্গে চেহারার এত মিল কেন? ভাবছি, কাল আবার কার্নিভ্যালে গিয়ে হুমবার সঙ্গে কথা বলব। জিজ্ঞেস করব, তার কোন যমুজ ভাই আছে কিনা।
ফরেস্টবার্গে গেলেও তথ্য মিলতে পারে। আরিগন পরিবার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা দরকার।
রাতের ঝড়বৃষ্টির পর খুব ঝলমলে হয়ে দেখা দিল সকাল। গাছের সবুজ পাতা চকচক করছে কাঁচা রোদে। ফুরফুরে মন নিয়ে কেবিন থেকে বেরোল তিন গোয়েন্দা। কিন্তু বাইরে বেরিয়েই থমকে গেল মুসা, বলে উঠল, খাইছে! দেখো!
কনভারটিবলের টপ তুলে দিতে ভুলে গিয়েছিল ওরা, বৃষ্টির পানি জমে আছে গাড়ির মেঝেতে। সীট, সীটের কভার, সব ভেজা। পানি মুছে নিয়েও। তাতে বসে যাওয়া যাবে না।
ক্যাপ্টেনের গাড়িটাই নিয়ে যাই, রবিন বলল। এতে আরেকটা কাজ হবে। তার শত্রুরা দেখলে মনে করতে পারে তিনি পালিয়েছেন, বাধা দেয়ার জন্যে তখন সামনে বেরিয়ে আসতে পারে ওরা।
বুদ্ধিটা ভাল, পছন্দ হলো কিশোরের। এ ছাড়া আর কিছু করারও নেই, তাদের এত ভেজা গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। পানিটানিগুলো মুছে, শুকানোর জন্যে ফেলে রেখে ক্যাপ্টেনের গাড়িটা নিয়েই রওনা হলো ওরা।
রবিনই চালাল, কিশোর তার পাশে, কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়ে পেছনে বসল মূসা। ফরেস্টবার্গে পৌঁছে দেখা গেল সীটে এলিয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে মুসা, বাচ্চাটা কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে তার কোলে। হেসে ফেলে কিশোর বলল, কাল রাতে দু-জনের ওপরই খুব ধকল গেছে। ঘুমাক। চলো, আমরাই যাই।
কোর্টহাউসের দিকে হেঁটে এগোল ওরা। মাত্র আটটা বাজে, রাস্তায় লোকজন কম। আগের দিন ভাল করে দেখা হয়নি, আজ দেখতে দেখতে চলল ওরা। বেশির ভাগ দোকানেরই ওপরতলায় অফিস করা হয়েছে। একটা সাইনবোর্ডে দেখা গেল:
আর্নি হুগারফ
অ্যাটর্নি-অ্যাট-ল
ঢুকবে কি ঢুকবে না দ্বিধা করতে লাগল। সে কি ভেবে না ঢোকাই স্থির করল।
রাস্তা পেরিয়ে কোর্টহাউসের সামনে এসে দাঁড়াল দু-জনে। এত সকালে কেউ কাজে আসেনি।
এক কাজ করি চলো, কিশোর বলল। দোকানগুলোতে খোঁজ নিই। আরিগনদের কেউ চিনতেও পারে।
পরের একটা ঘণ্টা দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াল দুই গোয়েন্দা। দু একজনের কাছে নামটা পরিচিত হলেও কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল। কেউ কোন তথ্য দিতে পারল না। অনেকেই এখানে নতুন, তারা চেনেই না আরিগনদের। আর পুরানো যারা, চিনতে পেরেছে, তারা চেপে গেছে; বাইরের কারও কাছে নিজেদের ঘরের কথা বলতে রাজি না ওরা।
পথের মাথার একটা দরজির দোকান দেখিয়ে কিশোর বলল, চলো, ওইটাই শেষ।
সে-ও বলবে না।
এবার অন্য বুদ্ধি করব। ভাব দেখাব, যেন কাজ করাতে এসেছি।
দরজির দোকানে আবার কি কাজ? অবাক হলো রবিন।
হেসে প্যান্টের একটা ছেঁড়া দেখাল কিশোর। কাল রাতে পাথরে টাতরে খোঁচা লেগে বোধহয় ছিঁড়েছে। রিপু করাব।
দরজা খোলার শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল বুড়ো দরজি। ছোটখাট মানুষ, মাথা জুড়ে টাক। কাউন্টারে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী?
ছেঁড়াটা দেখিয়ে কিশোর অনুরোধের সুরে বলল, এটা রিপু করে দেয়া যাবে? আমরা দাঁড়াই।
হাসল বুড়ো। সোনায় বাঁধানো দুটো দাঁত দেখা গেল। খুলে দাও।
দোকানের পেছনের ড্রেসিং রুমে ঢুকে প্যান্টটা খুলে ওখানে রাখা অন্য কাপড় পরে এল কিশোর। টেবিলে বসে কাজ শুরু করল দরজি। দুটো টুলে বসে দেখতে লাগল কিশোর আর রবিন।
পুরানো কাপড় মেরামত করার জন্যে দিয়ে গেছে অনেকেই, মেঝেতে স্তূপ করে ফেলে রাখা হয়েছে সেগুলো। সুন্দর একরোল স্যুটের কাপড় দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোরের। জিজ্ঞেস করল, নতুন কাপড়ের অর্ডার কেমন পান?
এখানে আর কাজ কোথায়? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল দরজি। খালি ফুটোফাটা মেরামতের জন্যে নিয়ে আসে।
ওই যে, নতুন কাপড় রেখেছেন?
রেখেছি, যদি কেউ আসে স্যুট করাতে। কিন্তু আসে না, রেডিমেড পোশাকের দিকেই লোকের ঝোঁক, প্যান্টের ফুটোর চারপাশে সুচ চালাতে, চালাতে দুঃখ করে বলল বুড়ো, চল্লিশ বছর ধরে আছি এখানে। এখন আমার। প্রধান ব্যবসা হলো ধোপাগিরি। কিন্তু দশ বছর আগেও অবস্থা এমন ছিল না। অনেকেই আসত পোশাক বানাতে। কাজ করতে করতে একেক সময় অস্থির হয়ে যেতাম। হ্যারিসনরা আসত, মবাররা আসত, আসত আরিগনরা। কত সুন্দর সুন্দর স্যুট যে ওদের বানিয়ে দিয়েছি আমি। আজ আর সে-সব দিন। কোথায়!
আরিগন?
হ্যাঁ, আরিগন, একটা চমৎকার পরিবার। এই এলাকার অনেক পুরানো বাসিন্দা। টাকাও ছিল, বিলাসিতাও ছিল। বুড়ো আরিগন, লম্বা, সুদর্শন একজন মানুষ। আর তার স্ত্রীর কথা কি বলব, খুবই শৌখিন ছিল। সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল তাদের, দুটো যমজ ছেলে ছিল–লমা, সুন্দর, একেবারে বাপের মত। চেহারায় এত মিল, কে যে কোনটা আলাদা করাই মুশকিল।
যমজ! উত্তেজনা দেখাতে গিয়েও তাড়াতাড়ি সেটা সামলে নিল রবিন, বুড়োকে সন্দিহান করে তোলা যাবে না, দারুণ তো? কি হলো পরিবারটার? এখন আর কাপড় বানাতে আসে না কেন?
দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়ল দরজি, থাকলে তো আসবে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কে কোথায় চলে গেছে কে জানে। মেয়েটার খবর জানি না। যমজদের একজন, নুবার আরিগন শহর ছেড়ে একেবারেই চলে গেছে। আরেকজন, ডোবার, কালেভদ্রে আসে। আবার জোরে নিঃশ্বাস ফেলল বুড়ো। তবে কাপড় আর বানাতে আসে না সে-ও। হাতে তৈরি জমকালো পোশাক পরা ছেড়েই দিয়েছে। পরে কেবল সাদাসিধা কাপড়, যেগুলো পরলে হাঁটাচলার সুবিধে হয়।…নাও, তোমার এটা হয়ে গেছে।
প্যান্টটা পরে নিল কিশোর। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, তবে রবিনের মতই সেটা চেপে রেখে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, হ্যারিজ কার্নিভ্যালটা এখন কোথায়, বলতে পারবেন? একবার দেখেছি। কিন্তু আমার বন্ধুর, রবিনকে দেখিয়ে বলল, আরেকবার দেখার ইচ্ছে।
ওয়েস্টবাস্কেট থেকে খুঁজে পেতে দোমড়ানো একটা পোস্টার বের করে আনল বুড়ো। দিল কিশোরকে। কবে কোনখানে যাবে কার্নিভ্যালটা, তার শিডিউল করা আছে। বুড়োর মজুরি মিটিয়ে দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। দুই গোয়েন্দা।
আরও চমক অপেক্ষা করছিল তাদের জন্যে। কয়েক গজ এগোতে না এগোতেই একটা ওষুধের দোকান থেকে লম্বা একজন মানুষকে বেরোতে দেখল ওরা। আরিগন! মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা। ফিসফিস করে রবিন বলল, বাড়িটা জোরেই মেরেছে পিচার!
তাই তো মনে হচ্ছে। ইনি কোন জন, নুবার, নাকি ডোবার, জানতে পারলে ভাল হত। দেখা যাক, কার্নিভ্যালের হুমবা নতুন কিছু জানাতে পারে নাকি আমাদের।
.
তখনও ঘুমাচ্ছে মুসা, কিন্তু বাচ্চাটা জেগে গেছে। কিশোর আর রবিনের সাড়া পেয়ে খেউ খেউ শুরু করল।
জেগে গেল মুসা। লাল চোখ মেলে হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, এখনও কি ফরেস্টবার্গেই আছি?
দুই ঘণ্টা ধরে আছি, জবাব দিল রবিন। তোমার স্বপ্ন দেখা শেষ হয়েছে?
হয়েছে। তোমাদের কি খবর?
বলতে লাগল রবিন। শুনে চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার, ঘুম চলে গেল বহুদূরে। একটা ম্যাপের ওপর ঝুঁকে পড়েছে কিশোর।
স্টার্ট দিল রবিন। শহর থেকে বেরিয়ে কিশোরের নির্দেশে পশ্চিমে যাওয়ার একটা রাস্তা ধরল।
যাচ্ছি কোথায়? জানতে চাইল মুসা।
রিভারভিল, জবাব দিল কিশোর। ওখানেই আছে এখন কারনিভ্যালটা। মেইন রোড দিয়ে যাওয়ার চেয়ে এই রাস্তায় গেলে সময় অর্ধেক, লাগবে। আমাদের।
সরু, এবড়োখেবড়ো কাঁচা পথটার জন্যে উপযুক্ত ক্যাপ্টেনের গাড়িটা। সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে রবিন। পথের মাঝে মাঝে গর্ত, আগে থেকে খেয়াল না করলে ওগুলোতে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটাবে। দুই ধারে ঘন বন। কখনও নালা এগিয়ে যাচ্ছে পথের সমান্তরালে, কখনও শৈলশিরা। একটা বাড়িঘরও চোখে পড়ল না কোথাও।
কয় মাইল এসেছে মিটারে দেখে নিয়ে কিশোর বলল, আর বোধহয় বেশি দূরে নেই। হায় হায়, ওটার আবার কি হলো? এমন জায়গায় গাড়ি খারাপ হলে তো সর্বনাশ! নিজেদের কথাও ভাবল সে। পথের পাশে একটা ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এই মন্তব্য করল সে। গাড়িটার বনেট ওপরে তোলা। দুপাশ থেকে ঝুঁকে তার নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে দু-জন লোক, ইঞ্জিন পরীক্ষা করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না একজনেরও।
কি হলো দেখা দরকার, কিশোর বলল। বিপদে পড়েছে মনে হয়। দেখি, কোন সাহায্য করতে পারি কিনা।
কিশোর, সন্দেহ জেগেছে রবিনের, ওরা আমাদের গাড়ি থামানোর। জন্যে এই বাহানা করছে না তো? ক্যাপ্টেনের গাড়ি দেখে হয়তো দেখতে এসেছে, ব্যাপারটা কি?
সেটা কথা না বললে বোঝা যাবে না। ওরা দু-জন, আমরা তিনজন, সাবধান থাকব, তাহলেই কিছু করতে পারবে না।
গাড়ি থামাল রবিন। ওরা তিনজন বেরোতে না বেরোতেই লাফ দিয়ে এগিয়ে এল বিরাট এক কুকুর। গাড়ির ওপাশে ছিল এতক্ষণ।
খাইছে! তাড়াতাড়ি মূসা বলল, এই ফগ বেরোবি না, বেরোবি না, খেয়ে ফেলবে! কিন্তু আকারের তুলনায় কুকুরটা ভদ্র, কৌতূহলী ভঙ্গিতে তার হাত শুকতে লাগল।
সোজা হয়ে দাঁড়াল একজন লোক। হালকা-পাতলা গঠন, লাল চুল। কুকুরটাকে ডাকল, এই মবি, আয় এদিকে। মুসাকে বলল, ভয় পেয়ো না। ও কামড়ায় না।
কি হয়েছে গাড়ির? জানতে চাইল কিশোর।
চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেল। বুঝতে পারছি না।
এগিয়ে গেল মুসা। ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একবার দেখি?
গাড়ির কাজ জানো নাকি? জিজ্ঞেস করল উজ্জ্বল রঙের প্রিন্টের শার্ট পরা অন্য লোকটা।
কিছু কিছু।
তাহলে দেখো কিছু করতে পারো কিনা। কি যে বিপদে পড়লাম।
শার্টের হাতা গোটাতে লাগল মুসা, দেখি, টুলস কি আছে দেন?
টুলস বক্স বের করে দিল লালচুল লোকটা।
একটা স্প্যানার নিয়ে ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকল মুসা। কয়েক মিনিট পর হাসি মুখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, যান, ঠিক হয়ে গেছে। কন্ডোরে গোলমাল ছিল।
এত তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেছে, বিশ্বাস করতে পারল না লোকগুলো। প্রিন্টের শার্ট পরা লোকটা গিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসে ইগনিশনে মোচড় দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট হয়ে গেল গাড়ি।
বিস্ময় দেখা দিল লালচুল লোকটার চোখে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো দেখি গাড়ির জাদুকর হে! কতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিঃ বাঁচালে। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
জানা গেল, গাড়িটা একটা স্কুলের। ফরেস্টবার্গে যাওয়ার পথে ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে। তিন গোয়েন্দাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আবার নিজের পথে রওনা হয়ে গেল লোকগুলো।
তারমানে ওরা শত্রুপক্ষ নয় আমাদের? গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন। তুলল রবিন।
মনে হয় না, জবাব দিল কিশোর। আচরণে তো সে-রকম মনে হলো না।
হতে পারে, পেছন থেকে মুসা বলল, ওরা ভেবেছিল, ক্যাপ্টেন রিচটন আছেন গাড়িতে। তাকে দেখলেই অন্য রকম আচরণ করত। আমাদের দেখে আর কিছু করার প্রয়োজন বোধ করেনি…
কি জানি। আমার সে-রকম মনে হয়নি।
তবে ইঞ্জিনে কিন্তু সত্যি গোলমাল হয়েছিল। ওটা বাহানা কিংবা সাজানো নয়।
রিভারভিলে পৌঁছল গাড়ি। তৃতীয়বারের মত হ্যারিজ কার্নিভ্যালে এল গোয়েন্দারা। খেলা শুরু হয়নি এখনও। একজন টিকেট কালেক্টরকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, হুমবাকে কোনখানে পাওয়া যাবে।
কর্নেল যে তাঁবুতে খেলা দেখায় তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ছোট সাদা রঙের একটা ক্যারাভান ট্রেলার। ওটাতেই থাকে অ্যানিমেল ট্রেনার। ছেলেরা কাছে এসে দাঁড়াতেই খুলে গেল দরজা। বেরিয়ে এল খেলা দেখানোর পোশাক পরা হুমবা।
এগিয়ে গেল কিশোর। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, মিস্টার আরিগন, আপনার সঙ্গে কথা আছে। একটু দাঁড়াবেন, প্লীজ।
আরিগন নামটা শুনেই থমকে গেছে হুমবা। কিশোর দাঁড়াতে মা বললেও দাঁড়াত। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এই নাম জানলে কি করে তুমি?
আরিগন নামে আরেক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমাদের, চেহারার এত মিল, আপনার ভাই বলেই চালিয়ে দেয়া যায়। খুব ভাল করে খুঁটিয়ে না দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না যে দু-জন দুই লোক। যখন জানলাম, ওই ভদ্রলোকের একজন ভাই আছে, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলতে অসুবিধে হলো না। একটা কথা বুঝতে পারিনি, নুবার কে, আর ডোবার কে?
দ্বিধা করল হুমবা, তারপর বলল, আমি নুবার। সঙ্কোচ বোধ করছে। লোকটা। হাসল, তাতেও সঙ্কোচ। আসলে নিজের পরিচয় দিতেই এখন লজ্জা লাগে, বিলাসিতা করে ফকির হওয়া মানুষদের কেউ দেখতে পারে না। এতে যদিও আমাদের খুব একটা দোষ ছিল না, আমাদের বাবাই দায়ী..যাই হোক, আসল নামটা রাখলে এই এলাকায় বেকায়দায় পড়ে যেতাম, কে যায় লোকের অহেতুক মন্তব্য শুনতে, তাই বদলেই ফেললাম। অনেক আগে চলে গেছি তো আমরা এই এলাকা ছেড়ে, এখন নিজে থেকে পরিচয় না দিলে সহজে কেউ আর চিনতে পারবে না। কিন্তু তোমাদেরকে এত কথা বলছি কেন? তোমরা কারা?
আমরা ইতিহাসের ছাত্র, অনেক দুরে লস অ্যাঞ্জেলেসের রকি বীচ থেকে বেড়াতে এসেছি। ভাবলাম, এসেছি যখন, এই এলাকার ইতিহাস যতটা সম্ভব জেনে যাই, পরীক্ষার সময় কাজে লাগবে। ডাচ পেনসিলভ্যানিয়া সম্পর্কে এমনিতেও আমাদের কৌতূহল আছে।
ও, কিছু সন্দেহ করল না নুবার।
আপনাদের তো শুনলাম অনেক জায়গা-সম্পত্তি আছে এখনও, ফকির বলছেন কেন? পুরো ব্ল্যাক হোলোটাই আপনাদের।
মাথা ঝাঁকাল নুবার, অনেক বড় সম্পত্তি, তা ঠিক। কিন্তু সেটা নিয়ে মারামারি করলে তো আর ভোগ করা যায় না। বাবা মারা যাওয়ার পর। জায়গাটা নিয়ে কি করব আমরা, এই একটা সামান্য ব্যাপারেই একমত হতে পারিনি এখনও তিন ভাইবোন। কেস চলছে। তর্কের পর তর্ক করে চলেছে। তিন পক্ষের উকিল। কেউ কোন সমাধানে আসতে পারেনি।
সম্পত্তি থেকে একটা কানাকড়িও পাই না। বসে থাকলে তো আর পেট চলে না, তাই এই কাজ নিয়েছি। জন্তু-জানোয়ারে আমার ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ। শখের বশে জানোয়ারকে ট্রেনিং দেয়ার কাজটাও শিখে ফেললাম। সেই শিক্ষাই এখন আমার রুটিরুজির উপায়। এই কাজকে ভাল চোখে দেখে না আমার অন্য দুই ভাইবোন। না দেখুক, আমিও তাদের কাছে যাই না… সরাসরি কিশোরের দিকে তাকাল নুবার। ডোবারের সঙ্গে তাহলে ব্ল্যাক হোলোতেই দেখা হয়েছে তোমাদের? সে যে এই এলাকায় এসেছে আবার, জানতাম না। অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। ওখানে কি করছে?
তেমন কিছু না। সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করছে ব্ল্যাক হোলোর পুরানো কেবিনটায়।
সন্ন্যাসী! বিস্ময়ে কাছাকাছি হয়ে গেল নুবারের ঘন ভুরুজোড়া। অসম্ভব! ও টাকা ছাড়া চলতে পারে না! বিলাসিতা ছাড়া বাঁচতে পারে না!
দেখে তো মনে হলো, বেশ সুখেই আছে, খোঁচা দিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করল কিশোর।
কি জানি? নাক চুলকাল মুবার। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। পাগলই হয়ে গেল না কি…সত্যি যদি তার এই পরিবর্তন হয়ে থাকে, খুশিই হব।
খাওয়া-দাওয়ায়ও বিলাসিতা তেমন আছে বলে মনে হয় না, মুসা বলল। সেদিন একটা আধমরা ভেড়া কিনে নিয়ে যেতে দেখলাম। ওই বুড়ো ভেড়ার মাংসই বোধহয় খান।
খবরটা হজম করতে সময় লাগল নুবারের। আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, এতটা পরিবর্তন! নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না! ভেড়ার মাংস দু-চোখে দেখতে পারে না ও। এখন সেই মাংসই খায়, তা-ও আবার বুড়ো ভেড়ার…
পুষতে-টুষতে নেননি তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা খারাপ! জন্তু-জানোয়ার তার শত্রু। একটা কুত্তা পর্যন্ত পালতে পারল না কোনদিন।
কুত্তার কথাই যখন উঠল কি ভাবে নেবেন আপনি জানি না, মিস্টার আরিগন–তবু বলেই ফেলি, কিশোর বলল। যদি বলি আপনার ভাই কুত্তা কিডন্যাপিঙের সঙ্গে জড়িত?
কি ভাবে নিয়েছে নুবার, সেটা তার চেহারা দেখেই অনুমান করা গেল, বজ্রাহত হয়ে পড়েছে যেন। সামলে নিতে সময় লাগল। বলল, এই পরিণতিই হবে, আমি জানতাম! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! আর আমাদের পরিবারের পাপ হলো ভয়াবহ বিলাসিতা! এতক্ষণে বুঝতে পারছি, ওই কেবিন কেন থাকছে ও। সন্ন্যাসীর মত থাকার ছুতোয় নিশ্চয় কোন কুকাজ করে বেড়াচ্ছে। হায়রে, জমিদারের ছেলের শেষে এই পরিণতি! জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল সে। যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। টিকেট কেটে লোকে বসে থাকলে বিরক্ত হয়।
তাঁবুর দিকে ধীরপায়ে হেঁটে চলে গেল অ্যানিমেল ট্রেনার।
রবিন বলল, সত্যি কথাই তো বলল বলে মনে হলো। কিশোর, কি মনে হয়, ভাইয়ের সঙ্গে সে-ও জড়িত নয় তো?
মাথা নাড়ল কিশোর। না, দেখলে না, খবর শুনে সত্যি সত্যি দুঃখ। পেয়েছে। এই লোক কোন খারাপ কাজে জড়িত নয়।
হু, চুপ হয়ে গেল রবিন।
কথা তো বলা হলো, মুসা বলল, এরপর কি কাজ? কি করব এখন? আজও ঢুকব পুমার খেলা দেখতে?
নাহ, এক খেলা কবার দেখে। আর কোন কাজ নেই এখানে। চলো, ব্ল্যাক হোলোতে ফিরে যাই।
ডোবারের ওপর কড়া নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। রাত্রে কি করে লুকিয়ে থেকে দেখবে। কেবিনে ফিরে তাই আর কোন কাজ না পেয়ে, খাওয়াদাওয়ার পর শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে নিল পুরো বিকেলটা। রাতে আবার জাগতে হবে, হয়তো সারারাতই, কে জানে?
সূর্য ডোবার পর তাকে আর রবিনকে ডেকে তুলল মুসা। ডিনার তৈরি করে ফেলেছে।
পেট ভরে খেয়ে নিল তিনজনে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখল, পরিষ্কার, ঝকঝকে আকাশে তারা জ্বলছে। আজ রাতে আর ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠতে দেরি আছে। রাতের অভিযানের জন্যে তৈরি হতে লাগল ওরা। গাঢ় রঙের পোশাক পরে নিল, যাতে অন্ধকারে ভালমত লুকিয়ে। থাকতে পারে।
বেরিয়ে পড়ল ওরা। শব্দ করে ওদের অস্তিত্ব ফাঁস করে দিতে পারে, এই ভয়ে ফগকে বেঁধে রেখে এল রান্নাঘরে। হোলোর, পথঘাট এখন মোটামুটি পরিচিত। রাতে টর্চ নিভিয়ে চলতেও আর তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। নিরাপদেই চলে এল ডোবারের কেবিনটার কাছে। ঘন অন্ধকারে আবছামত চোখে পড়ল ওটার আকৃতি। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে আসছে খুব সামান্য কমলা রঙের আলো।
পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগোল ওরা।
কথা শোনা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে। ডোবার না একা থাকে বলল, তাহলে কথা বলছে কার সঙ্গে? মনোযোগ দিয়ে শুনে অন্য কণ্ঠটা কার চিনে ফেলল কিশোর, উকিল আনি হুগারফ। অবাক হয়ে ভাবল, এই লোক এখানে কি করছে!
…বললাম না, ডরোথির সঙ্গে দেখা করেছি আমি! হুগারফ বলছে, একচুল নড়াতে পারিনি ওকে। তার সেই এক কথা।
অধৈর্য ভঙ্গিতে চেয়ার ঠেলে সরানোর শব্দ হলো। শোনা গেল ডোবারের ভারি গলা, অসহ্য! এ একটা জীবন হলো নাকি! এ ভাবে বাঁচা যায়! আর দেরি করতে পারব না, আমি আমার সম্পত্তির ভাগ এখনই চাই!
চাইলেই তো আর হলো না, মীমাংসা করতে হবে আগে..আমিও বিরক্ত হয়ে গেছি। অনেক টাকা পাওনা হয়ে গেছে তোমার কাছে, সেটা যে কবে পাব কে জানে! আসল কথা বলো এখন, এদিকের খবর কি?
জবাব শোনার আশায় কান খাড়া করে রইল দুই গোয়েন্দা। কিন্তু কথা শোনা গেল না, তার পরিবর্তে চেয়ার টানাটানি..
কথা বলছে না কেন? ভাবল কিশোর। নাকি হুগারফকে কিছু দেখাচ্ছে। ডোবার?
হঠাৎ তার কাঁধ খামচে ধরল মুসা। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কেউ আসছে? একদম নড়বে না!
পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে এখন কিশোর আর রবিনও। দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। আশা করল, এ ভাবে থাকলে, যে আসছে তার চোখে পড়বে না ওরা এই অন্ধকারে। কিন্তু যদি টর্চ জ্বালে? আর আসছেটাই বা কে? ভাইয়ের পরিস্থিতির খবর পেয়ে তাকে দেখতে এসেছে নুবার? নাকি পিচার? পিচার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ এখানে ডোবারের পিছে লেগে থাকে সে; নিশ্চয় কারা আসে কারা যায় লক্ষ করে।
হঠাৎ করেই থেমে গেল পদশব্দ। পনেরো মিনিট চুপ করে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল গোয়েন্দারা। কিন্তু আগন্তুকের আর কোন সাড়া নেই।
.
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে চোখ ব্যথা করে ফেলল ওরা, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না।
কেবিনের ভেতর আবার ভারী গলায় কথা বলে উঠল ডোবার, খুব শীঘ্রি কিছু টাকা পেয়ে যাব। না পেলে আমারও চলবে না আর। কিছু একটা করতেই হবে!
হ্যাঁ, ভাল কথা, ছেলেগুলোর কি খবর? আচমকা প্রশ্ন করল হুগারফ।
যায়নি এখনও। আমার মনে হয় রিচটনের ভাবনাটা এখনও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।
ওদের কথাই আলোচনা হচ্ছে, বুঝতে পারল কিশোর।
ভাগাতে হবে তো। নইলে কখন কোন বিপদে ফেলে দেবে কে জানে! সাংঘাতিক ছোঁক ছোঁক করা স্বভাব।
বুঝতে পারছি না কি করব? দেখা যাক!
দরজা খোলার ক্যাচকোচ শব্দ হলো। দেয়ালের সঙ্গে গা চেপে ধরে মিশে রইল তিন গোয়েন্দা, পারলে পাথরের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়।
খোলা দরজা দিয়ে আলো পড়ল ঘাসের ওপর। বেরিয়ে এল উকিল। পেছনে আবার দরজা লাগিয়ে দিল ডোবার। বনে গিয়ে ঢুকল হুগারফ, পায়ের শব্দ ঢাকার কোন চেষ্টাই করল না।
পথের ধারের একটা কালো ঝোপ নড়ে উঠল বলে মনে হলো কিশোরের, মুসারও চোখে পড়ল ব্যাপারটা। তারমানে এতক্ষণ কেউ লুকিয়ে ছিল ওখানে।
এগিয়ে গেল হুগারফের পদশব্দ। যে ঝোপটা নড়েছে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লম্বা ছায়ামূর্তি। পিছু নিল উকিলের।
আমাদের ওপর নয়, ফিসফিস করে মুসা বলল, হুগারফের ওপর নজর রাখছিল। কোথায় যায় দেখব?
দেখো তো, জবাব দিল কিশোর। আমরা এখানেই আছি। দেখি, আর কি ঘটে, আর কেউ আসে কিনা?
কয়েক মিনিট পরই ফিরে এল মুসা। জানাল, পিচারের মতই মনে হলো। ও আসলে চোখে চোখে রাখছে লোকগুলোকে।
কেন? রবিনের প্রশ্ন।
স্বাভাবিক কৌতূহল হতে পারে। নিশ্চয় সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে।
বসে আছে তো আছেই ওরা। খুব ধীরে কাটছে একঘেয়ে সময়, স্থির হয়ে আছে যেন। কিন্তু আকাশের তারাগুলোর স্থান পরিবর্তন প্রমাণ করে দিল, না, ধীরে হলেও সময় কাটছে। পুবের আকাশে হালকা একটা আভা ফুটল। অবশেষে গাছপালার মাথার ওপর বেরিয়ে এল কাস্তের মত বাকা হলুদ চাঁদ। হালকা, কনকনে ঠাণ্ডা একঝলক বাতাস যেন লাফ দিয়ে এসে নামল বদ্ধ উপত্যকাটায়।
আবহাওয়া পরিষ্কার হলে কি হবে, পার্বত্য এলাকার ঘন শিশির ঠিকই পড়তে লাগল। ভিজিয়ে দিল ছেলেদের চুল, কাপড়। সেঁতসেঁতে কাপড় পরে। থাকাটা এমনিতেই অস্বস্তিকর, তার ওপর এই ঠাণ্ডা বাতাস কাপুনি ধরিয়ে দিল শরীরে। একভাবে বসে থেকে থেকে পায়ের পেশীতে খিল ধরে গেছে।
এতক্ষণ ডোবারের কেবিনের দরজায় যে হালকা আলোটা ছিল, সেটাও নিভে গেল। শুয়ে পড়েছে বোধহয় সে। আর বসে থাকার কোন মানে হয় না। উঠল ওরা। ফিরে চলল নিজেদের কেবিনে।
খাড়া পথ বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ কিশোরের হাত আঁকড়ে ধরল মুসা, শুনছ!
অবশ্যই শুনছে কিশোর আর রবিনও। কাঁপা কাঁপা একটা টানা তীক্ষ্ণ চিৎকার।
নিশ্চয় সেই পেঁচাটা! রবিন বলল। এল কোনখান থেকে?
হোলোর ওপার থেকে, জবাব দিল কিশোর। মনে তো হলো, ডোবারের ঘরের কাছেই ডাকল।
ভালই হয়েছে, কণ্ঠস্বর নামিয়ে বলল মুসা, জোরে বলতে ভয় পাচ্ছে, আমরা ওখানে থাকতে ডাকেনি। তাহলে বারোটা বাজত! ভূতের সঙ্গে
পেঁচার বড় ভাব! একসঙ্গে উড়ে চলে ওরা আকাশপথে!
হোলোর ওপর উঠে এল ওরা। কেবিনের আলোর দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অন্য এক জগৎ থেকে যেন বেরিয়ে এল পরিচিত পৃথিবীর অভ্যস্থ পরিবেশে। ভূত বিশ্বাস না করলেও, মুসার মত ভয় না পেলেও পেঁচার ডাকটা অন্য দু-জনেরও ভাল লাগেনি।
কেবিনে ঢুকে দেখল, ভালই আছে ফগ। মুসাকে দেখে আদুরে গলায় কুঁই কুঁই শুরু করল। এগিয়ে গিয়ে ওটাকে আদর করল সে।
ঘুমানোর আগে ঠাণ্ডা দূর করার জন্যে মগে গরম চকলেট ঢেলে নিয়ে বসল তিনজনে।
মগে চুমুক দিয়ে রবিন বলল, তাহলে বোঝা গেল, হুগারফ ডোবারের উকিল। এবং দু-জনেই টাকার পাগল।
কিছু টাকা আসবে বলল ডোবার, কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। কোত্থেকে আসবে বলো তো?
আর যেখান থেকেই আসুক, সম্পত্তি বিক্রি করে নয় এটা ঠিক, কিশোর বলল। এখনও জায়গাটার কোন মীমাংসাই হয়নি।
বেআইনী কিছু করছে না তো? রবিনের প্রশ্ন।
কি জানি! তবে টাকার যখন এত লোভ, করলে অবাক হব না। তার ভাইয়েরও তো সে-রকমই সন্দেহ।
কিশোর, মুসা বলল, হুগারফের পাওনা টাকা দেয়ার ভয়ে কোথাও গিয়ে লুকাননি তো ক্যাপ্টেন?
মাথা নেড়ে রবিন বলল, আমার মনে হয় না। একজন পুলিশ অফিসার, মিস্টার সাইমনের বন্ধু, হুগারফের মত একটা হেঁচড়া লোক তার কাছে টাকা। পাবে, এ কথা আমার বিশ্বাস হয় না। কিশোরের দিকে তাকাল সে, ডোরারের কথা শুনে কিন্তু মনে হলো; টাকার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিছু একটা ঘটাবে মনে হলো। কি, বলো তো?
এটা জানলে তো অনেক প্রশ্নেরই জবাব পাওয়া যেত। চলো, শুয়ে পড়ি, রাত প্রায় শেষ। এখন মাথা ঘামিয়ে কিছু করতে পারব না, কাজ করবে না মগজ। তবে একটা কথা বলে রাখি, কাল সকালে উঠেই ডরোথি আরিগনের খোঁজে বেরোব আমরা। দুই ভাইয়ের সঙ্গেই দেখা হলো, বোনকে বাদ দেয়া উচিত না। হয়তো ওখানে জরুরী কোন তথ্য পাওয়া যাবে।
পাবে কোথায় তাকে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
দেখি, সে-কথা সকালে উঠে ভাবব।
.
অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙল ওদের। কুকুরের বাচ্চাটা খুব শান্ত, ডাকাডাকি করে অহেতুক বিরক্ত করেনি বলেই ওরা ঘুমাতে পারল।
নাস্তার টেবিলে বসে ঘোষণা করল কিশোর, খেয়ে ফরেস্টবার্গে রওনা হব। প্রথমে ডরোথি আরিগনের নামটা খুঁজব টেলিফোন গাইডে। না পেলে তখন অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।
কি ব্যবস্থা? জানতে চাইল রবিন।
খোঁজখবর করব। মহিলাদের খবর মহিলারাই বেশি রাখে। মহিলারা চালায় এমন সব দোকানে ঢুকে তাদেরকে জিজ্ঞেস করব। পুরুষেরা মুখ বন্ধ রাখলেও মহিলারা অতটা রাখতে পারবে না। কিছু না কিছু ফাঁস করে দেবেই।
সুতরাং নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়ল ওরা।
ফরেস্টবার্গে এসে সহজেই পেয়ে গেল ডরোথি আরিগনের ঠিকানা। কোর্টহাউসে পাবলিক টেলিফোনের ব্যবস্থা আছে যেখানে, সেখানে একগাদা ফোনবুক পাওয়া গেল। ফরেস্টবার্গের আশেপাশে আরও যে কটা শহর আছে, সবগুলোর ফোন নম্বর আছে একটা বইতে। দেখা গেল, ডরোথি বাস করে উডে।
ম্যাপ দেখে রাস্তা বের করে ফেলল কিশোর। গাড়ি চালাল রবিন।
দুপুরের একটু আগে লাল গাড়িটা এসে ঢুকল ব্রুকউডের শান্ত, প্রায় নির্জন মেইন রোডে। দুই পাশে বড় বড় সাদা বাড়ি, সামনে সুন্দর লন আর বাগান। প্রচুর গাছপালা আছে।
সুন্দর শহর, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। পুরানোও।
এক কাজ করলে হয় না? রবিন বলল, ডরোথির সঙ্গে দেখা করার আগে তার সম্পর্কে বাইরের লোকের কাছে একটু খোঁজখবর নিয়ে নিই। কথা বলতে সুবিধে হতে পারে।
মন্দ বলনি।
একজায়গায় বেশ কয়েকটা পুরানো বাড়ি প্রায় গায়ে গায়ে লেগে থাকতে দেখা গেল। বাণিজ্যিক এলাকা, আন্দাজ করল কিশোর। গাড়ি রাখতে বলল। রবিনকে।
সাইনবোর্ড দেখে একটা চায়ের দোকানে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। কুকুরের বাচ্চাটাকে গাড়িতে রেখে এসেছে,। দোকানের ভেতরের চেহারা দেখে দমে গেল মুসা। বলল, এখানে ঢুকে লাভটা কি হলো? খাওয়ার জিনিস পাব বলে তো মনে হয় না। সবই বুড়োবুড়ি; দেখগে, সবগুলো ডায়েট কন্ট্রোল করে।
এদের কাছেই তো খবরটা পাওয়া যাবে, হেসে বলল কিশোর। কাজ নেই কর্ম নেই, মানুষের সমালোচনা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই ওদের।
ওরা টেবিলে গিয়ে বসতেই লম্বা, মাঝবয়েসী অ্যাপ্রন পরা এক মহিলা এগিয়ে এল।
গুড মর্নিং বলল কিশোর। আমরা বহুদূর থেকে এসেছি, বেড়াতে। খিদে পেয়েছে। ভাল কিছু দিতে পারেন?
কিশোরের ভদ্রতায় খুশি হলো মহিলা। হেসে বলল, বসো, আনছি।
মুসাকে অবাক করে দিয়ে ডিমের ওমলেট, ভেজিটেবল সালাদ আর বরফ ও তাজা মিন্টের ফ্লেভার দেয়া কোল্ড টী এনে দিল মহিলা। জিজ্ঞেস করল, চলবে?
চলবে মানে! এখানে এলে এই দোকান ছাড়া আর চা খেতেই ঢুকব,তাড়াতাড়ি ডিমের প্লেটটা টেনে নিল মুসা।
আস্তে খাও, রসিকতা করে বলল রবিন। বুড়োবুড়িদের খাবার, গলায় আটকে ফেলো না।
চলে গেল মহিলা। ফিরে এল বড় এক প্লেট স্ট্রবেরি পাই নিয়ে। টেবিলে নামিয়ে রাখল।
আন্তরিক খুশি হলো মুসা। ঢোকার আগে যে অনীহাটা ছিল, একেবারে দূর হয়ে গেছে।
খেতে খেতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, ডরোথি আরিগন নামে কাউকে চেনেন? ব্ল্যাক হোলোতে বিশাল সম্পত্তি আছে তাদের। আমার মার বান্ধবী। বলেছে দেখা করে যেতে। কিন্তু আমি চিনি না।
চিনব না কেন? অনেক বড় দরজির দোকান দিয়েছে। আশপাশের সব শহর থেকে লোকে কাপড় বানাতে আসে তার কাছে।
কাছেই থাকে?
না।
হ্যাঁ। মহিলা বেশ ভাল, তবে অহঙ্কারী। এই অহঙ্কারটা অবশ্য আরিগনদের রক্তের দোষ, ওদের সবার মধ্যেই আছে। আর এই নিয়েই তো গণ্ডগোলটা বেধেছে, কেউ কারও কথা মানতে চায় না, নিজের ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিতে চায়। পরিবারটাই ভেঙে গেল এ কারণে।
নতুন কয়েকজন ঢুকল দোকানে। তাড়াহুড়ো করে সেদিকে চলে গেল। মহিলা, আর কোন কথা জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না গোয়েন্দারা। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। ডরোথির বাড়িতে যাওয়ার সময় রবিন বলল, কি ভাবে কথা শুরু করবে তার সঙ্গে? ছুতোটা কি?
দেখি, জবাব দিল কিশোর, একটা কিছু বের করেই ফেলব।
পুরানো আমলের একটা বাড়ির সামনে গাড়ি রাখল রবিন। এখানেই থাকে ডরোথি। একসঙ্গে সবাই ঢুকলে বিরক্ত হতে পারে মহিলা, সেজন্যে কিশোর একাই চলল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে কাঁচের দরজায় লাল রঙে লেখা দেখতে পেল:
ড্রেস ডিজাইনার
ডরোথি আরিগন
খোলা দরজা। ভাল রকম সাজানো গোছানো একটা সিটিং রুমে ঢুকল। কিশোর। কেউ নেই। হয়তো ভেতরে গেছে, আসবে ভেবে একটা সোফায় বসে পড়ল সে। চোখ বোলাতে লাগল সারা ঘরে। পুরু কার্পেট, চকচকে পালিশ করা আসবাবপত্র, চমৎকার ডেকোরেশন। ব্যবসা ভালই চলছে।
প্রায় নিঃশব্দে খুলে গেল একটা দরজা। ঘরে ঢুকল লম্বা, সুন্দরী এক মহিলা, বয়েস চল্লিশের কোঠায়, কালো চুল। গর্বিত ভঙ্গিই প্রমাণ করে দেয়, আরিগনদের বংশধর। তার পেছনে ছাগলছানার মত লাফাতে লাফাতে বেরোল হাসিখুশি একটা ছোট কুকুর। এগিয়ে এল কিশোরের দিকে।
ওটার মাথা চাপড়ে দিতে গিয়ে হাত থেমে গেল তার। মনে পড়ল। বাদামী রঙের কুকুর, একটা কান সাদা! গলায় কলার নেই, নাম লেখা ট্যাড নেই। পটির ডব নয় তো এটা?
উঠে দাঁড়াল কিশোর, হেসে বলল, সুন্দর কুকুর। অবিকল একই রকমের আরেকটা কুকুর দেখেছি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে। মনে হয় এটার ভাইই হবে। পেলেন কোথায়, মিস আরিগন?
আমার ভাই দিয়েছে, মহিলা গোমড়ামুখো নয়, তবে ততটা আন্তরিকও নয়। বনের মধ্যে নাকি একা একা ঘুরছিল। মালিককে খুঁজে পায়নি। সে কুকুর পছন্দ করে না। তাই আমাকে দিয়ে গেছে।
ব্ল্যাক হোলোতে থাকেন যে, মিস্টার ডোবার আরিগন, তিনি নন তো?
চেনো নাকি?
পরিচয় হয়েছে। ওখানে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বনের মধ্যে দেখা হয়ে গেল, একটা পাথরের কেবিনে সন্ন্যাসী হয়ে আছেন মিস্টার আনি।
স্থির দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে ডরোথি, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, সন্ন্যাসী!
সে-রকমই তো মনে হলো। তিনিও তাই বললেন।
কি জানি? অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ডরোথি। হ্যাঁ, বলো কি জন্যে। এসেছ?
ডিজাইন। আপনার অনেক নামটাম শুনে মা বলছিল, আপনার কাছ। থেকে পোশাকের একটা নতুন ডিজাইন নিতে পারলে ভাল হত। এদিকে একটা কাজে এসেছি, আপনার বাড়ির সামনে নেমপ্লেটটা দেখে হঠাৎ মনে পড়ল মার কথা। ঢুকে পড়লাম।
হাসল মহিলা। তুমি খুব ভাল ছেলে, কবে কি বলল ঠিক মনে রেখে দিয়েছ। মায়ের কথা শোনে নাকি আজকালকার ছেলেরা! ঠিক আছে, তোমার মাকে গিয়ে বোলো আমার কাছে চিঠি লিখতে। কি চায় বুঝে দেখি।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলাকে লক্ষ করছে কিশোর। তাকে সন্দেহ করছে না তো? কিন্তু ডরোথির হাসিমুখ দেখে তার মনের কথা কিছুই আঁচ করতে পারল না সে। আর কোন প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে বলল, আচ্ছা, যাই।
চিন্তিত ভঙ্গিতে গাড়িতে এসে উঠল সে। কি জেনেছে জানার জন্যে উৎসুক হয়ে আছে দুই সহকারী গোয়েন্দা। কিশোর বলল, পটির কুকুরটাকে খুঁজে পেয়েছি। চুরি করে এনে বোধহয় বোনকে দিয়ে দিয়েছে ডোবার।
মুসা বলল, বলো কি? দান করার জন্যে চুরি করে, এমন কথা তো শুনিনি।
কি জানি, বুঝতে পারছি না!
আর কি জানলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
আমাদের কাজে লাগার মত কিছু না। মহিলার ব্যবসা খুব গরম, এটা বুঝলাম। টাকার জন্যে সম্পত্তি বিক্রি কিংবা বেআইনী কাজ করার কোনই প্রয়োজন নেই।
তারমানে এগোনো আর গেল না, নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুসা। রহস্যের জট থেকেই গেল!
জট ছাড়াতে হলে একটা জায়গারই খুব কাছাকাছি থাকতে হবে, ব্ল্যাক হোলো। ভাবছি, আজ রাতে কেবিনে না থেকে বনের মধ্যেই ক্যাম্প করে থাকব কিনা। রাত হলে ফিরব আমরা। ঘরেও ঢুকব না, আলোও জ্বালব না। আমরা চলে গেছি মনে করে এমন কিছু করে বসতে পারে ডোবার, যা সব রহস্যের সমাধান করে দেবে।
এতটা সময় তাহলে কি করব?
ঘুরে বেড়াব। এলাকাটা দেখব।
.
ক্যাপ্টেনের কেবিনের কাছে গাড়ি নিল না ওরা। পথের পাশে কয়েকটা গাছের আড়ালে পার্ক করে রেখে অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে ঢুকল কেবিনে। কুকুরটাকে বাধল রান্নাঘরে, তাকে সঙ্গে নেয়া যাবে না, কিছু দেখলে চিৎকার শুরু করবে। একা তাকে এ ভাবে ফেলে যেতে ভাল লাগছে ওদের, তবু কিছু করার নেই। স্লীপিং ব্যাগগুলো বের করে নিয়ে ঢুকে পড়ল পাশের বনে, পায়েচলা পথ ধরে নেমে এল উপত্যকায়। একটা ঘন ঝোপের ধারে শোয়ার ব্যবস্থা করল।
চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে লাগল কিশোর। কয়েকটা তারা মিটমিট করছে। পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে আকাশ খুব একটা চোখে পড়ে না; পড়লে দেখত, দিগন্তের কাছে ইতিমধ্যেই জমে গেছে একটুকরো কালো মেঘ।
ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার।
অন্ধকারে মুসার ফিসফিসে কণ্ঠ শোনা গেল, শুনছ!
হ্যাঁ, জবাব দিল রবিন, পেঁচা ডাকছে।
কয়েক মিনিট পর আবার ডাক শোনা গেল, এবার অন্য রকম। কয়েকবার ডেকে থেমে গেল।
এটা পেঁচা নয়! গলা কাঁপছে মুসার। ডাইনী!
হ্যাঁ, কিশোর বলল, পেঁচার মত ঠিক না, বরং মানুষের চিৎকারের সঙ্গে মিল আছে। প্রথম রাতে যেটা শুনেছিলাম, তার সঙ্গে এগুলোর একটারও মিল নেই।
সেজন্যেই তো বলছি পেঁচা, জোর দিয়ে বলল রবিন। তবে দু-রকম পেঁচা।
প্রথম দিনেরটা তাহলে কি ছিল..? অন্ধকারে গাছের আড়াল থেকে। লম্বা একটা ছায়ামূর্তিকে বেরোতে দেখে চমকে উঠে বসল মুসা, কে!
চোখের পলকে দুটো টর্চের আলো বিদ্ধ করল মূর্তিটাকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন, ও, তুমি, পিচার!
কি চাও? জিজ্ঞেস করল মুসা, তারপর মনে পড়ল পিচার বোবা, জবাব দিতে পারবে না।
বসে পড়ল পিচার। কিশোর, রবিন, আর মুসার দিকে আঙুল তুলে হাত নাড়ল জোরে জোরে।
মনে হয়, তাড়াতাড়ি এখান থেকে আমাদের পালাতে বলছে, রবিন বলল। নিশ্চয় কোন বিপদ! কি বিপদ, পিচার? পকেট থেকে নোট্টবুকের পাতা ছিঁড়ে দিল সে। পেন্সিল বের করে দিল কিশোর।
টর্চের আলোয় দ্রুত একটা জানালাবিহীন কেবিন এঁকে ফেলল ছেলেটা। একমাত্র দরজা দিয়ে বেরিয়ে আছে একটা বন্দুকের নল।
ডোবারের কেবিন, উত্তেজনায় ফিসফিস করে বলল রবিন। তার কাছে। বন্দুক আছে। কি করছে…
দাঁড়াও, বাধা দিল কিশোর আরও কিছু আঁকছে।
দুটো পেঁচার মাথা আঁকল পিচার। কিন্তু একটা পেঁচার খাড়া খাড়া কান, আরেকটার কান নেই বললেই চলে। পেঁচার চেয়ে বানরের মুখের সঙ্গেই ওটার মিল বেশি।
আঁকিয়ে বটে! আবারও প্রশংসা করতে হলো রবিনকে, দারুণ হাত! দেখলে, বলেছিলাম না পেঁচার ডাক? দুটো দুরকম পেঁচা। একটার ডাকের সঙ্গে মানুষের গলার মিল বেশি, সেটাকেই ডাইনী ভাবে লোকে।
এঁকেই ক্রস চিহ্ন দিয়ে দুটোকে কেটে দিল পিচার। হাত নেড়ে আবার চলে যেতে বলল তিন গোয়েন্দাকে।
বুঝলাম না, কিশোর বলল। পেঁচাকে ভয় পাও তুমি?
উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল পিচার।
ডাইনীর সঙ্গে পেঁচার সম্পর্ক আছে বলছ? ওগুলোর কবল থেকে বাঁচাতে চাও আমাদের?
জোরে মাথা ঝাঁকাল ছেলেটা।
মনে হয়, মুসা বলল, পেঁচাগুলোকে গুলি করার কথা বলছে ডোবার।
মাথা নাড়ল পিচার, মুসার অনুমানও ঠিক না।
নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না, রবিন বলল। তবে ডাইনীই হোক, পেঁচাই হোক, কিংবা ডোবার, কারও ভয়েই এখান থেকে যাচ্ছি না আমরা। বুঝলে?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল পিচার। তারপর নিরাশার ভঙ্গি করল।
কিশোর বলল, বরং একটা উপকার করতে পারো আমাদের। কুকুরের বাচ্চাটা একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। ওকে তোমার কাছে নিয়ে যাও, তাতে আমাদের কাজ করতে সুবিধে হবে। একলা ওকে ঘরের মধ্যে ফেলে রাখাটা নিষ্ঠুরতা।
মাথা ঝাঁকাল পিচার। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল, তেমনি করেই হারিয়ে। গেল গাছের আড়ালে।
আলো নিভিয়ে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। অন্ধকারে বিড়বিড় করল কিশোর, সারাক্ষণই ডোবারের পেছনে লেগে আছে! নিশ্চয় তার সঙ্গে কোন দুর্ব্যবহার করেছে লোকটা… পেঁচা এঁকে কি বোঝাতে চাইল, বুঝতে পারলে ভাল হত…
বিদ্যুৎ চমকাল এই সময়।
সর্বনাশ, বৃষ্টি আসবে নাকি? শঙ্কিত হয়ে উঠল রবিন, তাহলে তো আর বাইরে থাকা যাবে না।
মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটবেই, কিশোর বলল। ঝড় এখনও অনেক দূরে, আসতে দেরি আছে। দেখি, যতক্ষণ থাকতে পারি থাকব।
কয়েক মিনিট পর খুট করে একটা শব্দ হলো।
কি ব্যাপার? আবার ফিরে আসছে নাকি পিচার? মুসার প্রশ্ন।
ছেলেটা যেদিকে গেছে সেদিকে তাকাল কিশোর। আরও গাঢ় হয়েছে। অন্ধকার। মেঘ জমেছে আকাশে, তারার আলোও নেই।
আবার হলো শব্দটা।
তারপরই ভারি নীরবতাকে খান খান করে দিল ভয়াবহ, তীক্ষ্ণ চিৎকার। পরক্ষণে আবার। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আরও একবার। কেমন যেন মানুষের চিৎকারের মত।
প্রথম রাতে এই চিৎকারই শুনেছি! নিশ্চয় কেউ বিপদে পড়েছে! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জলদি ওঠো!
ডাইনীটা তো আছেই দেখা যাচ্ছে, গল্প নয়! জুতো পায়ে গলাতে গলাতে বলল মুসা। কাউকে ধরে এনে রক্ত খাওয়ার তাল করছে নাকি?
জবাব দিল না কেউ। এই সময় আবার বিদ্যুৎ চমকাল।
কিশোরের জুতো পরা শেষ। বলল, কাছেই কোথাও। চলো।
টর্চ জ্বেলে দৌড় দিল ওরা। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়াল কিশোর, কারণ আবার শোনা গেল চিৎকার। কোনখান থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করল। উপত্যকার নিচে নয়, ওপরে, ঢালের গায়ে রয়েছে, বলল সে। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া পায়েচলা পথটা ধরে ছুটল আবার।
ঢালের মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেল আবার।
হাঁপাতে হাঁপাতে রবিন বলল, আর তো শোনা যাচ্ছে না! যাব। কোনদিকে?
আমি কিন্তু আরেকটা শব্দ শুনছি, কান পেতে আছে মুসা,। তোমার শুনছ না?
শোনাটা কঠিনই। কারণ এখন আর নীরব হয়ে নেই রাতটা। ঝড় আসার সঙ্কেত জানিয়ে শুরু হয়ে গেছে প্রবল বাতাস, দমকে দমকে ঢেউয়ের মত আসছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, সেই আলোয় চোখে পড়ছে দুলন্ত গাছের মাথা, পাগল হয়ে উঠেছে যেন গাছগুলো। এদিকে মাথা নোয়াচ্ছে, ওদিকে হেলে পড়তে চাইছে, মড়মড় করে উঠছে ডাল, পাতার মধ্যে দিয়ে শিস কেটে যাচ্ছে বাতাস। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে দিয়েও শব্দটা ঠিকই কানে আসছে মুসার। স্বর
কিসের শব্দ? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মানুষের চিৎকার বলে মনে হলো কিন্তু বাতাস যা আরম্ভ করেছে, বুঝতে পারছি না…
বড় করে বিদ্যুৎ চমকাল, থাকল অনেকক্ষণ। হাত তুলে কাছের একটা গাছ দেখাল রবিন। চুপ করে বসে আছে একটা পেচা, বাতাসের পরোয়া করছে না, বড় বড় চোখগুলো কেমন ভূতুড়ে লাগল। ক্ষণিকের জন্যে দেখা, গেল দৃশ্যটা, আলো নিভে যেতেই আবার অদৃশ্য হয়ে গেল।
আচমকা উপত্যকার নিচ থেকে ভেসে এল ভয়াবহ চিৎকার। ভীষণ চমকে দিল তিন গোয়েন্দাকে। মনে হলো এগিয়ে আসছে শব্দটা। তাড়াতাড়ি কাছের একটা বড় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ওরা। নজর বাঁয়ের–একটুখানি ঘাসে ঢাকা খোলা জায়গার দিকে।
হঠাৎই চোখে পড়ল ওটাকে। কালো, ভারী একটা শরীর, বিশাল বেড়ালের মত চারপায়ে ভর করে বেড়ালের মতই হেলেদুলে বন থেকে বেরিয়ে এল খোলা জায়গাটায়। তারপর নিঃশব্দে, যেন বাতাসে ভেসে পার। হয়ে গিয়ে ঢুকল অন্য পাশের কালো বনের মধ্যে।
বনবেড়াল! ফিসফিসিয়ে বলল উত্তেজিত রবিন। এই তাহলে ডাইনী! চিৎকার ওটারই!
কিন্তু এখানে বনবেড়াল আসবে কোত্থেকে? প্রতিবাদ করল কিশোর, এই অঞ্চলে ওই জীব বাস করে না। তাছাড়া বনবেড়াল এত বড় হয় না।
চুপ! ওদের থামতে বলল মুসা, এখনও আগের ক্ষীণ শব্দটা শোনার চেষ্টা করছে।
এইবার শুনতে পেল তিনজনেই। বাতাসের গর্জন আর বজ্রের শুড়গুডুকে ছাপিয়ে শোনা গেল পাতলা, কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার, বাচ্চা ছেলের কণ্ঠ, ডব! ডঅব! ডবিইইই!
খাইছে! এ তো পটি! বলে উঠল মুসা, এত রাতে বনের মধ্যে এসেছে। কুকুর খুঁজতে!
সামনেই আছে কোথাও! কিশোর বলল।
তার কথা শেষ হতে না হতেই সেই ভীষণ চিৎকারটা আবার শোনা গেল। থেমে যেতেই কানে এল বাচ্চা ছেলের ভীত ফোপানোর শব্দ, ডব, ডবি, কোথায় তুই?…আমার ভয় লাগছে।
আর শোনার অপেক্ষা করল না তিন গোয়েন্দা। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল শব্দ লক্ষ্য করে। আবার চিৎকার করে উঠল বিশাল জন্তুটা।
পটারের কান্নার শব্দ জোরাল হচ্ছে, আমার ভয় লাগছে। আমি বাড়ি যাব! মা, মাগো, কোথায় তুমি!
চিৎকার করে মুসা বলল, পটি, যেখানে আছো দাঁড়িয়ে থাকো! নোড়ো না!
সামনে হঠাৎ পথ আটকে দিল একটা গাছের মাথা, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে ডালপাতা। নিচের উপত্যকায় গোড়া ওটার, মাথাটা উঠে এসেছে এখানে। তারমানে গর্তের কিনারে পৌঁছে গেছে গোয়েন্দারা, সামনে খাড়া হয়ে নেমেছে দেয়াল।
কিনারে এসে টর্চ জ্বেলে মরিয়া হয়ে পথ খুঁজল ওরা। প্রথমে চোখে পড়ল শুধু ঝড়ে দুলন্ত গাছপালার মাথা।
ওই যে? চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
অবশেষে সবকটা টর্চের আলোই খুঁজে পেল ছোট্ট ছেলেটাকে। জারসি আর শর্ট ট্রাউজার পরনে, ওদের নিচে বড় একটা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে। থরথর করে কাঁপছে। একহাতে মুখ ঢেকে রেখেছে, আরেকটা হাত তুলে রেখেছে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে।
কয়েক গজ দূরে টর্চের আলোয় ঝিক করে উঠল ভয়ঙ্কর দুটো সবুজ চোখ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে শিকারের দিকে। কেশে ওঠার মত শব্দ করল জানোয়ারটা। ধীরে ধীরে শরীরের সামনের অংশ নিচু হয়ে যাচ্ছে। লেজ নাড়ছে এপাশ ওপাশ। শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে ওটা।
বিশাল এক পুমা। হলুদ রঙ।
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মুসা। গর্তের কিনারের একটা বড় পাথর দেখিয়ে বলল, কিশোর, ওই পাথরটা গড়িয়ে দাও আমি পটিকে তুলে আনছি!
জানোয়ারটার চোখে টর্চের আলো নাড়ছে রবিন, ওটাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়ার জন্যে। তাতে আক্রমণ চালাতে দেরি করবে, সময় পাবে মুসা। কিশোর ছুটে গেল পাথরটার দিকে।
কোন রকম দ্বিধা না করে শূন্যে ঝাঁপ দিল মুসা। পড়ল বড় গাছটার মাথায়। একটা ডাল ধরে ফেলল। তারপর এ ডাল থেকে সে-ডালে দোল খেতে খেতে নেমে চলে এল পটির মাথার ওপরের একটা নিচু ডালে।
টর্চের আলো দেখে ওপরে তাকিয়ে আছে পটি।
দড়াবাজিকরের মত হাঁটু ভাজ করে ভেতরের দিকটা ডালে আটকে দিয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ল মুসা। দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, জলদি হাত ধরো!
ভয়ে, বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে পটি। মূসার কথা যেন বুঝতেই পারল না। তাকিয়ে আছে নীরবে। তারপর যেন যন্ত্রচালিতে মত ধীরে ধীরে ওপর দিকে তুলে দিতে লাগল দুই হাত।
গর্জন করে সামনে ঝাঁপ দিল পুমাটা। একই সময়ে ডাল আর ঝোপঝাড় ভেঙে ওটার ওপর নেমে আসতে লাগল পাথর। মাটি ভিজে গোড়া আলগা হয়ে ছিল, কাজেই ঠেলে ফেলতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি কিশোরের।
থমকে গেল জানোয়ারটা। এই সুযোগে পটির হাত দুটো চেপে ধরে ওপর দিকে তুলে ফেলল মুসা। তাকে নিয়ে উঠে বসল ডালের ওপর।
লাফিয়ে উঠে দুজনকেই ধরে ফেলতে পারত জানোয়ারটা। কিন্তু ওপর থেকে খসে পড়া বিরাট পাথর ঘাবড়ে দিল তাকে, একলাফে ঢুকে পড়ল ঝোপের মধ্যে। আর বেরোল না।
পটিকে নিয়ে গাছ বেয়ে ওপরে উঠে আসতে যথেষ্ট কসরত করতে হলো মুসাকে। গাছের মাথার কাছে পৌঁছে একটা ডাল বেয়ে চলে এল খাদের কিনারে। হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে টেনে নিল কিশোর আর রবিন।
মুসাও নেমে উঠে এল খাদের কিনারে। প্রচণ্ড পরিশ্রমে দরদর করে ঘামছে।
উত্তেজনা শেষ হয়ে যেতে হঠাৎ করেই যেন ক্লান্তিতে হাঁটু ভেঙে আসতে লাগল তিনজনের। খাদের কিনার থেকে সরে গিয়ে বসে পড়ল মাটিতে।
রবিন বলল, একটা খেলা দেখালে বটে তুমি, মুসা! টারজান ছবিতে হীরোর রোলটা চাইলেই তোমাকে দিয়ে দেবে পরিচালক।
মুসা বলল, কাজে লেগেছে কিশোরের পাথর ফেলাটা। ওটা না পড়লে ভয়ও পেত না, যেও না জানোয়ারটা। পটি আর আমি দুজনেই মরতাম!
ফোঁপাচ্ছে এখনও পটি। তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিল রবিন, কেঁদো না, আর ভয় নেই। বাড়ি নিয়ে যাব তোমাকে। কুকুরটাকে খুঁজতে এসেছিলে তো? ওটাকেও পেয়ে গেছি আমরা। শীঘ্রি এনে দেব।
সত্যি পেয়েছ?
হ্যাঁ।
এ ভয়ে, ক্লান্তিতে অবশ হয়ে গেছে ছেলেটা, হাঁটারও শক্তি নেই। তাকে কোলে তুলে নিল মুসা। টর্চ জেলে আগে আগে চলল কিশোর, পেছনে রইল রবিন। সতর্ক রইল, অন্য কোন দিক দিয়ে ঘুরে এসে যাতে আক্রমণ চালাতে না পারে জানোয়ারটা। ঢাল থেকে নেমে, উপত্যকা পার হয়ে কেবিনে ওঠার পথটায় পড়ল ওরা। নিরাপদেই উঠে এল ওপরে। বিদ্যুতের বিরাম নেই, থেকে থেকেই চমকাচ্ছে। বনের বাইরে বেরিয়ে এসে এখন আকাশ চোখে পড়ছে। দেখা গেল, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, একখানে জড় হতে পারছে না, তীব্র বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইতিউতি।
কেবিনের পাশের খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দূরে হাত তুলে দেখাল রবিন, ওই দেখো, ওটা কি?
আলো! হোলোর অন্যপ্রান্তের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু কিসের আলো?
ডোবারের কেবিনটার ওপর থেকে আসছে না?
সে-রকমই লাগছে, কিশোর বলল। কিছু একটা ঘটছে ওখানে।
চলো, আগে পটিকে বাড়ি দিয়ে আসি। তারপর দেখতে যাব। সব কিছুর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব আজ 1 রহস্যের মধ্যে এ ভাবে লটকে থাকতে ভাল লাগছে না আর।
পথ বেয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে গাড়িতে উঠল ওরা। মিসেস ভারগনের বাড়ির সামনে এসে থামল। সব ঘরে আলো জ্বলছে। গাড়ির শব্দ শুনে পাগলের মত ছুটে বেরোলেন মহিলা। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমাকে সাহায্য করো! পৃটিকে খুঁজে পাচ্ছি না! নিশ্চয় বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে! সেই ভয়ঙ্কর ডাক শুনলাম…
জানালা দিয়ে মুখ বের করে ডাকল পটি, মা, এই যে আমি!
হাঁ হয়ে গেল বিস্মিত মা।
দরজা খুলে দিতেই পটি নেমে গেল। ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে নিল মা। বুকে চেপে ধরে চুমু খেতে লাগল।
কুত্তা খুঁজতে বনে চলে গিয়েছিল সে, মুসা জানাল মিসেস ভারগনকে। ওকে তো পেয়েছিই, ওর কুত্তাটাকেও পেয়ে গেছি আমরা। দু-একদিনে মধ্যেই এনে দেব।
ব্ল্যাক হোলোতে পেয়েছ ওকে? এই অন্ধকারে ঝড়ের মধ্যে ওই ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে যাওয়ার মত দুঃসাহস করেছে তার ছেলে, এ কথা বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মহিলা।
হ্যাঁ, ওখানেই পেয়েছি।
কুত্তাটাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। আর থাকতে না পেরে আজ… ডাইনীর কথা ভেবেই বোধহয় থমকে গেল মহিলা। শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়নি তো তোর, পটি?
অভয় দিয়ে বলল কিশোর। না, কোন ক্ষতি হয়নি। নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিন। সকালে সব কথা ও-ই বলবে আপনাকে। ডাইনীটা আসলে কি, তা-ও জানাবে।
আবার এসে গাড়িতে চড়ল তিন গোয়েন্দা। এতটাই অবাক হয়েছে মিসেস ভারগন, ওদেরকে ধন্যবাদ জানানোর কথাও ভুলে গেল। ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইল গাড়িটার দিকে।
মূসাকে নির্দেশ দিল কিশোর, ডোবারের কেবিনটা যে পাশে আছে, ঘুরে ওখানটায় চলে যাও।
রাস্তা নেই, উঁচুনিচু জমির ওপর দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোল গাড়ি। খাদের একেবারে কিনার ঘেষে চলছে। ছোট ছোট ঝোপ মাড়িয়ে যাচ্ছে। নিচু ডাল বাড়ি লাগছে উইন্ডশীল্ডে। গতি, একেবারে কমিয়ে রেখেছে মুসা। শক্ত হাতে ধরেছে স্টিয়ারিং। সামান্য একটু এদিক ওদিক হলেই, স্টিয়ারিং ভুল। ঘোরালেই পড়বে গিয়ে খাদে।
হেডলাইটের আলো পড়ল আরেকটা গাড়ির ওপর। খাদের, একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে আছে, পুরানো একটা জেলপি। রবিন বলল, খারাপ হয়ে গেছে বোধহয়। ফেলে রেখে গেছে।
এগিয়েই চলল মুসা, রহস্যময় আলোটার সন্ধানে, খানিক আগে কেবিনের কাছে দাঁড়িয়ে যেটা দেখা গেছে।
আরও কিছুদূর এগোতেই মোটামুটি চওড়া খোলা একটুকরো জায়গায় ঢুকল গাড়ি। আরেকটু এগোলেই ডোবারের কেবিনের ওপর চলে যাবে, যেখানটায় আলো দেখেছে। থেমে গেল মুসা। কি করবে জিজ্ঞেস করল কিশোরকে।
আর এগিও না। এখানেই গাড়ি ঘুরিয়ে রেডি রাখো, কিশোর বলল। দরকার পড়লে যাতে এসেই দৌড় দিতে পারি। তখন হয়তো আর ঘোরানোর সময় থাকবে না।
বাতাসের বেগ বেড়েছে। যে কোন মুহূর্তে বনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঝড়। অনেক ডালপালা ছড়িয়ে আকাশের এমাথা ওমাথা চিরে দিয়ে গেল। বিদ্যুৎ-শিখা, সঙ্গে সঙ্গে কানফাটা শব্দে বাজ পড়ল। তারপর এত ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল, টর্চ জ্বালার আর প্রয়োজন হলো না।
সরু পথে চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল ওরা। কথা শোনা গেল, এই যে, ধরো তো এটা।
চট করে ঝোপের আড়ালে ঢুকে গেল গোয়েন্দারা। যেদিকে কথা শোনা গেছে তাকিয়ে রইল সেদিকে। আবার বিদ্যুৎ চমকালে দেখল, একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে লম্বা একটা বাক্স নামাচ্ছে দু-জন লোক। নামিয়ে নিয়ে ঢুকে পড়ল গাছপালার মধ্যে, হোলোর কিনারের দিকে।
কোথায় গেল? ফিসফিস করে বলল রবিন, ওদিকে তো জায়গা নেই। না জেনে এগোলে পড়ে যাবে নিচে।
উত্তেজিত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল গোয়েন্দারা, কিন্তু লোকগুলো ফিরল না।
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে কিশোর। অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব যেন মিলতে আরম্ভ করেছে। সমাধান হয়ে আসছে ধাঁধার। বলল, শোনো, পিচার দুটো পেচা একে কেন কেটে দিয়েছিল, বুঝে গেছি। ও বোঝাতে চেয়েছে, চিৎকারগুলো পাখিতে করেনি, করেছে মানুষে। এক ঢিলে দুই পাখি মারে কেউ। যারা ট্রাক নিয়ে আসে পেঁচার ডাক ডেকে তাদেরকে সঙ্কেতও দেয়, আবার আশপাশের মানুষকে হুঁশিয়ারও করে: খবরদার, এদিকে এসো না; এখানে ডাইনী আছে! সেটাকে আরও জোরদার করার জন্যে কুকুর চুরি করে। ভয় পেয়ে কেউ এদিকে না এলে নিরাপদে মাল খালাস করতে পারে ওরা।
কুকুরগুলোকে এনে কি করে তা-ও বুঝে ফেলেছি! রবিন বলল, নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেয় চোরাই মার্কেটে। পটিরটা বোধহয় তাড়াহুড়োয় বেচতে পারেনি, দিয়ে এসেছে ডরোথির কাছে।
তারমানে বেআইনী কিছু করছে ওরা এখানে? মুসার প্রশ্ন।
তাতে কোন সন্দেহ আছে কি? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
কি করছে?
আমার তো মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে এই এলাকায় যে শুরু হয়েছে, সেটা এদেরই কাজ। ডোবারও এতে জড়িত।
ঠিক, রবিন একমত হলো। সেটা কোনভাবে জেনে গিয়েছিলেন হয়তো ক্যাপ্টেন রিচটন, ওদেরকে মাল খালাস করতে দেখে ফেলেছিলেন, সে জন্যেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
মেরে ফেলেনি তো? শঙ্কিত হয়ে উঠল মুসা।
কতটা বেপরোয়া ওরা, সেটা এখনও জানি না, জবাব দিল কিশোর। তবে খুনের ঝুঁকি নেয়ার চেয়ে আটকে রাখাটাই নিরাপদ মনে করবে। কিন্তু কোথায় আটকাল? আরেকটা কথা মনে আছে, সেদিন ডোবারের সঙ্গে কথা বলার সময় দরজা লাগানোর শব্দ শুনেছিলাম, কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকে কোন দরজা দেখিনি?
আছে, জানাল দু-জনেই।
কোথায় সেই দরজাটা?
জবাব দিতে পারল না কেউ।
আমার বিশ্বাস, কিশোরই বলল, রান্নাঘরের মধ্যেই কোথাও আছে ওটা, লুকানো, গুপ্তদরজা।
আর কোন কথা হলো না। চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল তিনজনে। করতে করতে অস্থির হয়ে উঠল, কিন্তু ওরা আর আসে না।
দেখা দরকার কোথায় গেল, কিশোর বলল। তোমরা এসো আমার পেছনে। দূরে দূরে থাকবে। ধরা পড়লে যাতে একজন পড়ি, অন্য দুজন, পালাতে পারি।
ঝোপের আড়ালে আড়ালে পা টিপে টিপে এগোল সে। তার পেছনে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে রবিন, সবশেষে রইল মুসা।
লোকগুলোকে দেখা গেল না কোথাও। খাদের কিনারে গাছের সারির কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। একটু পর মুসা আর রবিনও চলে এল তার পাশে। খোলা জায়গায় না থেকে বসে পড়ল ঝোপের আড়ালে। নিচে উঁকি দিল।
তাদের সামনে কোন গাছপালা নেই, পাথরের দেয়ালটা প্রায় খাড়া হয়ে নেমে গেছে উপত্যকায়।
শাঁই শাঁই করে বইছে ঝোড়ো বাতাস। তাদের পেছনে সাংঘাতিক দুলছে গাছপালাগুলো। এই ঝোপের কাছেও বাতাসের শক্তি অনুভব করতে পারছে ছেলেরা। বিদ্যুতের আলোয় ব্ল্যাক হোলোর অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ডোবারের কেবিনটাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু লোকগুলোকে চোখে পড়ল। অবাক কাণ্ড! গেল কোথায় ওরা?
ওপরেও নেই, নিচেও নেই, বিড়বিড় করল রবিন, তাহলে গেল কোথায়? আর নিচেই যদি গিয়ে থাকে, নামল কোনখান দিয়ে? যা দেয়ালের দেয়াল, নিচে নামাই মুশকিল, সঙ্গে আছে আবার ভারী বাক্স!
ওরা যেখানে রয়েছে তার ঠিক নিচে নয় কেবিনটা, ওটার ওপরে যেতে হলে একপাশে আরও খানিকটা সরতে হবে। ওখানটায় গেলে লোকগুলোকে দেখা যেতে পারে ভেবে উঠে দাঁড়াল কিশোর। পেছনে আগের মত দূরত্ব রেখে আসতে বলল রবিন আর মুসাকে।
খাদের কিনার ধরে এগোল তিনজনে, একজনের পেছনে আরেকজন।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল কিশোর। বিদ্যুৎ চমকাল এই সময়। অবাক হয়ে রবিন আর মুসা দেখল, খানিক আগেও যেখানে ছিল গোয়েন্দাপ্রধান, সেখানে নেই সে, অদৃশ্য হয়ে গেছে!
.
কিশোর কিশোর! বলে চিৎকার দিয়ে দৌড় মারল রবিন। মুসা ছুটল তার পেছনে। কিশোর, কোথায় তুমি?
সাড়া নেই। বিদ্যুৎ চমকাল বড় করে, দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সবকিছু আলোকিত করে রেখে দপ করে নিভে গেল। আশপাশটা পরিষ্কার চোখে পড়ল ওদের। এবারও দেখা গেল না কিশোরকে। ওই লোকগুলোর মতই সে-ও গায়েব হয়ে গেছে।
গেল কোথায় ও! ককিয়ে উঠল রবিন। তার কথা ঢেকে দিল প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দ।
আবার চমকাল বিদ্যুৎ। আকাশটাকে যেন ফেড়ে ফেলে তার ভেতরটা দেখিয়ে দিতে চাইল। মনে হলো, এতক্ষণ মেঘগুলোকে ধরে রেখেছিল যে চাদরটা, সেটাকেও চিরে দিল বিদ্যুৎ। অঝোরে নেমে এল বৃষ্টি। গাছপালার মাথায়, পাথরের গায়ে আঘাত হানার শব্দ উঠল ঝমঝম, ঝমঝম।
কিন্তু বৃষ্টি শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে আরেকটা শব্দ ঢুকল মুসার তীক্ষ্ণ শ্রবণযন্ত্রে, মনে হলো তার পায়ের নিচ থেকে এসেছে।
চিৎকার না? ওদিকে! চেঁচিয়ে উঠে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে একটা বড় ঝোপের দিকে দৌড় দিল সে। আরেকটু হলে সে-ও পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিদ্যুতের আলোয় দেখল সামনে মাটিতে গোল একটা কিছু, ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল সে।
টর্চের আলো ফেলল দুজনে। মাটিতে একটা গর্ত। ঝোপটার আড়ালে থাকায় দূর থেকে চোখে পড়ে না। উঁকি দিয়ে দেখল, একধার থেকে একটা কাঠের স্লাইড নেমে গেছে। আরেকধার থেকে উঠেছে একটা কাঠের সিঁড়ি।
নিচ থেকে ওদের নাম ধরে ডাকছে কিশোর।
তাড়াতাড়ি নামার জন্যে সাবধানে সাইডের ওপর বসে দুহাতে দু-ধার খামচে ধরল মুসা। পার্কের স্লিপারে বসলে যেমন হয়, তেমনি সড়াৎ করে নেমে চলে এল নিচে। তার পেছনে বসেছিল রবিন, সে এসে পড়ল তার গায়ের ওপর।
মাটিতে পড়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল দু-জনে।
অন্ধকারে কিশোরের গলা শোনা গেল, টর্চ জ্বালো! আমারটা হারিয়ে ফেলেছি!
হলুদ আলো পড়ল পাথরের দেয়ালে। একটা কুয়ার মধ্যে রয়েছে ওরা। সুড়ঙ্গমূর্খ দেখা গেল।
নিশ্চয় এটা চোরের আড্ডা, নিচু স্বরে বলল রবিন। ওই কাঠের সাইডে মালগুলো রাখে, পিছলে নেমে আসে ওগুলো কুয়ার নিচে। পরে অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেটাই দেখতে হবে, কিশোর বলল।
সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল ওরা। সাবধানে এগোল। কিছুদূর এগোতে সামনে দেখা গেল একটা কাঠের দরজা।
খুলব? রবিনের প্রশ্ন।
না খুললে দেখব কি করে?
এগিয়ে গিয়ে ঠেলা দিল কিশোর। ভেতরের দিকে খুলে গেল পাল্লাটা।
ওপাশে তাকিয়েই থ হয়ে গেল ওরা। পাথর কুঁদে তৈরি চারকোনা একটা ঘর, একটা প্যারাফিনের ল্যাম্প জ্বলছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা একজন মানুষ। পড়ে আছে একটা ক্যাম্পখাটে। এলোমেলো ধূসর চুল। শব্দ শুনে দুর্বল ভঙ্গিতে মুখটা ঘুরল এদিকে।
ক্যাপ্টেন রিচটন? ছুটে গেল রবিন।
কে তোমরা? দুর্বল কণ্ঠস্বর মানুষটার।
জানাল কিশোর, আমরা গোয়েন্দা। মিস্টার সাইমন আপনার চিঠি পেয়েছেন।
আশার আলো ঝিলিক দিল রিচটনের চোখে, সে কোথায়? মাথা তুললেন তিনি।
তিনি জরুরী কাজে ব্যস্ত। সেজন্যেই আমাদের পাঠিয়েছেন।
আলো নিভে গেল আবার চোখ থেকে। গড়িয়ে পড়ে গেল মাথাটা। একজন দক্ষ গোয়েন্দার পরিবর্তে তিনটে ছেলেকে দেখে নিরাশ হয়েছেন রিচটন, সেটা বুঝে কিশোর বলল, কদিন ধরেই এখানে আপনাকে খোঁজাখুঁজি করছি, ক্যাপ্টেন। আজকে পেলাম। এখন সাবধান থাকতে হবে আমাদের, নইলে বিপদে পড়ব। ডোবার আর তার চ্যালারা কোথায় আছে, এখনও জানি না।
আমি জানি ওরা কোথায়, কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসলেন ক্যাপ্টেন। পাথরের কেবিনটাতে। এই ঘর থেকেও যাওয়া যায়, ওই দরজা দিয়ে। কিশোররা যেদিক দিয়ে ঢুকেছে তার উল্টো দিকের আরেকটা দরজা দেখালেন তিনি।
তার শার্টের ছেঁড়া জায়গাগুলো চোখ এড়াল না কিশোরের। ঝোপের কাটায় আটকে থাকা কাপড়ের টুকরোগুলো এটা থেকেই ছিঁড়েছে, বুঝতে পারল।
তোমরা একা কিছু করতে পারবে না, গিয়ে শেরিফকে জানাও, পুলিশ নিয়ে এসো। ওরা ডাকাত, ভয়ঙ্কর লোক। দলটা লুটপাট করে বেড়ায় বাইরে বাইরে, মাল এনে লুকিয়ে রাখে এখানে। ডোবার ওদের নেতা, উকিল হুগারটাও আছে তার দলে। তোমাদেরকে এখানে দেখে ফেললে বিপদ হবে।
চলুন আপনাকে বের করে নিয়ে যাবে, মুসা বলল। কুয়াটাতে একটা সিঁড়ি আছে। সেটা বেয়ে ওপরে ওঠা যাবে। ওই পথেই ঢুকেছি আমরা, পালাতেও পারব। ওরা কিছু জানবেই না।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, কিন্তু ওরা যখন দেখবে, ক্যাপ্টেন নেই, বুঝবে খেল খতম। গা ঢাকা দেবে। ধরতে আর পারব না।
তুমি ঠিকই বলেছ, একমত হলেন ক্যাপ্টেন। তার চেয়ে যা বললাম, তাই করো, গিয়ে পুলিশ নিয়ে এসো…
বরং এক কাজ করো, রবিনকে বলল কিশোর। তুমি চলে যাও। শেরিফকে খবর দাও। আমি আর মুসা থাকছি এখানে।
কি ভেবে তর্ক করল না রবিন, বেরিয়ে গেল।
কিশোর আর মুসাকেও যাওয়ার জন্যে চাপাচাপি করে করে হাল ছেড়ে দিলেন ক্যাপ্টেন, যাবে না ওরা। শেষে কিশোরের প্রশ্নের জবাবে তার কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন, চিৎকারটা প্রথম যখন শুরু হলো, বিশেষ মাথা ঘামালাম না আমি। তারপর কুকুর হারাতে লাগল। মনে পড়ল ডাইনীর কিংবদন্তীর কথা। ক্যালেন্ডারে লিখে রাখতে লাগলাম ডাক কবে শোনা যায়, আর কুকুর কবে হারায়। কোনটা কি কুকুর, মালিক কে, তা-ও লিখলাম, পরে যাতে ভুলে না যাই সে-জন্যে। দুটো ঘটনার মধ্যে একটা যোগাযোগ লক্ষ করলাম। সেজন্যেই ভিকটরকে চিঠি লিখেছিলাম, জানি, এ সব উদ্ভট রহস্যগুলোতে কাজ করে আনন্দ পায় সে। শেরিফকে গিয়ে বলতে পারতাম, কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত একজন পুলিশ অফিসার এ সব গুজবে বিশ্বাস করে তদন্তের সাহায্য চাইতে গেছি দেখলে মনে মনে হাসত সে। ভাবত, বুড়োটার মাথায় দোষ পড়ে গেছে।
আপনি কি ডাইনী বিশ্বাস করেন? ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল মুসা।
না। তবে ব্যাপারটা বেশ দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল। তলে তলে সিরিয়াস কিছু একটা ঘটছে বুঝতে সময় লাগল। হাইজ্যাকারদের কথা আগেই শুনেছি, সন্দেহ করলাম, ওরাও এসে আস্তানা গেড়ে থাকতে পারে এখানে। তারপর একরাতে আমার ককার স্প্যানিয়েল কুকুরটাও চুরি হয়ে গেল। আর কারও অপেক্ষা না করে নিজেই তদন্ত করব ঠিক করলাম।
মাথা ঝাঁকাল কিপোর। এবং সেদিন বেরিয়েই ধরাটা পড়লেন।
হ্যাঁ, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন। সঙ্গে বন্দুক নিয়েছিলাম। হোলোতে নেমে খুঁজতে শুরু করলাম। ঝোপের মধ্যে একটা রহস্যজনক শব্দ শুনে এগিয়ে গেলাম সেদিকে, ভেতরে কে জিজ্ঞেস করলাম? জবাব পেলাম না। তারপর দেখি দুটো জ্বলন্ত চোখ, পরক্ষণেই ভয়ঙ্কর এক চিৎকার। একটা পুমা। এখানে ওই জানোয়ার দেখে খুব চমকে গিয়েছিলাম, কখনও শোনা যায়নি এই এলাকায় পুমা আছে। গুলি করতে দেরি করে ফেললাম। আমি নিশানা করার আগেই লাফ দিল ওটা। দুটো গুলির একটাও লাগাতে পারলাম। আমাকে ধরার জন্যেই লাফ দিয়েছিল, কিন্তু গুলির শব্দে ভয় পেয়ে পালাল। মনে হলো, পুরোপুরি বুনো নয়। তা ছাড়া কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।
গুলির খোসাগুলো পেয়েছি আমরা, মুসা বলল।
গুলির শব্দ শুনে চুপি চুপি দেখতে এল ডোবার। পেছন থেকে মাথায় বাড়ি মেরে বেহুশ করে ফেলল আমাকে। জ্ঞান ফিরলে দেখি, ডোবারের কেবিনটাতে শুয়ে আছি। রান্নাঘরের দেয়ালে পাথরের একটা গোপন দরজা খুলছে সে। আগে থেকে জানা না থাকলে দরজাটা আছে ওখানে বোঝাই যায় না।
বেহুঁশের ভান করে পড়ে রইলাম। আমাকে হিঁচড়ে হিঁচড়ে একটা গলি পার করে আনল সে, তারপর একটা ঘর–একধারে অনেকখানি জায়গায় শিক লাগিয়ে আলাদা করা, হাজতের মত; এবং সবশেষে নিচু একটা দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে এনে ফেলল এই ঘরটায়। তারপর থেকেই আছি। একটাই ভরসা ছিল আমার, ভিকটরকে চিঠি লিখেছি, সে আসবেই। কেবিনে আমাকে না পেলে খুঁজে বের করবে।
অথচ তিনি কল্পনাও করেননি আপনি এই বিপদের মধ্যে আছেন,. কিশোর বলল। তাহলে সব কাজ বাদ দিয়ে নিজেই ছুটে আসতেন।
ওরা এসে কি কি করেছে রিচটনকে বলতে লাগল সে। হুগারফ তার। কাছে টাকা পায় বলেছে শুনে রেগে উঠলেন ক্যাপ্টেন, মিথ্যে কথা! আমার কাছে কেউ টাকা পায় না। ওই বাহানা করে ও তোমাদের খোঁজ নিতে। গিয়েছিল। ওর মত একটা চোরের কাছে টাকা নিতে যাব কেন আমি?
হে আমরাও বিশ্বাস করিনি একথা। বরং বলে তার ওপর আমাদের সন্দেহ জাগিয়েছে।
পেঁচার ডাকটা যে আসলে পেঁচার নয়, মানুষই ওরকম করে ডেকে সঙ্কেত দেয়, তার এই সন্দেহের কথা জানাল কিশোর।
ঠিকই অনুমান করেছ তুমি। দুই রকম পেঁচার ডাক ডাকে সে। একভাবে ডেকে হাইজ্যাকারদের বোঝায়, রাস্তা পরিষ্কার, চলে এসো। আরেক ভাবে ডেকে বলে, বিপদ, চলে যাও। এই দ্বিতীয় ডাকটা শুরু করেছে। তোমরা আসার পর।
তারমানে আমাদের ভয় পায় সে? মুসার প্রশ্ন।
হ্যাঁ, পাই, দরজার কাছ থেকে বলে উঠল একটা পরিচিত, ভারী কণ্ঠ।
ঝট করে ঘুরে তাকাল দুই গোয়েন্দা। হাতে লম্বা নলওয়ালা সেই পিস্তলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডোবার। নিঃশব্দে দরজা খুলে কখন ঢুকে পড়েছে টেরই পায়নি কেউ। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দু-জন লোক, একজনকে চেনে গোয়েন্দারা–উকিল আর্নি হুগার। আরেকজনের বিশাল দেহ, রুক্ষ চেহারা।
স্বাগতম, রসিকতার ঢঙে বলল ডোবার, সুন্দরভাবে সমাধান করে ফেলেছ কেসটার। এমনকি পেঁচার ডাকের রহস্য ভেদ করে ফেলেছ, ভাল গোয়েন্দা তোমরা, বুদ্ধি আছে। ডাকগুলো আমিই ডেকেছি, একেবারে আসলের মত হয়েছিল, তাই না? কিন্তু বুদ্ধিটা খারাপ জায়গায় খাঁটিয়েছ, এর জন্যে খেসারত দিতে হবে তোমাদের। কিংবা পুরস্কারও বলতে পারো, জ্যান্ত ডাইনীর সাক্ষাৎ পাবে। তো, তোমাদের আরেক বন্ধু কোথায়?
চুপ করে রইল মুসা আর রবিন।
হুঁ, এরা বলবে না। হঠাৎ বদলে গেল তার কণ্ঠস্বর, হাসি হাসি ভাবটা চলে গিয়ে কঠিন হয়ে উঠল চেহারা। কর্কশ কণ্ঠে বিশালদেহী লোকটাকে বলল, ফেরেল, নিশ্চয় বাইরে কোথাও আছে। ধরে নিয়ে এসো। ও পালালে মুশকিল হয়ে যাবে আমাদের।
মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল ফেরেল।
হুগারফ রইল রিচটনের পাহারায়, আর পিস্তলের মুখে দুই গোয়েন্দাকে নিয়ে চলল ডোবার।, একটা গলিপথ পেরিয়ে আরেকটা ঘরে এসে ঢুকল, যেটাতে হাজতের দরজার মত শিক লাগানো আছে বলেছিলেন রিটন।
ডোবারের টর্চের আলোয় পাথরের ঘরটা দেখতে পাচ্ছে দুই গোয়েন্দা। পেছনের দেয়ালের কাছটায় তেরপল দিয়ে ঢাকা রয়েছে কিছু। বাতাস ভারী আর ভেজা ভেজা এখানে মাটির নিচের ঘর বলেই বোধহয়; কিন্তু তার সঙ্গে মিশে আছে কেমন একটা বোঁটকা গন্ধ!
কোয়ার্টার পছন্দ হয়েছে? হেসে ছেলেদের জিজ্ঞেস করল ডোবার। প্রাকৃতিক গুহাই ছিল এগুলো, খুড়ে খুঁড়ে বড় করেছে ক্রীতদাসপ্রথার। বিরোধিতা করেছিল যারা, তারা। এখানে এসে লুকিয়েছিল। খুব চালাক ছিল ওরা স্বীকার করতেই হবে। কুত্তা চুরি আর রাতে বিকৃত চিৎকার করে করে : ডাইনীর কিংবদন্তীটাকে জাগিয়ে তুলেছিল ওরা, লোকে ভয় পেয়ে আর হোলোর কাছে ঘেঁষত না। ক্রীতদাসদের লুকিয়ে থাকার সুবিধে হত। ইতিহাসের সেই অধ্যায়টাকেই আবার কাজে লাগিয়েছি আমি এত বছর পর, প্রশংসা করবে না?
করতাম, যদি ওদের মত সৎ উদ্দেশ্য থাকত আপনার, কিশোর বলল। কিন্তু আপনি তো করছেন অপরাধ, হাইজ্যাকিঙের মত জঘন্য অপরাধ। ভাল কথা, ভব কোথায় আছে জেনে গেছি আমরা।
মুহূর্তের জন্যে বিস্ময় দেখা দিল ডোবারের চোখে, তারপর সামলে নিল, কি বলছ বুঝতে পারছি না।
বন্য মানুষের মুখোশ পরে আমাদের ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারটাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন না?
না, তা পারছি, হাসিমুখে স্বীকার করল ডোবার। আমিই পিচার সেজেছিলাম, রবারের মুখোশ আর কালো পরচুলা পরে। এ মহাপুরুষের কাজ করেছেন, ডোবারের এই হাসি হাসি ভাবটা সহ্য করতে না পেরে রেগে উঠল মুসা। আমাদের নিয়ে এখন কি করবেন, সেটা শুনতে চাই।
ডোবার বুঝতে পারল অসাধারণ স্নায়ুর জোর এই ছেলেগুলোর, এত সহজে ভয় ধরাতে পারবে না ওদের মনে। কঠিন পথটাই বেছে নিল সে। এগিয়ে গেল তেরপলে ঢাকা জায়গাটার দিকে।
ডাইনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হোক এবার! নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাটা বলে একটানে তেরপল সরিয়ে নিল। বেরিয়ে পড়ল একটা লোহার খাঁচা। ভেতরে শক্তিশালী একটা জানোয়ার। ম্লান আলোতে ঝিক করে উঠল ওটার সবুজ চোখ।
ডাইনীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিৎকারগুলোর জন্যে এটাকে দায়ী করতে পারো, ডোবার বলল। যখন শুনলাম আমার ভাই নুবার একটা পুমাকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে না পেরে বিক্রি করে দিতে চায়, টরিকে পাঠালাম–ওটা কিনে নিয়ে আসতে। তবে আমি যে কিনছি জানতে দিলাম না নুবারকে। ভাবলাম, জানোয়ারটা পেলে অনেক কাজে লাগাতে পারব। আমার আন্দাজ ভুল হয়নি।
আধমরা ভেড়া কেন কিনেছিল ডোবার, এখন নিশ্চিত হলো গোয়েন্দারা। পুমাকে খাওয়ানোর জন্যেই।
মুসা বলল, আপনার ভাইই যে জানোয়ারকে কন্ট্রোল করতে পারেনি, সেটাকে আপনি করছেন কি করে?
মিটিমিটি হাসছে ডোবার। জন্তু-জানোয়ারকে কন্ট্রোল করার একটাই উপায়, পিটুনি দেয়া, নিষ্ঠুর ভাবে পেটাতে হবে। পুমাটা এখন বুঝে গেছে কে তার মনিব। আমার সঙ্গে তো কই গোলমাল করে না, ভয় পায়।
আজ রাতে ওটাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাই না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হ্যাঁ। খাঁচার পেছনে ওই দরজাটা দেখছ না, ওটা খুলে দিই, বেরিয়ে যায়। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ আছে, ও পথে বেরোয়। তবে বেরোতে দেয়ার আগে ঘুমের বড়ি মেশানো খাবার খাইয়ে দিই, যাতে বেশি গোলমাল না করে। পালানোর বুদ্ধি না হয়। প্রতিবারেই ফিরে এসেছে ওটা।
তবে আজ রাতে ডোজ বোধহয় কম হয়ে গিয়েছিল, কিংবা অন্য কোন কারণে তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে ওষুধের ক্ষমতা, ফলে খেপে উঠেছিল। সে জন্যেই পর পর দুবার পেঁচার ডাক ডাকতে হয়েছিল, সব ঠিক আছে জানানোর পর পরই জানাতে হয়েছিল আমার লোকদের, ঠিক নেই, সাবধান হও। তবে ভাগ্য ভাল, কারও কোন ক্ষতি না করেই খাঁচায় ফিরেছে পুমাটা। হয়তো তার সামনে পড়েনি কেউ। পড়লে ছাড়ত বলে মনে হয় না।
ছাড়েন কেন? মূসার প্রশ্ন।
কে ওটার গু সাফ করবে? বাইরেই সেরে আসতে পাঠাই। আরেকটা কারণ আছে, যেদিন আমাদের কাজ থাকে সেদিন পাহারা দেয়ার কাজটাও অনেকটা ওকে দিয়ে করাই। ব্ল্যাক হোলোতে অচেনা কেউ ঢুকলে ঠেকাবে। ও বাইরে বেরোলে আরও একটা উদ্দেশ্য সফল হয় আমাদের, ওই যে বললাম, ডাইনী। চিৎকার করে। ওর ভয়াবহ ডাক শুনে লোকে ভাবে ডাইনীর। চিৎকার। ভয়ে আর এ পথ মাড়ায় না কেউ। সাধারণ একটা পুমার কাছে আর। কত কাজ চাও?
আজকে অবশ্য নতুন একটা কাজ করাব ওকে দিয়ে। রহস্যময় কণ্ঠে বলল ডোবার। খাঁচার এদিকেও একটা দরজা আছে, শেকল টেনে তুলে। নেয়া যায়। পালাতে যদি চাও, মুচকি হেসে আবার চোখ টিপল সে, সহজ একটা পথ বাতলে দিতে পারি। এদিককার দরজাটা তুলে ফেলবে, তারপর ওদিকেরটা, আর কোন বাধা থাকবে না, পুমাটাকে ডিঙিয়ে কেবল ওপাশের সুড়ঙ্গে গিয়ে ঢুকবে। ব্যস, বেরিয়ে যেতে পারবে।
ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজা লাগাল সে। বাইরে থেকে ভারি খিল তুলে দিল। চেঁচিয়ে বলল, ও, নতুন কাজটা কি, বলতে ভুলে গেছি। আরও একটা শেকল আছে আমার এখানে। এটা টেনেও খাঁচার তোমাদের দিকের দরজাটা ভোলা যায়। ভাবছি, আজই রাতে কোন একসময় সেটা তুলে নেব। গুডবাই।
টর্চ নিয়ে গেছে ডোবার। ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে। তবে নিজের টর্চটা শার্টের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছিল মুসা, সেটা বের করে নিয়ে আলো জ্বালল। পরীক্ষা করে দেখতে লাগল তাদের বন্দিশালাটা।
নাহ, কোন পথ নেই, দেখেটেখে নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। আমাদের একমাত্র ভরসা এখন রবিন। নিরাপদে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশ নিয়ে যদি ফিরে আসতে পারে!
অহেতুক ব্যাটারি নষ্ট না করে আলোটা নিভিয়ে দিল মুসা। গভীর অন্ধকারে ঢেকে গেল ঘর। মাত্র কয়েক ফুট দূরে খাঁচার মধ্যে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে পুমাটা।
অনেকক্ষণ পর বাইরের করিডরে কথা শোনা গেল। ডোবার বলছে, ছেলেটাকে পেলে না?
না, বস, জবাব দিল ফেরেলের খসখসে কণ্ঠ। কুয়ার বাইরে বেরিয়েই শুনলাম গাড়ির শব্দ। লাল কনভারটিবলটা চলে যাচ্ছে। বুঝলাম, কোন কারণে ছেলেটা পালাচ্ছে। ট্রাক নিয়ে পিছু নিলাম। কিন্তু সাংঘাতিক গাড়ি ওর, চালায়ও ভাল, কাছেই যেতে দিল না আমাকে…
আর তুমিও পরাজিত হয়ে ফিরে এলে, গর্দভ! গর্জে উঠল ডোবার। জানো, এখন আমাদের কি হবে…
কিছুই হবে না, বস, ও আর কিছু করতে পারবে না আমাদের হাসি শোনা গেল বিশালদেহী লোকটার। আমিও যতটা সম্ভব গতি বাড়ালাম। এত্তবড় ট্রাক নিয়ে কি আর ওই গাছপালার মধ্যে জোরে চলা যায়, বলুন? তবে। থামলাম না। মোড় নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল গাড়িটা। একটু পরেই শুনলাম সাংঘাতিক শব্দ। গিয়ে দেখি, নিচে পড়ে আগুন ধরে গেছে গাড়িতে। ওই গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাচবে ও? অসম্ভব!
গুড! শান্ত হয়ে এল ডোবার। একটা ঝামেলা নিজে নিজেই কমল!
অন্ধকারে যেন বরফের মত জমে গেছে কিশোর আর মুসা, অবশ হয়ে আসতে চাইছে হাত-পা।
.
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কথা ফুটল না ওদের মুখে। তারপর বিড়বিড় করল মুসা, এ হতে পারে না, কিশোর! এটাস্পত্যি হতে পারে না!
গল্পটা আমিও বিশ্বাস করতে পারছি না, গলা কাঁপছে কিশোরের। বেরোতেই হবে আমাদের, যে ভাবেই হোক, সত্যিটা জানতে হবে!
বেরোনোর একমাত্র পথ, খাঁচার দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।
শিকের কাছে এসে মাথা ঠেকিয়ে ভয়ঙ্কর সুরে গরগর করে উঠল পুমাটা।
মোজা, শার্ট, বেল্ট, সোয়েটার সব খুলে ফেলল, কিশোর বলল। একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়।
মুহূর্তে সব খুলে খাঁচার সামনে স্তূপ করে ফেলল দুজনে।
একটা জিনিসকে সব জানোয়ারই ভয় করে, বিড়বিড় করল কিশোর। দুটো বেল্টকে এক করে পাকিয়ে নিল সে, তার ওপর জড়াল সোয়েটার আর শাট। মোজা দিয়ে পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধল, যাতে সহজে না খোলে কাপড়গুলো।
কি করছ? বুঝতে পারছে না মুসা।
জবাব না দিয়ে পকেট থেকে লাইটার বের করল কিশোর। বুঝে গেল মুসা, আগুন!
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আগুনকে ভয় পায় না এমন জানোয়ার নেই।
লাইটার জেলে কাপড়ে তৈরি বিচিত্র মশালটার মাথায় আগুন ধরল সে। আগুন দেখেই চাপা গর্জন করতে করতে খাঁচার দরজার কাছ থেকে সরে গেল পুমাটা। টর্চ নিভিয়ে দিল মুসা। কিন্তু অন্ধকার হলো না আর ঘরটা, মশালের আলোয় আলোকিত। বিহূত ছায়া নাচছে দেয়ালে।
কি ঘটে পরীক্ষা করে দেখার জন্যে মশালটা খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে। পূমাটাকে খোঁচা মারার ভঙ্গি করল কিশোর। গর্জে উঠে একলাফে সরে গেল ওটা। মুচকি হাসল সে। বুঝল কাজ হবে। মুসাকে বলল, শেকল টেনে আস্তে আস্তে দরজাটা তোলে।
লোহায় লোহায় ঘষা লাগার শব্দ তুলে উঠে যেতে শুরু করল দরজাটা। সামনে মশাল বাড়িয়ে ধরে ঢুকে গেল কিশোর। এগোল পুমাটার দিকে। ভয়ে, রাগে হিসিয়ে উঠে খাঁচার দেয়ালে নিজেকে ঠেসে ধরল ওটা। বিশাল থাবা বাড়িয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করতে চেয়েও আবার পিছিয়ে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে ওটাকে পেছনের দরজাটার কাছে নিয়ে গেল কিশোর। জানোয়ারটার ওপর থেকে মুহূর্তের জন্যে চোখ না সরিয়ে মুসাকে বলল, এই দরজাটাও তোলো।..
সবে অর্ধেক উঠেছে দরজাটা, এই সময় চিৎকার শোনা গেল পেছনে। পুমার চিৎকার আর শেকলের শব্দ কানে গেছে ডোবারের, দেখতে এসেছে কি হয়েছে। চেপে ধরল মুসাকে।
পেছনে তাকাল না কিশোর, ঝটকা দিয়ে মশালটা বাড়িয়ে দিল পুমার দিকে। গর্জন করে পিছিয়ে গেল ওটা, খোলা দরজা দিয়ে চলে গেল সুড়ঙ্গমুখে। আগুনের ভয় ক্ষুব্ধ করে তুলেছে ওটাকে। সাহস সঞ্চয় করে থাবা তুলল কিশোরকে মারার জন্যে।
মরিয়া হয়ে ওটার হাঁ করা মুখে মশালটা ঠেসে ধরল কিশোর।
পুরোপুরি সাহস হারাল পুমাটা। আগুনের আঁচে ঝলসে গেছে মুখ। বিকট চিৎকার করে একলাফে ঘুরে দাঁড়িয়ে দিল দৌড়। হারিয়ে গেল সুড়ঙ্গের অন্ধকারে। মশাল হাতে কিশোরও ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গে। চেঁচিয়ে উঠে তার পিছু নিল ফেরেল।
বেশি লম্বা না সুড়ঙ্গটা। অল্পক্ষণেই বেরিয়ে চলে এল কিশোর। পুমাটাকে চোখে পড়ল না কোথাও। বনে ঢুকে পড়েছে।
কিশোরও ঢুকে পড়ল। হাতে যতক্ষণ আগুন আছে, জানোয়ারটাকে ভয় নেই। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখতে পারল না ওটা। পিস্তলের গুলি ফুটল টাশশ করে। কানের পাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট। মশালটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে ডাইভ দিয়ে গিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে পড়ল সে।
ছুটে আসছে পদশব্দ। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল সে। গাছের আড়ালে আড়ালে ছুটতে লাগল। আরেকবার গুলি হলো পেছনে। তার হাতখানেক তফাতে গাছের গায়ে বিধল বুলেট। গতি আরও বাড়িয়ে দিল সে। ছুটতে ছুটতে চলে এল পাথরের ঢালের কাছে। থমকে দাঁড়াল। মুহূর্ত পরেই তার পাশের দেয়াল থেকে চলটা তুলে দিয়ে বিইঙ করে চলে গেল বুলেট।
ঢাল বেয়ে উঠতে গেলে গুলি খাবে, খোলা জায়গায় তাকে মিস করবে না ফেরেল। আর কোন উপায় না দেখে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল কিশোর।
ভোর হয়ে আসছে। ধূসর আলোয় পা টিপে টিপে লোকটাকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। যে রকম বিশালদেহী, খালি হাতে এলেও তার সঙ্গে পারত না সে, তার ওপর হাতে রয়েছে পিস্তল। আত্মসমর্পণ না করলে গুলি খেতে হবে।
পাথরটার কাছে চলে এসেছে ফেরেল। হাত তুলে বেরিয়ে আসবে কিনা ভাবছে কিশোর, এই সময় উড়ে এল একটা পাথর। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ, এই অল্প আলোতেও একটু এদিক ওদিক হলো না, ঠিক এসে ফেরেলের হাতের পিস্তলে লাগল ওটা। হাত থেকে খসে পাথরে পড়ল পিস্তলটা, গড়িয়ে চলে গেল কয়েক হাত। পরমুহূর্তে ওপর থেকে উড়ে এল একটা দেহ, ফেরেলকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
পিচার! চিৎকার করে উঠল কিশোর। তুমি কোত্থেকে…
কিন্তু জবাব দিতে পারল না বোবা ছেলেটা। কিশোরের দিকে তাকানোরও সময় নেই। ধস্তাধস্তি শুরু করছে লোকটার সঙ্গে। বেশিক্ষণ যুঝতে পারবে না সে, বোঝাই যাচ্ছে। যা করার তা-ই করল কিশোর। তাড়াতাড়ি গিয়ে তুলে নিল ফেরেলের পিস্তলটা। অপেক্ষা করতে লাগল।
পিচারের বুকের ওপর উঠে এল ফেরেল। দু-হাতে গলা টিপে ধরে ছেলেটাকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারার চেষ্টা করল।
তার মাথার পেছনে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে ধমকে উঠল কিশোর, খবরদার!
ফিরে তাকাল ফেরেল। থামল না। কিশোর যে গুলি করবে না এটা বুঝে হাত বাড়াল ধরার জন্যে। যা থাকে কপালে ভেবে পিস্তনটা তুলে গায়ের জোরে লোকটার চাদিতে বসিয়ে দিল কিশোর।
টুঁ শব্দ করল না ফেরেল। আস্তে ঢলে পড়ে গেল পিচারের গায়ের ওপর।
ঠিক এই সময় দুপদাপ করে একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকাল কিশোর। অবাক হয়ে দেখল, পড়িমরি করে দৌড় দিয়েছে ডোবার, ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় পালাচ্ছে। দেয়ালের কাছে পৌঁছেও থামল না, বেয়ে উঠতে শুরু করল।
কেন পালাচ্ছে বুঝতে পারল না কিশোর। বোঝার চেষ্টাও করল না, চেঁচিয়ে বলল, পিচার, জলদি ওটাকেও পালাতে দেয়া যাবে না! বলে সে ও পিছু নিল ডোবারের।
হরিণের গতিতে কিশোরের পাশ কাটাল পিচার। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল।
কিশোরও বসে রইল না, তবে পিচারের তুলনায় তার ওঠাটাকে শামুকের গতিই বলা চলে।
একটা শৈলশিরায় পৌঁছে পেছন ফিরে তাকাল ডোবার। দেখল, বোবা ছেলেটাও পৌঁছে গেছে। তাকে ঘুসি মারার জন্যে হাত তুলল সে।
একসঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল! ডোবারের পা সই করে ডাইভ দিল পিচার। তাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল চ্যাপ্টা পাথরের ওপর। অনেক ওপরে। শোনা গেল একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার। পরক্ষণেই উড়ে এল দুশো পাউন্ড ওজনের। একটা ভারী শরীর। ডোবার আর পিচারের ওপর দিয়ে পার হয়ে গেল, পড়ল গিয়ে কয়েক গজ নিচের পাথরে। উঠে দাঁড়ানোর সাধ্য হলো না আর পুটার, গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচে। ডোবারকে সই করেই ঝাঁপ দিয়েছিল ওটা। ওই মুহূর্তে পিচার তাকে ফেলে না দিলে এতক্ষণে শেষ হয়ে যেত আরিগনদের বংশধর।
ঘটনাটা স্তব্ধ করে দিল ডোবারকে। উঠে বসল কোনমতে, থরথর করে কাঁপছে। পালানোর চেষ্টা করল না আর, ক্ষমতাই নেই যেন শরীরের।
শৈলশিরায় পৌঁছে গেল কিশোর। পিস্তল তাক করল ডোবারের দিকে। কিন্তু তার দিকে নজর নেই লোকটার, তাকিয়ে আছে নিচের দিকে। পরাজিত ভঙ্গি।
এতক্ষণে হই-হট্টগোল খেয়াল করল কিশোর। ফর্সা হয়ে গেছে পুবের আকাশ। নিচে তাকিয়ে দেখল সে, অনেক পুলিশ। জাল দিয়ে আটকে ফেলেছে পুমাটাকে।
ঢাল বেয়ে উঠে আসতে লাগল কয়েকজন পুলিশ। প্রথম যে লোকটা কাছে এল তাকেই জিজ্ঞেস করল কিশোর, রবিন ঠিক আছে? আমার বন্ধু?
আছে, জবাব দিল লোকটা।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর, গাড়িতে পুড়ে মরেনি তাহলে!
অবাক হলো পুলিশম্যান, কিসের গাড়ি!
জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না কিশোর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। নিচে নেমে দৌড় দিল ডোবারের কেবিনের দিকে।
হাঁ হয়ে খুলে আছে একমাত্র দরজাটা। একছুটে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। থমকে দাঁড়াল।
রান্নাঘরের গোপন পাথরের দরজাটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুসা, ওটা এখন খোলা। চেয়ারে বসে আছে রবিন, রিচইন আর শেরিফ ইকার।
শব্দ শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন শেরিফ। হেসে বললেন, এসো কিশোর। তোমাদের পাত্তা না দিয়ে, ডোবারের কথায় গুরুত্ব দিয়ে ভুল করেছিলাম, সরি। যাই হোক, কেসটার কিনারা করার জন্যে অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ।
হাঁটু ভেঙে এল যেন কিশোরের। সমস্ত উত্তেজনা শেষ হয়ে যেতে এতক্ষণে টের পেল ক্লান্তি। ধপ করে বসে পড়ল একটা চেয়ারে।
পুরো আধমিনিট কথা বলল না সে, জিরিয়ে নিয়ে মুখ তুলে তাকাল রবিনের দিকে, এত তাড়াতাড়ি পুলিশকে খবর দিলে কি করে?
হাসল রবিন, তারপর খুলে বলল সব, বেরিয়েই গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, মিসেস ভারগনের বাড়িতে টেলিফোনের তার দেখেছি। ফরেস্টবার্গে যেতে-আসতে অনেক সময় লাগবে। তাই ভাবলাম শেরিফকে একটা ফোন যদি করতে পারি অনেক সময় বাচবে।
হঠাৎ পেছনে শুনলাম চিৎকার। তারপর ট্রাকের ইঞ্জিন চালু হলো। আসতে লাগল আমার পেছন পেছন। কেন আসছে বুঝতে পারলাম। নিশ্চয় আমাকে দেখে ফেলেছে, ধরতে আসছে। ট্রাকে কয়জন আছে জানি না। আমাকে ধরার জন্যে বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালাবে ওরা। রাস্তা যতক্ষণ খারাপ থাকবে ততক্ষণ ধরতে পারবে না জানি, কিন্তু তারপর? ওরা পিছে লেগে থাকলে পুলিশকে খবর দিতে পারব না। কি করি, কি করি, ভাবছি, এই সময় চোখে পড়ল পুরানো গাড়িটা। দেখেই একটা বুদ্ধি এল মাথায়, সিনেমায় দেখা একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ল কি করে তেড়ে আসা ডাকাতদের ফাঁকি দিয়েছিল একজন লোক।
তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে গাড়িটা ঢুকিয়ে রাখলাম একটা ঝোপে। দৌড়ে ফিরে এসে পুরানো গাড়িটায় আগুন ধরিয়ে ঠেলে ফেলে দিলাম পাড়ের ওপর থেকে। পেট্রোল ছিল ওটার ট্যাঙ্কে। দাউ দাউ করে যে ভাবে জ্বলে। উঠল, ওটার মধ্যে নিজেকে কল্পনা করে শিউরে উঠলাম। রাস্তাটা ঘোরাল আর গাছপালা ছিল বলে আমাকে এ সব করতে দেখতে পায়নি লোকটা, আসতেও দেরি হয়েছে তার। ঝোপে লুকিয়ে দেখলাম, গাড়ি থেকে নামল সে, আগুন লাগা গাড়িটা দেখল, তারপর ট্রাক নিয়ে ফিরে গেল। বুঝলাম, আমার ফাঁকি কাজে লেগেছে।
সে চলে গেলে আবার রওনা হলাম মিসেস ভারগনের বাড়িতে। খুশি। হয়েই ফোন করতে দিলেন তিনি। শেরিফকে পেতেও অসুবিধে হলো না। তিনি বললেন, এখুনি আসছি। বার বার মনে হতে লাগল, কেবিনে ফিরে আসি, তোমাদের কোন সাহায্য লাগতেও পারে। কিন্তু ভয়ও হলো, সাহায্য করতে এসে না বিপদে ফেলে দিই। দ্বিধায় দ্বন্দে ভুগতে ভুগতে মিসেস ভারগনের, বাড়িতেই বসে রইলাম পুলিশ না আসা পর্যন্ত।
দারুণ একখান কাজ করেছ, হাসল মুসা। মস্ত ফাঁকি দিয়েছ ব্যাটাকে। তবে টেলিফোনটা করে সবচেয়ে ভাল করেছ। এত তাড়াতাড়ি পুলিশ না এলে আমাদের কি হত কে জানে! ডোবার ভয়ঙ্কর লোক! ও আমাকে আর ক্যাপ্টেন রিটনকে খুন করার মতলব করছিল।
কিশোর পুমাটার পেছনে বেরিয়ে যাওয়ার পর কি হলো, জানাল মুসা। তাকে ধরে ফেলল ডোবার। গায়ে অসম্ভব জোর লোকটার, তাছাড়া হাতে পিস্তল ছিল, কাবু করতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। ওকে নিয়ে গিয়ে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একই ঘরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখল। ফেরেল ফিরে এলে একটা ব্যবস্থা করবে বলছিল। এই সময় কেবিনের দিকের দরজা খুলে পুলিশ নিয়ে ঘরে ঢুকল রবিন।
ডোবার আর ফেরেলকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে ভোলা হয়েছে, এসে খবর দিল একজন পুলিশ। হুগারফকে আগেই তোলা হয়েছে। এখানে আর কোন কাজ নেই। ওঠার আগে তিন গোয়েন্দাকে একটা খবর জানালেন শেরিফ, ডাকাতদের খোঁজ কেউ দিতে পারলে পুরস্কার দেয়া হবে ঘোষণা করেছে একটা কোম্পানি। তাদের অনেক মাল লুট করেছে ডাকাতেরা। এখন একেবারে বমাল ওদের ধরে দেয়াতে নিশ্চয় ভাল একটা অঙ্কের টাকা পাবে। তিন গোয়েন্দা। শীঘ্রি সেটার ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা দিয়ে, কয়েকবার করে ওদের ধন্যবাদ দিয়ে, উঠলেন তিনি। যাওয়ার আগে বললেন, হ্যাঁ, একবার আমার অফিসে দেখা কোরো, পারলে আজই। তোমাদের কেসের রিপোর্ট লিখে নিতে হবে।
তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর রবিন বলল, যাক, একটা কাজের কাজ হলো। ওকে কি করে সাহায্য করা যায়, ভাবছিলাম। আমার ভাগের পুরস্কারের টাকাটা ওকে দিয়ে দেব। আর্ট স্কুলে যাতে ভর্তি হতে পারে।
আমারটাও, সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করল মুসা।
পুরোটাই দিয়ে দেয়া হবে। তাতেও না কুলালে অন্য ব্যবস্থা করার কথা ভাবব। চলো, ওকে খুঁজে বের করি। সুখবরটা জানাই, বলে উঠতে গেল কিশোর।
কিন্তু ওঠার আগেই দরজায় দেখা দিল পিচার। হাসিমুখে ভেতরে ঢুকল কুকুরের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে।