স্বর্গ যে বলে, ভুল বলে না! হাঁ করে তাকিয়ে আছে কিশোর। সৌন্দর্য যেন গিলছে। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে সুন্দর চোখের তারা। ডায়মণ্ড হেড ঘুরে এসেছে। শুকতারা, ওয়াইকিকির ধবধবে সাদা সৈকতের পাশ কাটাচ্ছে। সবুজ নারকেল গুচ্ছ মাথা দোলাচ্ছে বাতাসে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে জানা-অজানা অসংখ্য গাছ। ঘন। নীল সাগরের পানিতে সার্ফিং করছে সাফাররা। সাবোর্ডে টান টান হয়ে আছে। ওদের বাদামি শরীর। বিশালদেহী একেকজন।
হনুলুলু বন্দরে নোঙর ফেলল শুকতারা।
স্বপ্নের জগতে চলে এসেছে যেন ছেলেরা। পৃথিবীতে এত সুন্দর জায়গা থাকতে পারে, ভাবেইনি। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারল না ওই স্বর্গে। বড় দেখে ট্যাংক কিনল, তাতে ম্যানটাটাকে ভরে তুলে দিল লস অ্যাঞ্জেলেসগামী একটা স্টীমারে।
হাওয়াইকে যে এত ভাল বলছে ছেলেরা, এটা পছন্দ হল না কুমালোর। কথায় কথায় জানিয়ে দিল, তার বাড়ি যে দ্বীপে, সেটা আরও অনেক ভাল। ছেলেরা যখন বিশ্বাস করতে চাইল না, বিশেষ করে মুসা, রেগে গেল সে। বলল, দাঁড়াও না, গিয়ে নাও আগে। ওখানকার প্রবাল অ্যাটল দেখলে চোখ ফেরাতে পারবে না। ওরকম কোথায় পাবে তোমাদের এই হাওয়াই? চওড়া বাদামি কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাওয়াইকে বুড়ো আঙুল দেখল দক্ষিণ দ্বীপবাসী।
।নতুন আরেকটা ডিঙি কিনে তোলা হল স্কুনারে। তারপর আবার রওনা হল শুকতারা।
মারশাল দ্বীপপুঞ্জের ছোট-বড় অসংখ্য দ্বীপের কাছাকাছি এসে তাজ্জব হয়ে গেল ছেলেরা। জলজ জীবের ছড়াছড়ি এখানকার পানিতে। তাকালেই চোখে পড়ে। জাহাজের পেছন পেছন দল বেঁধে আসছে ডলফিন। শাঁ করে জাহাজের পাশ কাটিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ফিরে আসছে আবার। লং জাম্প দিচ্ছে, হাই জাম্প দিচ্ছে, যেন একেকটা ভড়।
মস্ত এক স্পার্ম তিমি পুরো একটা দিন সঙ্গী হয়ে রইল শুকতারার।
আরেক দিন এল একটা হোয়েল শার্ক বা তিমি-হাঙর, জাতে ওটা হাঙরই, কিন্তু তিমির মত বড়। কুৎসিত চেহারা হলেও জীবটা নিরীহ, সমগোত্রের অন্যান্য প্রজাতির মত রক্তপিশাচ নয়। খেলার ছলে মাঝে মাঝেই এসে ধাক্কা মারল জাহাজের গায়ে।
রবিন জানে, জীবটা নিরীহ। ক্যাপ্টেন কলিগও বার বার বলেছে একথা। কিন্তু চেহারা এমনই বাজে তিমি-হাঙরের, ভুলতে পারেনি সে। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছে। আতঙ্কে চেঁচাতে শুরু করল ঘুমের মধ্যে। জেগে উঠে দেখল ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। বদ্ধ কেবিনে দম বন্ধ হয়ে এল তার। খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে উঠে এল ডেকে।
রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রাতের সাগর দেখছে মুসা। ফিরে তাকাল। কি হল, ঘুম আসছে না?
এসেছিল, হেসে বলল রবিন। তিমি-হাঙরে গিলতে এল, তাই জেগে উঠে পালিয়ে এসেছি।
চকচক করছে রাতের সাগর, যেন একটা রূপালি চাদর। এর কারণ কোটি কোটি প্ল্যাঙ্কটনের সমষ্টি, ওগুলোর শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হয় একধরনের উজ্জ্বল আভা।…
জাহাজের পেছনে জাল বাধাই রয়েছে। তাতে ধরা পড়ছে নানারকম বিচিত্র প্রাণী। বদমেজাজী একটা কংগার ইল ধরা পড়ল অবশেষে। তারপর একটা তলোয়ার মাছ।
মাছটাকে নিয়ে সমস্যা হল। ওপরের ঠোঁটে লাগানো মারাত্মক তলোয়ারের জন্যেই মাছটার এই নামকরণএই অস্ত্র দিয়ে ইচ্ছে করলে এক খোঁচায় নৌকার তলা এফোঁড় ওফোড় করে দিতে পারে প্রাণীটা।
ধরার পর যথারীতি নিয়ে ট্যাংকে রাখা হল তলোয়ারকে। কিন্তু এক ঘন্টা যেতে না যেতেই জেল থেকে ছাড়া পাবার প্রয়াসে ট্যাংকের দেয়াল ফুটো করে দিল ওটা। সব পানি পড়ে যেতে লাগল। পানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর চোখে পড়ল ব্যাপারটা। শুকনো ট্যাংকের তলায় পড়ে খাবি খাচ্ছে তখন বন্দি। তাড়াতাড়ি পাম্প ছেড়ে আবার পানি ভরে বাঁচানো হল তাকে। ফুটোটাও বন্ধ করা হল অনেক। চেষ্টা করে। কিন্তু আবার ঘটতে পারে ওরকম ঘটনা। কি করা যায়?
বুদ্ধিটা বাতলাল রবিন। বক্সিং গ্লাভস পরিয়ে দিলে কেমন হয়?
ইদানীং বক্সিং প্র্যাকটিস করছে মুসা। কয়েক জোড়া গ্লাভস কিনেছে। একজোড়া অন্তত সঙ্গে নিয়ে যায় যেখানেই যায়।
কেবিনে গিয়ে গ্লাভস বের করে আনল মুসা। রবিন আনল একটা থিমবল।
মুচকি হেসে ঠাট্টার সুরে বলল জামবু, এসব দিয়ে ওই তলোয়ার ঠেকাবে নাকি?
জবাব দিল না কেউ।
থিমবলটা বেশ বড়, নাবিকরা ব্যবহার করে এই জিনিস। দরজিরাও আঙুলে পরে, তবে ওগুলো ছোট। তলোয়ার মাছের তলোয়ারটা শক্ত করে চেপে ধরতে বলল রবিন। মুসা ধরলে, থিমবলটা তলোয়ারের মাথায় পরিয়ে দিল সে। গ্লাভস পরাল তার ওপর। তলোয়ারের মাথায় ছুরি দিয়ে ছোট একটা খাজ কেটে গ্লাভসের ফিতে শক্ত করে গিঁট দিয়ে বাঁধল। ব্যস, আর ছুটবে না গ্লাভস।
কয়েকবার ঝাড়া দিয়ে অস্বস্তিকর এই জিনিস খুলে ফেলার চেষ্টা করল। তলোয়ার। ব্যর্থ হয়ে শেষে খোঁচা মারতে শুরু করল ট্যাংকের দেয়ালে। লাভ হল না।
এতে আরও রেগে গেল তলোয়ার। চারশো পাউণ্ড শরীরটা নিয়ে বার বার গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল ট্যাংকের দেয়ালে। আঘাতের পর আঘাত হানল তলোয়ার দিয়ে। কিন্তু আগায় গ্লাভস আর থিমবল নিয়ে অস্ত্র এখন বাতিল। দূর, মরুকগে, বলেই যেন সরে এল তলোয়ার। নতুন মাছ ছাড়া হয়েছে ট্যাংকে। মহানন্দে সদ্ব্যবহার শুরু করল সেগুলোর।
ডাঙা! ডাঙা! কাকের বাসা থেকে চেঁচিয়ে বলল কুমালো।
কপালে হাত রেখে ভালমত তাকাল কলিগ। হ্যাঁ, ডাঙাই মনে হচ্ছে।
তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ব্যথা করে ফেলল তিন গোয়েন্দা, কিন্তু ডাঙা চোখে পড়ল না ওদের। দেখল অদ্ভুত এক দৃশ্য। একেবারে দিগন্তরেখার কাছে সবুজ, উজ্জ্বল একটুকরো মেঘ। না, মেঘ বলা বোধহয় ঠিক না, বরং বলা উচিত উজ্জ্বল একধরনের সবুজ আভা।
সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের কালে অনেক সময় সবুজ আভা চোখে পড়ে সাগরের আকাশে, কিন্তু এই মাঝ সকালে ওই সবুজ রঙ কিসের?
যেন জ্বলছে রঙটা। একবার মনে হচ্ছে সবুজ আগুনের শিখা, একবার সবুজ মেঘ, তারপর আবার সবুজ পানির ঢেউ। গায়েব হয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে আবার আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে।
ব্যাপারটা কি! তাজ্জব হয়ে দেখছে কিশোর। বুঝতে পারছে না।
কাকের বাসা থেকে নেমে এসেছে কুমালো। কিশোরের বিস্ময় দেখে হাসল। ওটা বিকিনি অ্যাটল। দেখা যাচ্ছে না এখনও, আকাশের ওই সবুজ রঙ দেখে বুঝেছি।
জ্বলছে কেন? আলোর কারসাজি। ধবধবে সাদা বালিতে ঢাকা ওখানকার ল্যাগুনের তলা। রঙিন প্রবাল আছে অনেক। পানির গভীরতাও মাঝে মাঝে খুব কম। সব কিছু মিলিয়ে ওখানকার পানির রঙ হয়ে গেছে হালকা সবুজ, ওটারই ছাপ পড়েছে আকাশে। মরীচিকাও বলতে পার। দ্বীপটা দেখার আগে অন্তত ছসাত ঘন্টা ধরে দেখা যাবে ওই মরীচিকা।
শেষ বিকেলে দিগন্তে উদয় হল বিকিনি। নারকেল বীথির মাথা দেখা যাচ্ছে শুধু, নিচটা এখনও অদৃশ্য। এগিয়ে চলেছে জাহাজ। রেলিঙে দাঁড়িয়ে অ্যাটলের সৌন্দর্য দুচোখ দিয়ে পান করছে যেন তিন গোয়েন্দা। এই প্রথম দেখছে প্রবাল অ্যাটল।
দূর থেকে মনে হয়, মুক্তার একটা হার যেন অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে নীল চাঁদরের বিছানায়। ওটা আর কিছু না, ল্যাগুনকে ঘিরে রাখা বিশাল প্রবাল প্রাচীর। সগর্জনে দেয়ালে আছড়ে পড়ে সাদা ফেনা সৃষ্টি করেছে ঢেউ, কিন্তু দেয়ালের ভেতরে ঢোকার অধিকার আদায় করতে পারছে না কিছুতেই। ভেতরের পানি শান্ত, স্থির, আকাশের রঙের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলাচ্ছে। সাগরের মধ্যিখানে যেন দেয়ালে ঘেরা এক মস্ত হ্রদ। কলিগ জানাল ল্যাগুনটা বিরাট, বিশ মাইল চওড়া।
এতবড় প্রাচীরটার স্রষ্টা প্রবাল নামের এক অতি ক্ষুদ্র কীট। বীজ, ফল, উদ্ভিদের চারা ভেসে ভেসে গিয়ে ঠেকেছে ওই প্রাচীরে, আটকে গেছে পচা প্রবাল আর বালিতে। ফলে যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে মোহনীয় সবুজ দ্বীপ। সাদা প্রবাল পাথরের মাঝে ফুটে উঠেছে সবুজ।
এসব দ্বীপের কোনটা খুবই ছোট, বড় জোর ওদের স্কুনারটার সমান। কোন কোনটা আবার বেশ বড়, মাইলখানেক লম্বা। তবে চওড়ায় অনেক কম। সব চেয়ে বড়টাও মাত্র কয়েকশো গজ।
তিনটে জায়গায় ফাঁক আছে দেয়ালে। ওগুলো দিয়ে জাহাজ ঢোকানো সম্ভব। দক্ষিণ-পুবের পথটার দিকে এগিয়ে গেল শুকতারা। ভালই চলছিল, হঠাৎ পড়ে গেল বাতাস। ঘুরে গেল জাহাজের নাক। পাশ থেকে ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে শুরু করল ঢেউ। ভীমগর্জনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গায়ে। দেয়ালের ফাঁক দিয়ে তীব্র গতিতে ঢুকছে জোয়ারের পানি। পরস্পর বিরোধী স্রোতের মাঝে পড়ে প্রায় নাকানিচোবানি খেতে শুরু করল জাহাজটা।
অভিজ্ঞ নাবিক ক্যাপ্টেন কলিগ। দক্ষ হাতে জাহাজের হুইল ধরে ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিল শুকতারাকে। পরিশ্রম করতে হল অনেক, কিন্তু নিরাপদেই অবশেষে জাহাজটাকে নিয়ে এল ল্যাগুনের ভেতরে। শান্ত নিথর পানিকে মনে হচ্ছে এক বিশাল সবুজ আয়না। নারকেল গাছে ছাওয়া ছোট্ট একটা দ্বীপের সাদা সৈকত থেকে একরশি দূরে নোঙর ফেলা হল।
গভীর মনোযোগে ক্যাপ্টেনের চার্ট দেখছে কিশোর। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, এই প্রবাল প্রাচীরে দ্বীপ মোট বিশটা। সব চেয়ে কাছেরটার নাম এনিও। তারপরে রয়েছে বিকিনি, অ্যাওমোয়েন, ন্যামু, রুকোজি, এনিরিকু। আরেকটা আছে, নাম উচ্চারণ করতে গেলে চোয়াল ভাঙার অবস্থা—ভোকোরোরাইওরো।
উত্তর-পূর্ব কোণে একটা ক্রসচিহ্ন। ম্যাপে দেখানো ল্যাগুনের ওই জায়গায় আঙুল রেখে কিশোর জিজ্ঞেস করল, এখানে কি?
আণবিক বোমার পরীক্ষা হত ওখানে, জবাব দিল ক্যাপ্টেন। রেডিও অ্যাকটিভিটির ভয় নেই?
নাহ, এখন আর নেই। শেষ পরীক্ষা হয়েছে ঊনিশশো ছেচল্লিশ সালে। তেজস্ক্রিয়তায় ছেয়ে গিয়েছিল তখন সবকিছু, মাটিতে, নারকেলে, এমনকি মাছেও। অনেক পরে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে ঘোষণা দিয়েছেন, তেজস্ক্রিয়তা কমে গেছে। এখন আর মানুষের জন্যে তেমন ভয় নেই, যদি বেশিদিন না থাকে এখানে।
স্থানীয় অধিবাসীদের কি হল? পরীক্ষার আগে নিশ্চয় ছিল ওরা?
ছিল, একশো পঁষট্টি জন। তাদের রাজার নাম জুডা। রংগারিক আইল্যাণ্ডে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল ওদের, এখান থেকে একশো তিরিশ মাইল পুবে।
কাজটা উচিত করেনি। বাপদাদার জায়গা থেকে তাদেরকে সরিয়ে দিয়ে। নতুন জায়গায় গিয়ে মানিয়ে নিতে নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়েছে।
খুর। মানাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। রংগারিকে মাছ নেই, ফলের গাছও খুব কম। শেষে বাধ্য হয়ে আমেরিকান নেভির কাছে আবেদন করেছে রাজা, তাদের খাবার ব্যবস্থা করার জন্যে। তাই ওখান থেকেও সরাতে হয়েছে ওদেরকে, উজিলং আইল্যাণ্ডে।
এখন তাহলে ওখানেই আছে?
আছে। তবে সুখী নয়। তাদের শত শত বছরের পুরানো জীবনধারা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। উজিলাংও এখানকার তুলনায় ভাল না। খাবারের জন্যে তাদের নির্ভর করতে হয় আমেরিকান নেভির ওপর। ফলে জীবনের ওপরই ঘেন্না ধরে গেছে ওদের।
দুঃখজনক। বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকেই অনেক শয়তানী করেছে। এখনও কি কোন পরীক্ষা চলছে নাকি এখানে?
বলা কঠিন। তবে এখন বেশি পরীক্ষা চলছে এনিউইটক অ্যাটলে, এখান থেকে দুশো মাইল পশ্চিমে। ওটার পাশ দিয়েই যাব আমরা।
ওখানকার আদিবাসীদেরও নিশ্চয় দেয়া হয়েছে?
হয়েছে। একশো সাতচল্লিশ জন। নীল চোখের চারপাশে রোদে পোড়া চামড়া হাসিতে বঁচকে গেল ক্যাপ্টেনের। আরি, কেঁদে ফেলবে নাকি! সাধারণ কয়েকটা কানাকা। সব সময়ই শাসন করা হয়েছে ওদের, ভবিষ্যতেও করা হবে।
ভারতবর্ষ আর আফ্রিকায় ইংরেজ শাসনের ইতিহাস মনে পড়ল কিশোরের। কঠিন একটা কথা চলে এসেছিল মুখে, অনেক কষ্টে সামলাল।
ডিঙি নামিয়ে তীরে উঠল সবাই। অনেক দিন পর পায়ের তলায় মাটি বেশ ভাল লাগল। দ্বীপ না বলে ওটাকে চমৎকার একটা বাগান বলা উচিত। তেজস্ক্রিয়ায় কোন এক সময়ে গাছপালার ক্ষতি হয়ে থাকলেও এখন তার চিহ্ন নেই। মানুষের ভয়াবহ আঘাত সামলে নিয়েছে প্রকৃতি।
পুরো দ্বীপটা ঘুরে আসতে মাত্র আধঘন্টা সময় লাগল। রাতে খাবার খেল অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে। কিশোর লক্ষ্য করল, বারবার সৈকতে চলে যাচ্ছে কুমালো, কি জানি, বোধহয় ল্যাগুনে রাতের স্তব্ধ আকাশ ভাল লাগছে। গত কয়দিনে লোকটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে তার। শান্ত, হাসিখুশি। সাহস, ধৈর্য, সবই আছে লোকটার। স্কুনার চালানো দেখেই বোেঝা যায় জাত নাবিক। পছন্দের জায়গায় এসে কেমন লাগছে এখন তার?– খুব জানতে ইচ্ছে হল কিশোরের।
আগুনের ধার থেকে উঠে সৈকতে রওনা হল সে। একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে ল্যাগুনের দিকে তাকিয়ে আছে কুমালো। পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর, কিন্তু নীরবতা ভাঙতে ইচ্ছে হল না। চুপ করে রইল।
ল্যাগুনটা এখন কালো। দিনে ছিল সবুজ, এখনকালো আয়নার মত। তাতে আকাশের প্রতিবিম্ব। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নীলচে-সাদা অভিজিৎ নক্ষত্র, হলদে স্বাতীনক্ষত্র, আগুন-লাল অ্যানটারিস। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই উঠবে সাদার্ন ক্রস, রকিবীচের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট দেখা যাবে এখানে, কারণ বিষুবরেখার কয়েক ডিগ্রি উত্তরে রয়েছে এই বিকিনি।
প্রবাল প্রাচীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের চাপা গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ল্যাগুনের ওপাশে অন্যান্য দ্বীপগুলো সব অন্ধকার।
আমার বাবা একবার এসেছিল এখানে, বহুদিন আগে, কথা বলল কুমালো। শুনেছি, তখন মানুষ থাকত এখানে। দ্বীপে আনন্দ ছিল। এখন নেই।
নিশ্চয় অ্যাটম বোম…
হ্যাঁ…
পাশাপাশি বসল ওরা। এই সময় মুসা আর রবিনও এসে বসল ওখানে।
কুমালো, কিশোর বলল। এত ভাল ইংরেজি কোথায় শিখলে তুমি? এদিকের লোকে তো ভাল ইংরেজি জানে না শুনেছি।
হাসল কুমালো। তারার আবছা আলোতেও চকচক করে উঠল তার সাদা দাঁত। আমার ইংরেজি তোমার পছন্দ হয়েছে? খুশি হলাম। এক আমেরিকান মিশনারি মহিলার কাছে লেখাপড়া শিখেছি। খুব ভাল মানুষ ছিলেন তিনি। যত্ন করে কত কিছু শিখিয়েছেন আমার দেশের লোককে। ভাল বিদেশী খুব কমই যায় ওখানে।
কুমালো কি বলতে চায়, বুঝল কিশোর। ইউরোপিয়ান আর আমেরিকানরা আগে দক্ষিণ সাগরের দ্বীপগুলোতে আসত নারকেলের ছোবড়া আর মুক্তার লোভে, করুণা খুব কমই মিলত তাদের কাছে। স্থানীয় অধিবাসীদের মাঝে ওরা ছড়িয়েছে মারাত্মক রোগ, শিখিয়েছে কড়া মদে নেশা করা, খুন করেছে পাইকারি হারে, নির্মমভাবে, কারণ ওদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র।
গত কয়েক দিনে একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেছে সে, ক্যাপ্টেন আর জামবু দেখতে পারে না কুমালোকে। তারমানে ওদের দলে নেই লোকটা। তথ্য বের করার জন্যে বলল, কুমালো, তোমার দেশের কথা বল।
শুনবে! অবাক মনে হল দ্বীপের বাসিন্দা মানুষটাকে। আমাদের কথা শুনবে তুমি?
বল, রবিন বলল।
অনেক কথাই বলল কুমালো। ওদের সমাজের অনেক কিছু জানল ছেলেরা। বন্ধুত্ব পাতানোর অদ্ভুত একটা রীতি রয়েছে ওখানকার দ্বীপগুলোতে। বন্ধুকে বন্ধু বলে না ওরা, বলে রক্তে-পাতানো-ভাই। এক বন্ধুর জন্যে আরেক বন্ধু নির্দ্বিধায় জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
শুনতে শুনতে হঠাৎ বলে উঠল মুসা, কুমালো, আমার সঙ্গে নাম বিনিময় করবে তুমি?
আবেগে গলা রুদ্ধ হয়ে এল কুমালোর। তারার আলোয় দেখা গেল তার বাদামি গালে চিকচিক করছে পানির ধারা, দুগাল বেয়ে নেমেছে অশ্রু। আচমকা বিশাল দুই থাবার মধ্যে চেপে ধরল মুসার একটা হাত। নিশ্চয় করব, মুসা! আমার হৃদয়ে আমি এখন মুসা, তোমার হৃদয়ে তুমি কুমালো। তুমি আমার রক্তেপাতানো-ভাই। একজনের জন্যে আরেকজন দরকার হলে জীবন দিয়ে দেব আমরা। ইতিমধ্যেই সেটা তুমি করতে চেয়েছে নিজের জীবনের পরোয়া না করে হাঙরের মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছ আমাকে।