৩. পাওয়া গেল টনিকে; কিশোরকে ঘিরে এল সবাই।

0 Comments

পাওয়া গেল টনিকে। কিশোরকে ঘিরে এল সবাই।

টনি, কিশোর বলল, আমি কিশোর পাশা, তোমার দাদার বাসায় দেখা হয়েছিল, মনে আছে? শোনো, তোমার সাহায্য দরকার। গাড়িটা নিয়ে আসতে পারবে? দশ মিনিটের মধ্যে?…গুড। খুব জরুরি।…এলে সব বলব। ঠিকানা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। বন্ধুদেরকে জানাল, আসছে। হয়ত ধরতে পারব এরিনাকে। মলিকে কারও কাছে রেখে আসতে হবে তার, তাতে সময় লাগবে। ব্যাংকে গিয়ে জিনিসটা বের করতেও কিছু সময় লাগবে। আশা করছি, ততোক্ষণে চলে যেতে পারব আমরা।

রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ঠিক দশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল টনি। ওঠো ওঠো, জলদি!

গাড়িটা বড় না, কিন্তু জায়গা হয়ে গেল সকলের।

কোথায় যেতে হবে? জানতে চাইল টনি।

বলল কিশোর।

দ্রুত ফুটল গাড়ি। ভাল চালায় টনি। রাস্তাও সব চেনা। শর্টকাটে চলল সে।

তবুও গোয়েন্দাদের মনে হল, বড় আয়ে চলছে গাড়ি। লাফ দিয়ে দিয়ে এগোচ্ছে যেন ঘড়ির কাঁটা। টনিকে সব খুলে বলল কিশোর।

ব্যাংক থেকে বেরিয়েই গেল কিনা, পেছনের সিট থেকে বলল উদ্বিগ্ন জিনা, কে জানে!

সময়মতই পৌঁছল ওরা। সবে ব্যাংকের দরজার বাইরে পা রেখেছে এরিনা। হাতে সেই ব্যাগটা, নিশ্চয় ওটার ভেতরেই রেখেছে হারের বাক্স।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে চত্বর পেরোল সে। রাস্তায় উঠে হনহন করে হাঁটতে লাগল। একবারও পেছনে তাকাল না

আমি ভেবেছিলাম ট্যাক্সি নেবে,মুসা বলল।

নেয়নি যখন, কিশোর বলল, বোঝাই যাচ্ছে, বেশি দূরে যাবে না। নামো নামো, হেঁটে যাব আমরাও।

গাড়ি থেকে বেরোল গোয়েন্দারা। টনিও নামল।

একসাথে থাকা ঠিক হবে না, কিশোর বলল। চোখে পড়ার ভয় আছে। টনি, তুমি আগে আগে থাক। তোমাকে চেনে না এরিনা। দেখে ফেললেও সন্দেহ করবে না।

ডানে মোড় নিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছে গেল এরিনা। দ্বিধা করল একমুহূর্ত। তারপর ফিরে তাকাল। তবে টনিকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেল না সে। কিশোরের অনুমান ঠিক, টনিকে চিনতে পারল না সে।

নিশ্চিন্ত হয়েই যেন আবার দ্রুত হাঁটতে লাগল এরিনা। তারপর একসময় গতি কমিয়ে দিল। সময় এসে গেছে, বুঝল গোয়েন্দারা।

বেশ দূরে রয়েছে ওরা। তবু দেখতে পাচ্ছে, রাস্তার লোকের নজর নেই এরিনার দিকে। যে যার পথে চলেছে। তারমানে, ম্যাকি ওদের মাঝে নেই।

চলার গতি আরও কমালো এরিনা। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। লোকটাকে খুঁজছে? নাকি অন্য কিছু?

হঠাৎ যেন মনস্থির করে ফেলল এরিনা। বা বগলের তলায় ছিল ব্যাগটা, ডান হাতে নিল। তারপর ছুঁড়ে দিল পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির দিকে।

গাড়ির সামনের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ব্যাগটা।

মুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা।

ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়েই চলার গতি আবার বাড়িয়ে দিল এরিনা।

সবাইকে আসতে বলে দৌড় দিল কিশোর। টনি আগেই দৌড়াতে শুরু করেছে। চোখের পলকে তার পাশে চলে গেল রাফিয়ান। অবাক হয়ে পথচারীরা তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

এত তাড়াহুড়ো করেও লাভ হল না।

ইঞ্জিন চালই ছিল গাড়িটার। রাস্তায় উঠেই হটতে শুরু করল।

থমকে দাঁড়াল কিশোর আর টনি দুজনেই। রাফিয়ান দাঁড়াল না। লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল গাড়িটার ওপর। লাভ কিছুই হল না, শুধু তার নখের সামান্য আঁচড় লাগল গাড়ির বডিতে।

দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল গাড়িটা।

চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছে এরিনা। ফিরে তাকিয়ে গোয়েন্দাদের দেখে অবাক। চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল, আমাকে খুঁজে বের করলে কিভাবে?

জানাল কিশোর।

চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এরিনার। সর্বনাশ! ও তোমাদেরকে নিশ্চয় দেখেছে…

দেখুক, দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। ধরতে পারলে হত আজ! ব্যাটাকে…

মলিকে না আবার ধরে নিয়ে যায়…

হারটা তো দিয়েই দিয়েছেন, বেশ একটু ঝাঝের সঙ্গেই বলল জিনা। তাহলে আর নেবে কেন? অযথাই কষ্ট করলাম আমরা, মিসেস কলিনস। জিনিসটা দিলাম আপনাকে, কিন্তু রাখতে পারলেন না।

হার গেছে যাক। আমার মলির কিছু না হলেই হয়।

ব্যাটা পালাল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে আনমনে বলল কিশোর। ও-ই জিতল শেষ পর্যন্ত! দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।

ভূল হয়ে গেছে, মুখ কালো করে বলল টনি। ট্যাক্সিতে করে পিছু নিতাম, সেটাই ভাল হত।

টনির সঙ্গে এরিনার পরিচয় করিয়ে দিল কিশোর।

সামলে নিয়েছে এরিনা। সবাইকে ধন্যবাদ দিল। মাথা চাপড়ে দিল রাফিয়ানের। বলল, দেখ, কিছু মনে কোরো না তোমরা। অনেক কষ্ট করেছ আমার জন্যে। কপাল খারাপ, রাখতে পারলাম না জিনিসটা।

এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়, কিশোর পাশা। ড্রাইভারের চেহারা দেখেছেন?

না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি…

হুঁ, আমরাই দেরি করে ফেলেছি! মুঠো শক্ত হয়ে গেল মুসার।

আর কিশোর মনে মনে নিজেকে গালমন্দ করছে। কেন একবারও ভাবেনি, গাড়িতে করে আসতে পারে লোকটা?

আবার ফিরে এসে টনির গাড়িতে উঠল ওরা। এরিনারও জায়গা হয়ে গেল।

তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাবটা টনিই দিয়েছে।

এক পড়শীর কাছে মলিকে রেখে এসেছে এরিনা। বাসার সামনে গাড়ি থামলে আরেকবার সবাইকে ধন্যবাদ জানাল সে। নামল। বলল, হারটা গেছে, যাক, কিন্তু ওটার বদৌলতে তোমাদের মত বন্ধু পেয়েছি। এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া।

এরিনা চলে গেলে টনি বলল, চল, তোমাদেরকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। গাড়ি চলছে। খানিক পর আবার বলল, চোরটা তাহলে পালালই শেষতক।

পালিয়ে যাবে কোথায়? দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। চোরটা যদি ম্যাকি হয়ে থাকে, ধরা তাকে পড়তেই হবে।

যদি না হয়? রবিন বলল।

ওই ব্যাটাই, ফুঁসে উঠল জিনা। এরিনার কাছে হার আছে, এই খবর একমাত্র ওই শয়তানটাই জানে। হারটা ফিরিয়ে আনতেই হবে।

কিভাবে? প্রশ্ন রাখল মুসা।

হ্যাঁ, কিভাবে? টনিও জানতে চাইল। ম্যাকির বাড়িতে গিয়ে খুঁজবে নাকি? অনেকটা সেরকমই, জবাব দিল কিশোর।

তোমার সাহস আছে, কিশোর পাশা, টনি বলল। বাঘের গুহায় গিয়ে ঢুকতে চাইছ। লোকটা ভারি বদ, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যে লোক কিডন্যাপ করার হুমকি দিতে পারে…যাকগে। যখন যাও, আমাকে ডেকো.ওই যে, তোমাদের বাসায় এসে গেছি।

লাঞ্চের পর হইতে বেরোল গোয়েন্দারা। চলে এল স্কোয়্যারটার পাশের পার্কে। চমৎকার রোদ। এক কোণে একটা ঝাড়ের কাছে বসে আলোচনা শুরু করল ওরা।

ম্যাকির দোকানের ওপর চোখ রাখতে হবে, কিশোর বলল। খদ্দের ছাড়া আর কে কে আসে দোকানে, জানতে হবে। দরকার হলে ওর পিছু নেব। হারটা নিয়ে গিয়ে তো আর বসে থাকবে না, বিক্রি করতে হবে।

যদি টাকা চায়, রবিন বলল।

হ্যাঁ, যদি টাকা চায়, বলল মুসা। কিশোর, শুধু দোকানের ওপর চোখ রেখে যে লাভ হবে না, সেটা ভাল করেই জানো তুমি। অন্য কোন মতলব করেছ। সেটা কি, বলবে?

দোকানে ঢোকার চেষ্টা করব।

মানে?

ভেতরে ঢুকে না খুঁজেলে কিভাবে জানব কোথায় রেখেছে হারটা?

কিন্তু আমাদেরকে এখন চেনে সে। দরজা থেকেই তাড়াবে।

সেজন্যেই তো না দেখিয়ে চুকব। চুরি করে। মুচকি হাসল কিশোর। চুরি করে আমাদের বাড়িতে ঢুকতে পেরেছে সে, আমরা কেন পারব না? তেমন বুঝলে রাতের বেলাই ঢুকব।

ভ্রূকুটি করল জিনা। না, কিশোর, মা রাতে বেরোতে দেবে না। আর যদি দেয়ও–জানতে চাইবে কোথায় যাচ্ছি।

তা তো চাইবেনই। সেজন্যেই তো কাজে নামার আগে আলোচনা করতে চাইছি ভালমত। রাতে গিয়ে সুবিধে হবে কিনা সেকথাও ভাবতে হবে। কারণ, রাতের বেলা দোকান তালা দেয়া থাকবে। নিচের ঠোঁটে একবার চিমটি কাটল কিশোর। ম্যাকি কোথায় থাকে জানি না। দোকান কথন বন্ধ করে তাও জানি না। আসলে, ওর সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। জানতে হলে নজর রাখতে হবে ওর ওপর।

নজর রাখার ব্যাপারে কারোই অমত নেই।

পরের তিন দিন তা-ই করল ওরা। পালা করে। চোখ রাখল ম্যাকির দোকানের ওপর। জানা হয়ে গেল অনেক তথ্য।

পাঁচটায় দোকান বন্ধ করে, রবিন জানান।

বিক্রি বন্ধ করে আরকি, মুসা বলল। বেরোয় ছটার সময়।

ওই এক ঘন্টা হিসেব-নিকেশ করে, বলল জিনা। এখানে ওখানে ফোন করে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখোচ্ছ।

তারপর ছটার সময় বেরিয়ে, একটা রেস্টুরেন্টে যায়, কিশোর বলল, খাওয়ার জন্যে। থাকে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায়। অনেক কিছুই জানলাম। এখন কাজ শুরু করা যেতে পারে…

পরিকল্পনার কথা বন্ধুদের জল সে। দোকান বন্ধ হওয়ার আগেই ঢুকে পড়তে চায় ওখানে, লুকিয়ে বসে থাকতে চায় কোথাও। তারপর ম্যাকি বেরিয়ে গেলে জিবে হারটা। মুখ খুলতে যাচ্ছিল মুসা, হাত তুলে তাকে থামাল গোয়েন্দাপ্রধান। না না, ভয় নেই, বিপদে পড়ব না। তোমরা বাইরেই থাকবে। দরকার পড়লে সাহায্য করতে পারবে আমাকে। আর যদি ম্যাকি ধরেই ফেলে, আমাকে, সোজা গিয়ে পুলিশকে জানাবে। ঠিক আছে?

অমত করে লাভ হবে না, বুঝতে পারল সহকারীরা। একবার যখন মনস্থির করে ফেলেছে কিশোর পাশা, আর তাকে ফেরানো যাবে না। যা ভাল বুঝবে, করবেই। কাজেই অহেতুক তর্ক করল না কেউ।

ঠিক হল, সেদিন সন্ধ্যায়ই দোকানে ঢুকবে কিশোর।

দোকান বন্ধ হওয়ার সামান্য আগে এগিয়ে গেল মুসা। সাবধানে উঁকি মেরে দেখে নিল, দোকানে কোন খদ্দের আছে কিনা। তারপর ঢুকে পড়ল ভেতরে।

কয়েক গজ দূরে একটা বিজ্ঞাপনের বোর্ডের ওপাশে লুকিয়ে বসে রইল জিনা, রবিন আর রাফিয়ান। কিশোর মুসার পেছন পেছন এসেছে। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগল মুসা কি করে।

স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ম্যাকির দিকে এগোল মুসা।

তাকে দেখে ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল লোকটার। মনে হল চিনে ফেলেছে। পরমুহূর্তে সামলে নিয়ে হাসল। বলল, গুড ইভনিং ইয়াং ম্যান। কি লাগবে?

মুসা বুঝল, তার ওপর থেকে নজর সরাবে না ম্যাকি। এটাই আশা করেছিল কিশোর।

গুড ইভনিং, ভদ্রভাবে জবাব দিল মুসা। আমার মার জন্যে একটা উপহার কিনতে এসেছি। বাহ, বেশ চমৎকার ফুল তো। দেখতে পারি? হাত তুলে ফুলের তোড়াটা দেখাল সে।

দেয়ালের তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কিছু ফুলের তোড়া। সেদিকে এগোল ম্যাকি। এইই সুযোগ, জানালা দিয়ে দেখে বুঝল কিশোর। চট করে ঢুকে পড়ল সে। মাথা নিচু করে শো-কেসের আড়ালে আড়ালে চলে গেল আরেকটা দরজার দিকে সেটা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল। ম্যাকির নজর মুসার দিকে। ফলে সে তাকে দেখতে পেল না।

ঘরটায় ঢুকে চারদিকে চোখ বোলাল কিশোর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। মুসা ওদিকে নিয়ে ফুল দরাদরি করছে, সময় দেবে কিশোরকে কিন্তু কতটা আর দিতে পারবে।

ঘরটা বেশ বড়। বাঁয়ের দেয়ালের কাছে বিশাল একটা আলমারি। আর পেছনের দেয়ালের কাছে একটা ডিভান। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার! ভান পাশের দেয়ালের কাছে…গুড! আনমনে বিড়বিড় করল সে, ওয়ারড্রোবটা বেশ বড়। লুকানো যাবে।

কোটস্ট্যাণ্ড থেকে ঝুলছে ম্যাকির কোট। তারমানে আপাতত আর ওয়ারড্রোব খুলবে না সে। ভেতরে দেখে আরও নিশ্চিত হল কিশোর। শুধু একটা রেইনকোট, আর কিছু নেই। ওটার জন্যে খুলবে না ম্যাকি। ভেতরে ঢুকে দরজা টেনে দিল সে, ওরে সামান্য ফাঁক রাখল বাতাস চলাচলের জন্যে। এখন শুধু অপেক্ষা।

খানিক পরে মুসার কথা থেকেই বোঝা গেল ফুল কিনে, দাম চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সে। দরজার ছিটকানি আটকানোর শব্দ কানে এল। তারমানে বন্ধ হয়ে গেল দোকান। দরজা লাগিয়ে ভেতরের ঘরে এসে ঢুকল ম্যাকি। দরজার ফাঁক দিয়ে কিশোর দেখল, আলমারির কাছে গেল লোকটা, খুলল, একটা বড় খাতা বের করল।

ওটা ওর অ্যাকাউন্ট বুক, বুঝতে পারল কিশোর।

আলমারির খোলা ফেলে রেখেই দোকানে গিয়ে ঢুকল আবার ম্যাকি। পরপর তিনদিন তার দোকানের ওপর চোখ রেখেছে গোয়েন্দারা, লোকটা এখন কি করছে বুঝতে অসুবিধে হল না কিশোরের। দোকানের ডেস্কে বসে দিনের বেচা-কেনার হিসেব করছে ম্যাকি। বাইরে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেই এখন যে কেউ তার কাজ দেখতে পাবে। দোকান বন্ধ করে যখন একবারে বেরিয়ে যায়, তখন লাগায় পুরানো ধাঁচের জানালার ধাতব পাল্লা।

লোকটা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে খোঁজা আরম্ভ করব, ভাবল কিশোর। আলমারিটার দিকে তাকিয়ে আরেকটা কথা জাগল মনে। যদি তালা লাগিয়ে দিয়ে যায় ম্যাকি? ওটার ভেতরে আর তখন দেখতে পারবে না সে। তবে কি এখনই…

ঝুঁকিটা নিল কিশোর। হাতুড়ি পিটতে শুরু করল যেন বুকের ভেতর। আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ওয়ারড্রোব থেকে। কান খাড়া রেখে পা টিপে টিপে এগোল আলমারির দিকে। কাছে এসে ভেতরে তাকাল। ছোট-বড় নানারকম বাক্স, গাদা গাদা খাম…আর কোণের দিকে ফ্যাকাসে নীল একটা বাক্স, হারটা যেটায় ছিল ওরকমই দেখতে। হাত বাড়াল কিশোর…

ঠিক এই সময় মচমচ করে উঠল চেয়ার। নিশ্চয় ম্যাকির। বোধহয় উঠে দাঁড়িয়েছে সে, ফিরে আসছে। তিন লাফে আবার ওয়ারড্রোবের কাছে চলে এল কিশোর। সে ঢুকে পড়ার সাথে সাথে ম্যাকিও ঢুকল ঘরে। আলমারিতে খাতাটা রেখে, ওটার দরজা খোলা রেখেই আবার চলে গেল দোকানে। জানালা লাগানোর শব্দ কানে এল।

লাগাতে বেশিক্ষণ লাগবে না। আবার আলমারির ভেতরটা দেখার সুযোগ চলে গেল। বেরোনোর সাহস করল না আর সে।

বেরোলে ভুলই করত, বুঝল খানিক পরেই। জানালা লাগিয়ে ফিরে এল ম্যাকি। ওয়ারড্রোবের দরজার ফাঁক দিয়ে কিশোর দেল, আবার আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াল লোকটা।

এইবার নিশ্চয় বন্ধ করে ফেলবে, ভাবল কিশোর।

না, বন্ধ করল না। বরং ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল নীল বাক্সটা। হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল একমুহূর্ত। তারপর খুলে বের করল টা। আঙুল বুলিয়ে দেখতে লাগল। যেন কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না ওটার ওপর থেকে।

হঠাৎ বেজে উঠল টেলিফোন। ঝট করে সেদিকে ফিরল ম্যাকি। তারপর তাড়াতাড়ি আবার হারটা বাক্সে ভরে আলমারিতে রেখে লাগিয়ে দিল দরজা। কিট করে তালা লেগে গেল।

গেল! ডাবল কিশোর। হারটা দেখলাম। জানি এখন কোথায় আছে, কিন্তু চেষ্টা করেও হাত লাগাতে পারব না!

শুনতে পেল ম্যাকির কণ্ঠ, টেলিফোনে কথা বলছে, হ্যালো, হেইকি? কি ব্যাপার? এই অসময়ে?…হা হা, বন্ধ করে দিয়েছি।উচিত হল না। দোকানে কাস্টোমার থাকতে পারত এখন। তাহলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে হত না? যাকগে, ভবিষ্যতে আর এভাবে ফোন করবেন না। যখন করতে বলব তখন করবেন। চালে সামান্য ভুল হলেই সব শেষ…কি বললেন?…না না, নিশ্চয়ই না। তবে সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।…আরে বাবা, এত দামি একটা জিনিস, পেয়েছি কিনা জানার জন্যে উদ্বিগ্ন তো হবেনই। সবাই হবে। তাই বলে হুঁশিয়ার থাকতে হবে না? যা-ই হোক, এভাবে আর ফোন করবেন না। আপনার বন্ধুদেরকেও মানা করে দেবেন।

নীরবে কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনল ম্যাকি, তারপর আবার বলল, শুনুন, আগেও বলেছি, আবার বলছি, মুক্তার নতুন চালান এল কিনা জানতে চাইলে সোজা চলে আসবেন। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বললেই তো হয়ে যায়। ফোন করাটা সব সময়ই বিপজ্জনক। আপনিও তা বোঝেন, বার বার বলে দিতে হয় কেন? তো রাখি এখন। গুডবাই।

রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ হল।

ওয়ারড্রোবের ভেতর দম বন্ধ করে বসে রইল কিশোর। বুঝতে পেরেছে, কতটা ভয়ঙ্কর লোকের ঘরে এসে ঢুকেছে। লোকটা শুধু ওই একটাই নয়, আরও অনেক মুক্তা চুরি করেছে। চোরাই মুক্তার ব্যবসা করে। ওরকম পেশাদার একজন লোক অবশ্যই বিপজনক।

ফিরে এল ম্যাকি। আবার খুলল আলমারি। আরেকবার বাক্স খুলে মুক্তাটা বের করে দেখল। তারপর রেখে দিয়ে দরজা লাগাল। এলোমেলো করে দিল তালার কম্বিনেশন নাম্বারগুলো।

ফাঁক দিয়ে দেখছে কিশোর, ওভারকোট পরল লোকটা। যাক, বেরোলে বাঁচা যায়। সে-ও বেরোতে পারবে। বাইরে নিশ্চয় অস্থির হয়ে উঠেছে তার বন্ধুরা।

বেরিয়ে গেল ম্যাকি। দোকানের সদর দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেল। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বেরিয়ে এল কিশোর। এগোল ডিভানটার দিকে। তার জানা আছে, ওটার পেছনে নিচে নামার সিঁড়ি আছে, ওই সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া যাবে মাটির নিচের ঘরে। ওখানে দোকানের স্টোররুম, মাল জমিয়ে রাখা হয়। বেশ কায়দা করে এই খবরটা জেনে নিয়েছে রবিন।

ঢুকেছে যখন সবকিছুই দেখে নিতে চায় কিশোর। সুযোগ সব সময় আসে। বলা যায় না কখন কোন তথ্যটা কাজে লেগে যাবে। সেলারের দেয়ালের ওপরে একটা ছোট জানালা, আলো আসছে ওটা দিয়ে। ওখানে পৌঁছতে পারলে ওটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে সে। জিনিসপত্রগুলো দেখল সে। সাধারণ জিনিস, দোকানে যা বেচাকেনা হয়। বিশেষ কিছু দেখার নেই। একটা পুরানো টেবিল টেনে এনে জানালার নিচে রাখল। উঠে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কাউকে চোখে পড়ল না। বেরোতে খুব একটা কষ্ট হল না।

উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে বন্ধুরা।

এসেছ? বলে উঠল মুসা। আমরা তো ভাবছিলাম আটকাই পড়লে নাকি। তা কি দেখলে?

চল, হাঁটতে হাঁটতে বলছি। ট্রেন ধরতে হবে, কিশোর বলল।

বলেছিলাম না! সব শুনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল জিনা, ব্যাটা একটা আন্ত শয়তান! আর কোন বেআইনী ব্যবসা করে কে জানে!

বন্ধ করতে হবে এসব, রবিন বলল।

সহজ হবে না,মুসা বলল।

না, তা হবে না, একমত হল কিশোর। তবে অসম্ভবও নয়। ভাগ্যিস আমি থাকতে থাকতেই ফোনটা বেজেছিল। নইলে কিছু জানতেই পারতাম না। মূল্যবান একটা সূত্র পেয়েছি।

কী? জানতে চাইল মুসা।

মাল এল কিনা জানার জন্যে দোকানের জানালায় এসে দাঁড়াবে হেইকি বা তার কোন সহকারী। চোখ রাখব আমরা। কে আসে দেখতে পারব। দলবলসুদ্ধ ম্যাকিকে ধরার ব্যবস্থা করা যাবে তখন।

গুড আইডিয়া, তুড়ি বাজাল জিনা।

হুফ! করে রাফিয়ানও যেন একমত হল।

পরদিন সকালে আবার বেরোল ওরা। এলাকাটায় সেদিন লোকের বেশ ভিড়। ব্যস্ত হয়ে লোকজন বড়দিনের উপহার কিনছে। এতে সুবিধে হল গোয়েন্দাদের। ওদের ওপর চোখ পড়বে না সহজে ম্যাকির দোকানের ওপর চোখ রাখল ওরা।

তার পরদিন রোববার। সম্মেলন বন্ধ। কিন্তু ঘরে বসে রইলেন না মিটার পারকার, স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন এক বন্ধুর বাড়িতে। সুবিধেই হল গোয়েন্দাদের। দুপুরে খাবার পর বেরিয়ে পড়ল ওরাও।

চল, চিড়িয়াখানা দেখতে যাই, প্রস্তাব দিল মুসা। শুনেছি, এখানকার চিড়িয়াখানাটা নাকি বেশ বড়।

সুতরাং চিড়িয়াখানায় চলল ওরা। আর যা ভাবতেও পারেনি তা-ই ঘটে গেল। জন্তুজানোয়ার দেখছে আর ঘুরছে ওরা, হঠাৎ মুসার চোখে পড়ল খোয়া বিছানো একটা পথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে রবার্ট ম্যাকি। জাপানী একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। খানিক পরে পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে লোকটার হতে দিল সে।

হারের বারটাই দিল মনে হয়, ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর।

এক কাজ করলে হয়, রবিন বলল। আলাদা আলাদা হয়ে দুজনেরই পিছু নিতে পারি আমরা। কোথায় যায় দেখতে পারি।

কিন্তু কাছেই যে একটা শিম্পাঞ্জী রয়েছে, গোল বাধাবে ওটা, ভাবতে পারেনি সে। রাফি চলে গেছে ওটার খাঁচার কাছে। বেশ কিছুক্ষণ থেকেই তক্কে তক্কে ছিল বানরটা, পেয়ে গেল সুযোগ। চোখের পলকে দোলনা থেকে নেমে এসে শিকের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে চেপে ধরল রাফিয়ানের লেজ। মারল হ্যাঁচকা টান। ব্যথায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল কুকুরটা।

বেশ কিছু ছেলেমেয়ে কাও দেখে দৌড়ে এল। হাসতে শুরু করল অনেকে। তাদের ওপর ভীষণ রেগে গেল জিনা। দৌড়ে এল চিড়িয়াখানার একজন লোক, অনেক চেষ্টা করে শিপাত্রীর হাত থেকে রাফির লেজ ছাড়াল।

এই গোলমালের মাঝে ম্যাকি আর তার সঙ্গীর কথা ভুলেই গেল গোয়েন্দারা। আবার যখন মনে পড়ল, ফিরে তাকিয়ে দেখে দুজনেই চলে গেছে।

গেল সর্বনাশ হয়ে! ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। আবার নতুন কোন বুদ্ধি বের করতে হবে আমাদের।

কি মনে হয়? রবিন বলল কিশোরকে, ওই বাক্সে হারটা ছিল?

কি জানি! ভালমত দেখিনি বাটা, জবাব দিল কিশোর। বোধহয় রোববারেই মাল ডেলিভারি দেয় ম্যাকি।

জিনা কোন কথা বলছে না। গভীর হয়ে বসে রাফিয়ানের লেজের পরিচর্যা করছে, আর মাঝেমাঝে জ্বলন্ত চোখে তাকাচ্ছে শিম্পাঞ্জীটার দিকে।

পরদিন আবার ম্যাকির দোকানে চোখ রাখার জন্যে গেল ওরা।

জানালার কাছে চলে গেল কিশোর। একটু পরেই ফিরে এল উত্তেজিত হয়ে। কি দেখলাম জানো?

কী! প্রায় একসাথে জানতে চাইল অন্য তিনজন।

নতুন বাক্স এসেছে অনেকগুলো, দেখে এলাম, কিশোর জানাল। অদুত বাক্সের ওপরে আস্ত ঝিনুক বসানো।

তাই নাকি! বুঝে ফেলেছে রবিন।

খাইছে! কিছুই তো বুঝলাম না, মুসা বলল। ঝিনুকের বাক্স দেখে এত উত্তেজিত হওয়ার কি আছে?

চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, ওরকম ভনির আজকাল আর লোকে তেমন কেনে না। তাহলে এত মাল এনেছে কেন ম্যাকি? –

হয়ত কম দামে পেয়েছে কোথাও, রবিন বলল। নিলামে-টিলামে এনেছে। এই দেখ, দেখ!

সবাই দেখল, হালকা-পাতলা ছোটখাট একজন মানুষ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ম্যাকির দোকানের দিকে।

জাপানী! ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। বিনকিউলার নিয়ে এসেছে আজ সাথে করে। সেটা চোখে লাগিয়ে তাকাল জানালার দিকে। লোকটা দোকানে ঢুকল। কয়েক মিনিট পরেই বলে উঠল মুসা, এই, ঝিনুকের একটা বাক্স নিয়ে যাচ্ছে ম্যাকি!

আরও কয়েক মিনিট পর দোকান থেকে বেরিয়ে এল জাপানী। হাতে সেই বাক্স।

ভ্রূকুটি করল কিশোর। আনমনে বলল, ভালই চালাচ্ছে ম্যাকি।

কি করব? অধৈর্য হয়ে বলল মুসা। পিছু নেব লোকটার? বাক্সটা কেড়ে নেব? যদি সত্যি সত্যি ও অপরাধী না হয়ে থাকে?

দোকানের ওপর চোখ রাখব আমরা, কিশোর বলল, যেমন রাখছি।

সুতরাং চোখ রাখল ওরা। অনেককে দোকানে ঢুকতে দেখল। বেরিয়ে এল হাতে কোন না কোন জিনিস নিয়ে। নিশ্চয় বড়দিনের উপহার। ওদের মধ্যে তিনজনের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হল। দুজন জাপানী, একজন ইউরোপিয়ান। তিনজনেই ঝিনুকের বাক্স কিনেছে।

এতে কিন্তু কিছু প্রমাণ হয় না, জিনা বলল।

না, তা হয় না, স্বীকার করল কিশোর।

তাহলে প্রমাণ জোগাড় করি, চল।

কিভাবে? প্রশ্ন রাখল রবিন।

তিনজনেই তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের মুখের দিকে।

বার কয়েক ঘনঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল গোয়েন্দাপ্রধান। তারপর বলল, রবিন, এবার তুমি যাবে।

আমি?

হ্যাঁ আমার বিশ্বাস, তোমার ওপরই নজর কম দিয়েছে ম্যাকি। বলতে বলতে সাথে করে আনা ঝোলায় হাত ঢোকাল কিশোর। বের করল একটা কালো পরচুলা। এটা পরে নাও, ভাল হবে। আমাদের শোবার ঘরের তাকে পেয়েছি। আরও আছে কয়েকটা। আর এই সানগ্লাসটা পরে নাও, বলে নিজের চোখেরটা খুলে দিল সে। অন্য চেহারা হয়ে যাবে তোমার। চিনতে পারবে না ম্যাকি।

বেশ, উইগ পরতে পরতে রবিন বলল, গেলাম। কি করতে হবে আমাকে?

সাধারণ কাস্টোমারের মত গিয়ে ঢুকে ঝিনুকের বাক্স দেখিয়ে বলবে, ওরকম একটা কিনতে চাও।

তাতে কি হবে?

ম্যাকির প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারবে। হয়ত খুশি হয়েই বিক্রি করবে…

তাহলে সেটা খুশির ব্যাপার হবে না আমাদের জন্যে, হেসে বলল রবিন।

বিক্রি করতে রাজি না-ও হতে পারে। তাহলে আমরা বুঝব ঠিক পথেই এগোচ্ছি। যাও, আর দেরি কোনো না। বিক্রি করুক আর না করুক, বিপদে পড়বে বলে মনে হয় না।

পরচুলা আর সানগ্লাস পরে অন্য মানুষ হয়ে গেল রবিন। এগিয়ে চলল দোকানের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধা করল এক মুহূর্ত, তারপর আস্তে ঠেলে ফাঁক করল পালা। ম্যাকি একা। খরিদ্দার ঢুকছে দেখে বিগলিত উজ্জ্বল হাসি হাসল। এসো এসো। তা, কি চাই?  রবিন বুঝল, তাকে চেনেনি ম্যাকি। বলল, একটা স্যভনির চাই। জানালার দিকে তাকাল। বাক্সগুলোর দিকে তাকিয়ে পছন্দ করার ভান করল। বাহ্‌, দারুণ তো! নিশ্চয় ওগুলোতে কড়ি আছে? খুব ভাল হবে।

সরি, ওগুলো বিক্রির জন্যে নয়, দ্রুত বলল ম্যাকি। এমনি সাজিয়ে রেখেছি, দোকানের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যে।…এই যে দেখ, চমৎকার সব জিনিস আছে……

কিন্তু আমি তো এসব চাই না, হতাশ হয়েছে যেন রবিন। কড়িগুলো কি সত্যি বেচবেন না?

না, দৃঢ়কণ্ঠে বলল ম্যাকি।

নিরাশ ভঙ্গিতে অন্যান্য জিনিসের দিকে তাকাতে লাগল রবিন। শেষে, আর কিছুই পছন্দ হয়নি বলে বেরিয়ে এল দোকান থেকে। পেছন পেছন এল ম্যাকি। যত তাড়াতাড়ি পারে রবিনকে বের করে দিয়ে হাঁপ ছাড়তে চায় যেন।

সরাসরি সাইনবোর্ডের দিকে না এগোনোল্প মত বুদ্ধি আছে রবিনের। বলা যায়, পেছন থেকে তাকিয়ে থাকতে পারে ম্যাকি। উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল সে। গোটা দুই বুক ঘুরে আরেক দিক দিয়ে ফিরে এল সাইনবোর্ডের কাছে।

সত্যিই বেচল না হলে! সব নে বলে উঠল মুসা।

ঠিকই সন্দেহ করেছি, কিশোর বলল। চল, জলদি বাড়ি চল। সময় নষ্ট করা যাবে না। আরেকটা উইগ দরকার। ফিরে আসতে আসতে বাকি বাক্সগুলো বিক্রি করে ফেললেই হয়।…

ফেরার পথে তার পরিকল্পনার কথা জানাল কিশোর। ছদ্মবেশ নিয়ে আমিও যাব ঝিনুকের বার কিনতে। দেখি কি বলে!

আমার বোনের জন্যে, বুঝেছেন, বলল আমেরিকান কিশোরের ছদ্মবেশধারী কিশোর। ছোট বোনের জন্যে কিনতে চাই। ভাল কি আছে আপনার দোকানে? জানালার দিকে তাকাল সে। আর মাত্র দুটো বাক্স অবশিষ্ট রয়েছে।

অনেক কিছুই আছে, ইয়াং ম্যান, হেসে বলল ম্যাকি। কিশোরের লা লালচে চুলের দিকে তাকাল। এই যে দেখ, কত জিনিস…

আমি ওই কড়ি কিনতে চাই, হাত তুলে বার দেখাল কিশোর।

সরি, মাথা নাড়ল ম্যাকি, ওগুলো বিক্রির জন্যে নয়।

হতাশ হল কিশোর। তাই নাকি? আহ-হা…

তার কথায় বাধা পড়ল। দোকানে ঢুকল একজন লোক। পকেট থেকে বের করল একটা খাম, বেশ পুরু। অনুমান করতে পারল কিশোর, কি আছে ওর মধ্যে। টাকা! নোটের বাণ্ডিল।

খাম দেখে চমকে গেল ম্যাকি, কিশোরের চোখ এড়াল না সেটা। বলল, আমি ওই কড়ির বাক্সই চাই, অন্য কিছু না। চোখের কোণ দিয়ে দেখল, ভূরু কুঁচকে গেহে আগন্তুকের।

বিশেষ ধরনের খামে টাকা নিয়ে যারা ঢোকে, তাদেরকে ঝিনুকের বাক্স দিয়ে দেয় ম্যাকি, বুঝতে পারল কিশোর। ওই খামই হল সঙ্কেত।

অনেক চাপাচাপি করল কিশোর, কিন্তু কিছুতেই তার কাছে বাক্স বিক্রি করতে রাজি হল না ম্যাকি।

অবশেষে পুরানো আমলের ছোট একটা পেপারওয়েইট কিনে বেরিয়ে এল কিশোর। কয়েক পা এগিয়ে ফিরে তাকাল। দেখল, জানালার কাছের দুটো বাক্সের একটা নেই। মুচকি হাসল সে। চলার গতি বাড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, দোকান থেকে বেরিয়ে আসছে সেই লোকটা, হাতে বার। আর কোন সন্দেহ রইল না, চোরাই মুক্তোর ব্যবসা করে ম্যাকি।

উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে বন্ধুরা। তাদেরকে সব জানাল কিলোর।

আবার বাড়ি ফিরল ওরা। রাফিয়ানকে নিয়ে চলাফেরা বড় মুশকিল, বাসে ট্রেনে যেখানেই উঠুক, ঝুড়িতে ভরে নিতে হয়। এই বয়ে নেয়া আর ভাল লাগছে

তিন গোয়েন্দার। জিনাকে বোঝাতে অবশ্য কষ্ট হল, তবে শেষ পর্যন্ত বুঝল  সে।

বাড়িতে আটকে থাকতে মোটেও ভাল লাগল না কুকুরটার। ঘাউ ঘাউ করে, আরও নামারকম বিচিত্র শব্দ করে সেটা জানান দিল রাফি, কিন্তু তার অনুনয় কানে তুলল না কিশোর।

বাড়ির কাছেই একটা বাজার। সেখানে পুরানো, মাল বিক্রি হয় এরকম কয়েকটা দোকান দেখে গেছে কিশোর। তারই একটাতে ঢুকল ওরা।

ওই দেখ, হাত তুলে দেখাল রবিন, ম্যাকির দোকানে যেরকম দেখে এসেছে। ওরকম বক্স। ওরকম জিনিসই তো চাও?

হ্যাঁ।

বাক্সটা কিনে নিল কিশোর। তারপর ট্যাক্সিতে করে চলে এল আবার মিমোসা অ্যাভেন্যতে। ম্যাকির দোকানের জানালায় দেখা গেল, আরেকটা বাক্স তখনও রয়েছে।

রবিন, মুসা আর জিনাকে সাইনবোর্ডের কাছে থাকতে বলে, বাক্সটা ঝোলায় ভরে দোকানের দিকে এগোল কিশোর। যেভাবেই হোক, দেখতেই হবে, ঝিনুকের বাক্সের ভেতরে সত্যি সত্যি মুক্তো আছে কিনা।

কিশোর দোকানে ঢুকে দেখল, দুজন মহিলা জিনিস ঘাটাঘাটি করছে। ম্যাকি ওদের নিয়ে ব্যস্ত। আমেরিকান ছেলেটাকে দোকানে ঢুকতে দেখল সে, কিন্তু একবার চেয়েই আবার ফিরল মহিলাদের দিকে। ছেলেটাকে বিশেষ পাত্তা দিল না।

কিশোরও এটাই চায়। কয়েকটা পুতুল দেখতে দেখতে সরে যেতে লাগল জানালার কাছে। সুযোগের অপেক্ষায় রইল। কয়েকটা স্যভনির পছন্দ করল দুই মহিলা। টাকা বের করে দিল। দাম রেখে বাকি টাকা ফেরত দেয়ার জন্যে ক্যাশবাক্সের ওপর ঝুঁকেছে ম্যাকি, এই সময় চট করে ঝোলা থেকে বাক্স বের করে ঝিনুকের বাক্সের সঙ্গে বদল করে ফেলল কিশোর। দ্রত সরে এল জানালার কাছ থেকে। একটা পুতুল তুলে নিয়ে এগিয়ে এল কাউন্টারের দিকে। দাম মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল দোকান থেকে।

সেরে ফেলেছি! তুড়ি বাজিয়ে হেসে বন্ধুদেরকে জানাল কিশোর।

চল, ভাগি, মুসা বলল।

না। শেষ বাক্সটা কার কাছে বিক্রি করে দেখব। দোকানে বাক্স খোলে না ক্রেতা। কারণ, জানাই আছে ভেতরে কি আছে।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না ওদেরকে। একটা লোক ঢুকল দোকানে। বরিয়ে এল ঝিনুকের শেষ বাক্সটা অর্থাৎ কিশোর যেটা রেখে এসেছে সেটা নিয়ে।

এক কাজ করলে তো পারি, হঠাৎ বলল রবিন, ওর পিছু নিই না কেন? দখি না কোথায় যায়? একটা চোরের বাসা তো অন্তত চেনা থাকবে। পুলিশকে বলতে পারব।

ঠিক বলেছ, সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। চল।

বেশ দূরে থেকে লোকটাকে অনুসরণ করে চলল ওরা। কিছুক্ষণ পর মোেড় নয়ে কতগুলো দোকানের দিকে এগোল লোকটা। শহরের সব চেয়ে বড় অলঙ্কারের দোকানগুলো রয়েছে ওখানে। তারই একটাতে গিয়ে ঢুকল সে।

তাড়াতাড়ি দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল গোয়েন্দারা। জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাল। লোকটা কোন কাউন্টারের সামনে দাঁড়ায়নি, সোজা ঢুকে গেল একটা দরজা দিয়ে ভেতরের ঘরে। ভাবসাবে মনে হল এই দোকানের মালিকই সে।

হুঁ, বুঝলাম! মাথা দোলাল কিশোর। বেআইনী ভাবে মুক্তা আমদানি করে ম্যাকি। সেগুলো বিক্রি করে তারই মত ব্যবসায়ীর কাছে। এভাবে দেদার টাকা কামায় ওরা।

শয়তানটার মুখোশ খোলার সময় হয়েছে, নাকি? মুসা বলল। পুলিশকে এখন বলা যায়। প্রমাণ তো আমাদের সাথেই আছে, তোমার ঝোলায়।

চল, আগে বাড়ি যাই, কিশোর বলল। বাড়ি গিয়েই খুলব বাক্সটা।

বন্ধুদের ফিরতে দেখে খুব খুশি হল রাফিয়ান। আনন্দে চেঁচাতে শুরু করল। তড়িং তিড়িং করে লাফ দিল কয়েকটা। ছুটে আসতে চাইল ওদের কাছে, কিন্তু শেকল ছিড়তে পারল না। তাড়াতাড়ি গিয়ে খুলে দিল জিনা।

কেরিআন্টি ফিরে এসেছেন। রান্নাঘরে ব্যস্ত। খাবারের ডাক পড়তে দেরি আছে।

কিশোররা যে ঘরে থাকে, সেঘরে চলে এল সবাই, রাফি সহ। বাক্সটা ঝোলা থেকে বের করে টেবিলে রাখল কিশোর। সবাই তাকিয়ে আছে ওটার দিকে। ডালা খুলতে এগোল না কেউ, অথচ ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে প্রত্যেকে।

আল্লাহই জানে কি আছে! মা বলল।

আছে হয়ত সাত রাজার ধন! বলল রবিন।

জিনা, খোল, কিশোর বলল।

এগিয়ে গেল জিনা। কাঁপা কাঁপা হাতে তুলল বাক্সটা। ঝাঁকুনি দিল। ঝনঝন করে উঠল ভেতরে।

খোল! খুলে দেখ।

ডালা তুলেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল জিনা। সবাই ঘিরে এল তাকে। হফ! করে উঠল রাফিয়ান, এতক্ষণ পর এসেও তার দিকে কেউ নজর দিচ্ছে না, এটা পছন্দ হচ্ছে না তার।

অনেকগুলো ঝিনুক রয়েছে বাক্সে। তাড়াতাড়ি ওগুলো খুলে দেখতে শুরু করল ওরা। শেষ ঝিনুকটাও ভোলা হল। কিন্তু একটা মুক্তাও পাওয়া গেল না কোনটার ভেতরে।

তাহলে কি ভুল করলাম?–ভাবছে কিশোর। বিশ্বাস করতে পারছে না। না, মনের কথাটাই মুখে বলল সে, ভুল করতে পারি না। নিশ্চয় মুক্তা আছে!

জিনার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে নিল রবিন। ভেতরে আঙুল বুলিয়ে দেখল। কাগজের আচ্ছাদন, শক্ত কোন কিছু আঙুলে লাগল না।

ফলস বটম নেই তো? মুসা বলল।। এত জোরে গুলো দিল রবিন, বাক্সের তলা ফুটো হয়ে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল আঙুল।

না, ফলস বটম নেই, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। ভুলই করলাম বোধহয় আমরা।

হুফ! করে যেন সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল রাফিয়ান।

রবিনের হাত থেকে বাক্সটা নিল কিলোর। তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগল ভেতরটা। বিড়বিড় করে বলল, ফলস বটম নেই! দেয়ালের লাইনিঙের নিচেও কিছু নেই। ডালাটায় নেই তো?

না, পাতলা, মুসা বলল। ওর ভেতরে লুকানোর জায়গাই নেই।

ডালার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ওপরে বসানো ছোট ঝিনুকটার ওপর দৃষ্টি স্থির। জ্বলজ্বল করছে চোখ। পকেট থেকে ছুরি বের করে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিল ডালাটা। ঝিনুকের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল চোখা ফলা। চাড় দিয়ে খুলে ফেলল ডালা দুটো।

উত্তেজিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সবাই।

বেশ কায়দা করে আঠা দিয়ে আটকানো ছিল ঝিনুকের ডালাদুটো। ভেতরে গোলাপী খুঁজে তুলো ঠাসা। সাবধানে তুলোর দলাটা বের করে টেনে টেনে ছিঁড়ল কিশোর। বেরিয়ে পড়ল চমৎকার মুক্তোটা।

হাতের তালুতে ওটা রেখে তাকিয়ে রইল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে অন্য তিনজনও।

খাইছে! হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মুসা। এই তাহলে ব্যাপার! এভাবেই মুক্তা চোরাচালান করে!

হাসি ফুটল কিশোরের মুখে।

জিনা আর রবিনের মুখেও হাসি।

কলরব শুরু করে দিল ওরা। পাল্লা দিয়ে ঘেউ ঘেউ জুড়ল রাফিয়ান। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হৈ-চৈ শুনে কি হয়েছে দেখতে এসেছেন জিনার বাবা।

কি ব্যাপার? এত গোলমাল কিসের? রাস্তা থেকে চেঁচানি শোনা যাচ্ছে।

বাবা, বললে বিশ্বাস করবে না, জিনা চেঁচিয়ে বলল। দেখ কি পেয়েছি!

মুক্তা! ভুরু কুঁচকে গেল মিস্টার পারকারের। কোথায় পেলে?

অনেক লম্বা কাহিনী, বাবা।

বেশ, তাহলে খেতে খেতে শুনব। চল, গিয়ে দেখি, তোমার মায়ের হল কিনা।

খেতে খেতে সমস্ত কথা শুনলেন মিস্টার এবং মিসেস পারকার। মাঝে মাঝে দুএকটা মন্তব্য করলেন কেরিআন্টি, কিন্তু জিনার বাবা একেবারে চুপচাপ রইলেন।

কাজেই, বুঝতেই পারছ, বাবা, মুক্তা চোরের ঘাটি আবিষ্কার করে ফেলেছি আমরা, জিনা বলল।

আর মিসেস আরনিকা মেয়ারবালের হারটাও খুঁজে পেয়েছি, মুসা বলল। পুশিকে বলা যায় এবার, বলল কিশোর।

তা-ই করা হল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাছের থানায় চললেন মিস্টার পারকার। ডিউটি অফিসারকে সব খুলে বললেন। মুহূর্ত দেরি না করে পুলিশ সুপারের বাসায় ফোন করল অফিসার। ছুটে এলেন সুপারিনটেনডেন্ট। গোড়া থেকে আরেক দফা মুক্তা-চোরের গল্প শোনানো হল তাকে।

কাল থেকেই শুরু করব কাজ, বললেন তিনি। ওয়ারেন্ট নিয়ে গিয়ে ম্যাকিকে অ্যারেস্ট করব। তারপর চাপ দিলেই সুড়সুড় করে দলের সমস্ত লোকজনের নাম বলতে দিশে পাবে না।

ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে আবার বাড়ি ফিরে এলেন মিটার পারকার। সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে, ক্লান্ত লাগছে এখন। তবু ঘুমোতে গেল না জিনা। বাবাকে জিজ্ঞেস করল, কাল পুলিশ আমাদেরকে সঙ্গে নেবে, বাবা?

কি জানি। মনে হয় না। পুলিশের কাজের সময় তোমাদেরকে নেবে কেন?

বা-রে, আমরাই করে দিলাম সব। আর আমাদেরকে নেবে না?

না।

আর কিছু বলল না জিনা। ঘুমোতে চলল নিজের ঘরে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, আগামী দিন যখন ম্যাকিকে গ্রেফতার করতে যাবে পুলিশ, ওরাও থাকবে তখন ওখানে। পুলিশের সঙ্গে যাবার দরকার নেই, ওরা আলাদাই যাবে।

পরদিন সকালে উঠে এ-নিয়ে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে আলোচনা হল জিনা। সবাই রাজি।

দেখ, জিনা বলল, লোকটা মহা শয়তান। পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, যাবে।

ভাবছি, টনিকে সঙ্গে নিলে কেমন হয়? কিশোর বলল।

সবাই একমত হল এ-ব্যাপারে।

টনিকে ফোন করা হল। সংক্ষেপে জানানো হল সব কথা। সাঘাতিক উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। বলল, বাবার গাড়ি নিয়ে চলে আসবে। গোয়েন্দাদের নিয়ে যাবে মিমোসা অ্যাভেন্যুতে।

একেবারে সময়মত পৌঁছল ওরা। রাস্তার পাশের দোকানগুলো সবে খুলতে আরম্ভ করেছে। সাইনবোর্ডের আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। এল পুলিশের কালো গাড়ি। গাড়ি থেকে নামল সাদা পোশাক পরা দুজন পুলিশ। দোকানের দিকে এগোল। পুলিশের আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়াল প্রথম গাড়িটার কাছে।

বিড়বিড় করে বলল টনি, দোকান সার্চ করবে। ধরে বের করে আনবে ম্যাকিকে।

এখান থেকে কিছু দেখতে পাব না আমরা, মুসা বলল। ভেতরে কি ঘটে দেখা দরকার।

কিন্তু আমাদেরকে কি কাছে যেতে দেবে? রবিনের প্রশ্ন।

এসো আমার সঙ্গে, উঠে দাঁড়াল কিলোর।

গাড়ির দরজায় তালা লাগাল টনি। তারপর দ্রুত রওনা হল কিশোরদের পেছনে।

দোকানের পেছনের ওই যে গলিটা, চলতে চলতে বলল কিশোর, প্রায় নির্জন থাকে, দেখেছি। ওখানে গিয়ে জানালা দিয়ে দোকানের সেলারে নামা যাবে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠে পেছনের ঘরে ঢুকে আরামসে দেখতে পারব দোকানের ভেতরে কি হচ্ছে।

এক এক করে জানালা দিয়ে সেলারে নেমে পড়ল ওরা। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে, এই সময় কানে এল কড়া পুলিশী কণ্ঠ, জলদি আলমারি খোল! ভেতরে কি আছে দেখব।

মিনমিন করে কি বলতে যেয়ে আবার ধমক খেল ম্যাকি।

আলমারি খোলার শব্দ হল। মিনিটখানেক পর বলে উঠল আরেকজন পুলিশ, এই তো! মিসেস মেয়ারবালের নেকলেস!

হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। তাকাল সঙ্গীদের মুখের দিকে। প্রমাণ পেয়ে গেছে পুলিশ। বল ধরেছে ম্যাকিকে।

ব্যাটার খেল খতম, হাসতে হাসতে মুসা বলল। আর শয়তানী করতে পারবে না।

যেপথে ঢুকেছিল সেপথেই আবার বেরিয়ে এল ওরা। ভাবতেই পারেনি, বাইরে কি চমক অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে।

গলি থেকে মিমো অ্যাভেন্যুতে বেরিয়েই দেখল, দোকানের দরজা দিয়ে সবেগে বেরিয়ে আসছে ম্যাকি। দৌড় দিল একদিকে। হাতে হাতকড়া নেই। পুলিশ নেই পেছনে। হাতে সেই নীল বাক্সটা। কাপড়-চোপড়ের অবস্থা দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না, খুব একচোট ধস্তাধস্তি করে এসেছে।

পালাচ্ছে! চেঁচিয়ে উঠেই পিছু নিতে গেল মুসা।

তার হাত টেনে ধরল কিশোর। না। ওই দেখ।

বেরিয়ে এসেছে পুলিশ দুজন। একজনের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আরেকজন হাত নাড়তে নাড়তে বলল, ধর, ধর ব্যাটাকে! দৌড় দিল ম্যাকির পেছনে।

ইতিমধ্যেই ক্রেতার ভিড় বেড়ে গেছে রাস্তায়। বড়দিনের উপহার কিনতে এসেছে লোকে। সেদিকে দৌড়াচ্ছে ম্যাকি, লোকের ভিড়ে মিশে যাওয়ার ইচ্ছে।

হুড়াহুড়ি করে পুলিশের গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে ইউনিফর্ম পরা পুলিশেরা।

পালাল তো! ধর, ধর ব্যাটাকে! চেঁচিয়ে উঠল আবার সাদা পোশাকধারী পুলিশ।

পিস্তল ধরছে না কেন? মুসা বলল।

নেই হয়ত। এখানে পিস্তল-বন্দুক কমই ব্যবহার করে পু মরিকার মত সব সময় পিস্তল বয়ে নিয়ে বেড়ায় না, টনি বলল।

রাফি! চেঁচিয়ে বলল জিনা। ধর ব্যাটাকে!

আদেশ পেয়ে মুহূর্ত দেরি করল না রাফিয়ান। দুটল ম্যাকির পেছনে। তার পেছনে দৌড় দিল কিশোর গোয়েন্দারা।

তারপর খুব দ্রুত ঘটে গেল সমস্ত ঘটনা। লোকের কোলাহল আর পুলিশের হুইসেলে কান ঝালাপালা। বাঘের মত গিয়ে ম্যাকির ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশাল কুকুরটা। কোট কামড়ে ধরে ঝুলে রইল বিচিত্র ভঙ্গিতে।

ঝাড়া দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করল ম্যাকি। পারল না। দৌড়াতেও পারল না আর। চোখের পলকে এসে তাকে ঘিরে ফেলল পুলিশ। দুদিক থেকে চেপে ধরল হাত।

হাতকড়া পড়ল রবার্ট ম্যাকির হাতে।

সেদিন বিকেলের কাগজেই একেবারে সামনের পৃষ্ঠায় ছাপা হল খবরটা। তিন। গোয়েন্দা, জিনা আর রাফিয়ানের ছবি ছাপা হল তাতে। মিসেস এরিনা কলিন্স, তার মেয়ে মলি আর হারটার ছবিও ছাপা হয়েছে।

এরিনা আর মলিকে বড়দিনের দাওয়াত দিলেন কেরিআন্টি। টনিকেও। আর মাত্র একদিন দেরি আছে বড়দিনের। কয়েকদিনের জন্যে ছুটি, বৈজ্ঞানিক সম্মেলন বন্ধ। কাজেই বাড়িতেই থাকছেন মিস্টার পারকার। ছেলেমেয়েরা খুব খুশি। উৎসব ভালই জমবে মনে হচ্ছে।

সত্যিই ভাল জমল।

সারাদিন জিনাদের ওখানে কাটিয়ে বিকেলে বাসায় ফিরে গেল এরিনা। তার ওখানে পরদিন বিকেলে চায়ের দাওয়াত করে গেল সবাইকে।

পরদিন বিকেলে বিশেষ কাজ পড়ে যাওয়ায় এরিনার বাসায় যেতে পারলেন না কেরিআন্টি আর জিনার বাবা। ছেলেমেয়েদেরকে পাঠিয়ে দিলেন। টনির বাড়িতে কাজ থাকায় সে-ও আসতে পারল না।

হার ফেরত পেয়ে খুব খুশি এরিনা। গতদিন থেকে কয়েকবার ধন্যবাদ দিয়ে ফেলেছে ওদেরকে। চা খেতে খেতে আবারও বলল, কি বলে যে তোমাদের ধন্যবাদ দেব, বুঝতে পারছি না। আমার জন্যে অনেক করেছ তোমরা, ঝুঁকি নিয়েছ। অনেক ধন্যবাদ। হারটা বিক্রি করলে অনেক টাকা পাব। টাকার জন্যে আর ভাবতে হবে না কখনও আমাকে। কি বাঁচা যে বেঁচেছি বলে বোঝাতে পারব না তোমাদেরকে।

ম্যাকির সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছে এরিনা, তবু আরও কিছু জানা বাকি। পুলিশের কাছে যা যা শুনে এসেছে ছেলেময়েরা, চা আর চমৎকার নাস্তা খেতে খেতে সেগুলোই বলল।

সব স্বীকার করেছে ম্যাকি, কিশোর বলল। যারা যারা জড়িত আছে এই মুক্তা চোরাচালানের সঙ্গে, বলে দিয়েছে। ওদের বেশির ভাগই এখন হাজতে। জাপান থেকে বেআইনী ভাবে ওই মুক্তা আমদানি করা হত। এতে মধ্যস্থতা করত ম্যাকি।

লোক খারাপ, জিনা বলল। কাজেই হারটার কথা শুনে আর স্থির থাকতে পারেনি। চুরি করতে উঠেপড়ে লেগেছিল।

জানল কিভাবে হারটার কথা? কাপে আরও চা ঢেলে দিল এরিনা। চকোলেট কেকের প্লেটটা ঠেলে দিল। সবাইকে সাধাসাধি করল আরও নেয়ার জন্যে।

ম্যাকির দাদী ছিলেন মিসেস মেয়ারবালের বান্ধবী, রবিন জানাল। দাদীর মৃত্যুর পর তাঁর ডেস্কের ড্রয়ার ঘাঁটতে গিয়ে কতগুলো চিঠি পেয়ে যায় সে। ওগুলো পড়েই জানতে পারে র কথা। কোথায় লুকিয়ে রাখেন জিনিসটা কথায় কথায় একদিন ম্যাকির দাদীকে বলেছিলেন মিসেস মেয়ারবাল। সেটা ম্যাকির দাদীর ডায়েরীতে লেখা ছিল। চোরের ভয় বরাবরই ছিল মিসেস মেয়ারবালের, সে-কারণেই ওরকম একটা জায়গায় হারটা লুকাতেন। প্রায় সারাদিনই ওটার ওপর বসে থাকতেন তিনি, রাতে টাব চেয়ারটা থাকত তার বেডরুমে।

কিন্তু আমার কথা জানল কিভাবে ম্যাকি? এরিনা জিজ্ঞেস করল।

আমাদের পিছু নিয়েছিল, বলল মুসা। কেকের গোটা চারেক টুকরো শেষ করে আরও চারটে তুলে নিল নিজের প্লেটে। আরও হুঁশিয়ার থাকা উচিত ছিল আমাদের।

হুফ! করে মাথা দেলাল রাফিয়ান, যেন মুসার সঙ্গে একমত। আসলে কেক চাইছে সে। :

দুটো টুকরো তাকে দিল এরিনা। হেসে মাথা চাপড়ে দিয়ে বলল, আসল কাজটা তুইই করেছিস, রাফি। চোরটাকে পাকড়েছিস।

তোমার কুকুরটা খুব ভাল, জিনা, রাফিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল -মলি। এরকম একটা কুকুর যদি আমার থাকত! মা, দেবে কিনে একটা?

দেব।

হুফ! হুফ! বলল রাফিয়ান। যেন বোঝাতে চাইল, খুব ভাল হবে তাহলে মেয়েটাকে আর একা থাকতে হবে না।

তার মাথা দোলানোর ধরন দেখে না হেসে পারল না কেউ।

Categories:

This is a demo store for testing purposes — no orders shall be fulfilled. Dismiss