৭. কয়েক দিন সাগরে কাটিয়ে

0 Comments

কয়েক দিন সাগরে কাটিয়েও আশ মিটিয়ে সাঁতার কাটতে পারেনি সাগরপাগল মুসা আমান। প্রথম সুযোগটা পেয়েই তার সদ্ব্যবহার করতে ছাড়ল না। পরদিন সকালে জামাকাপড় খুলে ডাইভ দিয়ে পড়ল পানিতে।

দেখে হাসল রবিন আর কিশোর কুমালো, জামবু আর ক্যাপ্টেনকে নিয়ে প্রবাল প্রাচীরের কিনার ধরে হেঁটে চলল ওরা।

চলতে চলতে থেকে থেকেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কিশোর। উঁকি দিয়ে দেখছে পানিতে। ধরার মত কিছু মেলে কিনা দেখছে। অল্প পানিতে একটা অক্টোপাসের বাচ্চা চোখে পড়ল। আরেকটা। তারপর আরেকটা। খুব ছোট ছোট, বাসনের সমান। কয়েকটা ধরল কুমালো। জানাল, খেতে নাকি দারুণ লাগে, বিশেষ করে অক্টোপাসের শুড়ের কাবাব।

মুসা ওদিকে শুরু করেছে তুমুল দাপাদাপি। ডুবছে, ভাসছে। দেখলে এখন মনে হবে পানিরই ছেলে সে, পানিতে তার ঘর। কয়েকবার ডুবে, ভেসে শরীরটাকে গরম করে নিয়ে সাঁতরে চলে এল অপেক্ষাকৃত গভীর পানিতে। খাড়া ডুব দিয়ে চলে এল বারো-তেরো ফুট নিচে। চোখ দিয়ে যেন গিলছে প্রবালের। অপূর্ব রূপ। পানির নিচ দিয়েই সাঁতরে চলে এল দেয়ালের কাছে। ভাসল। লম্বা দম। নিয়ে আবার ডুব দিল।

দেয়ালের এক জায়গায় একটা ফোকর চোখে পড়ল। ঢুকে পড়ল ওটার ভেতরে। একটা সুড়ঙ্গ। ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে সাঁতরে চলে এল পানির তলার একটা গুহায়। সূর্যের আলো এসে পড়েছে প্রবালের গায়ে, প্রতিফলিত হয়ে মিষ্টি কোমল নীল আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে গুহাটা। এই সৌন্দর্য বর্ণনা করা কঠিন, যেন এক পরীর রাজ্যে চলে এসেছে সে। অসাধারণ শিল্পীর পরিচয় রেখেছে এখানে। প্রবালকীট। দেয়াল জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে ওদের রঙিন শিল্পকর্ম। শুধু রঙ আর রঙ, নীলসাদা, গোলাপী, সবুজ, চোখ জুড়িয়ে যায়।

দম ফুরিয়ে আসছে। পরীর বাগান দেখার জন্যে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না মুসা। সাঁতরে বেরিয়ে আসতে যাবে, এই সময় লক্ষ্য করল, ছাতটা পানির ওপরে। মাঝে ফাঁকা। তারমানে বাতাস আছে। না-ও থাকতে পারে, একথাটা একবারও মনে এল না তার। ভুস করে মাথা তুলল। ফাঁক বেশি না। কাঁধ পর্যন্ত ভাসাতে পারল সে।

হঠাৎ একটা দুষ্টবুদ্ধি মাথাচাড়া দিল মনে। যদি এখন না ফেরে, দেরি করে যায়, কি ঘটবে? সবাই তাকে ডুব দিতে দেখেছে। ভেসে না উঠলে ওরা ভাববে ডুবে মরেছে সে। পানিতে নেমে খোঁজাখুঁজি করবে তাকে। তবে পাওয়ার আশা কম। কারণ সে রয়েছে গুহার ভেতরে।

ওরা যখন তাকে মৃত ধরে নিয়ে হাহুতাশ শুরু করবে, তখন ভাসবে সে। বুঝতে পারবে, সত্যি সত্যি সে মারা গেলে কিশোর, রবিন, কুমালো কে কতটা শোক করবে।

নাক উঁচু করে ভেসে আছে মুসা। সহজেই শ্বাস নিতে পারছে। তারমানে প্রবালের মাঝে সূক্ষ্ম ছিদ্র রয়েছে, অনেকটা স্পঞ্জের মত, সেই ছিদ্রপথে গুহায়। ঢুকছে বাতাস।

ওপরে চেঁচামেচি শুরু হল, গুহায় থেকেই শুনতে পাচ্ছে মুসা। পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার শব্দ হল।

দশ মিনিটের মাথায় লম্বা দম নিয়ে ডুব দিল সে। বেরিয়ে এল গুহা থেকে। ভাসল না। ডুব সাঁতার দিয়ে সরে এল প্রায় বিশ গজ দূরে। পানির কিনারে ওখানে জন্মে আছে একগুচ্ছ নারকেল গাছ। আস্তে পানি থেকে উঠে ওটার ভেতরে ঢুকে বসে রইল সে।

কানে এল কিশোরের কথা, কি করে যে গিয়ে ওর বাবাকে বলব! হায় হায়রে, কেন যেতে দিলাম! কেন মানা করলাম না!

ক্যাপ্টেন বলল, বেচারা! ছেলেটা ভাল ছিল। সত্যি দুঃখ হচ্ছে ওর জন্যে।

রবিন বলল, কেঁদে কেঁদেই মরে যাবে ওর মা!

আমাদের তিন গোয়েন্দাগিরি এখানেই শেষ! আফসোস করল কিশোর। মুসাকে ছাড়া কিছুই করতে পারব না আমরা।

জামবুও দুঃখ প্রকাশ করল। আন্তরিক কিনা বোঝা গেল না যদিও।

কুমালো নেই ওখানে। খানিক পরে উঠে এল পানি থেকে। বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছে, মিশনারি মহিলার কাছেই শিখেছে নিশ্চয়। কিশোরের কাঁধে হাত রেখে কাঁদো কাঁদো গলায় সান্ত্বনা দিল, দুঃখ কোরো না। যে মরে গেছে, তার জন্যে আফসোস করতে নেই, তাহলে তার আত্মার অকল্যাণ হয়, পাখিকে শেখানো বুলি ঝাড়ছে যেন। আবার ওর সঙ্গে দেখা হবে আমাদের। স্বর্গে…

আর থাকতে পারল না মুসা। হো হো করে হেসে উঠল। বেরিয়ে এল নারকেল গাছের আড়াল থেকে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সবাই। কুমালো হাসল। রবিনও। কিশোর গম্ভীর। শুধু বলল, কাজটা ভাল করনি।

ছিলে কোথায় এতক্ষণ? রবিন জিজ্ঞেস করল। গাছের আড়ালেই?

না, কয়েক মিনিট ধরে আছি। এর আগে পানিতেই ছিলাম।

এতক্ষণ?

বিশ্বাস না হলে আবার দেখ। প্রমাণ করে দিচ্ছি। যতক্ষণ বল ততোক্ষণ পারব।

ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ল মুসা।

আবার গুহায় ঢুকল। মোটা সাপের মত কি যেন একটা পড়ে আছে মেঝেতে। ওটার আরেক মাথা গিয়ে ঢুকেছে গুহার দেয়ালে একটা কালো বড় ফোকরে। শ্বাস নেয়ার জন্যে ভেসে উঠল সে। দম নিয়ে সাপের মত জিনিসটা ভালমত দেখার জন্যে আবার ডুব দিল সে। পরিষ্কার দেখা যায় না। কারণ একটা জিনিসেরই একেক জায়গায় একেক রকম রঙ। পটভূমি, অর্থাৎ যেটার ওপর পড়ে আছে তার যে-রকম রঙ ঠিক সে-রকম। যেখানে প্রবালের রঙ লাল, সেখানে ওটাও লাল, যেখানে নীল সেখানে নীল, সাদা হলে সাদা, কালো জায়গা কালো।

এইসময় একই রকম আরেকটা সাপ চোখে পড়ল তার। তারপর আরও দুটো। সব কটাই গিয়ে ঢুকেছে সেই কালো ফোকরে।

কি আছে কালো গর্তটার ভেতরে? আরও কাছে গিয়ে দেখার পর নজরে পড়ল। কালো গর্তের মতই কালো একটা জিনিসের অর্ধেক বেরিয়ে আছে ফোকরের বাইরে, বাকি অর্ধেক ভেতরে। ফোলা একটা বস্তার মত। দুটো চোখও লাগানো বস্তার গায়ে। ছোট ছোট চোখ, শয়তানি ভরা তির্যক চাহনি, তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ভয়ের ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। আশেপাশের রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে ঘাপটি মেরে রয়েছে ওটা, শিকারের জন্যে ওত পেতেছে। বিশাল এক অক্টোপাস!

অবাক নয় সে, আতঙ্কিত। বোঝা উচিত ছিল, অল্প পানিতে যখন অসংখ্য বাচ্চা রয়েছে, বুড়োটাও রয়েছে কাছাকাছি কোঞ্চও। কল্পনাই করেনি গুহার মধ্যে বসে আছে ওটা।

আস্তে ভেসে উঠে ফুসফুস ভর্তি করে বাতাস নিল মুসা। জানে, সময়মত বেরোতে না পারলে, জানোয়ারটার সঙ্গে হাতাহাতি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লে অক্সিজেন দরকার হবে। পানিতে সামান্যতম আলোড়ন না তুলে আবার ডুব দিল সে। সোজা এগোল সুড়ঙ্গের দিকে। সরে যাচ্ছে…যাচ্ছে…আর একবার পা নাড়া, তাহলেই ঢুকে যাবে সুড়ঙ্গে…

ঠিক এই সময় আলতো করে তার গোড়ালি জড়িয়ে ধরল কোন কিছু। খুব দ্রভাবে টেনে নেয়া হতে লাগল তাকে গুহার ভেতরে। ছাড়ানোর জন্যে ঝাড়া মারল সে, ছুটতে পারল না। ধরেছে নরমভাবে, কিন্তু বাঁধন ভীষণ শক্ত।

ছুরির জন্যে হাত বাড়াল মুসা। ধক করে উঠল বুক। নেই! মনে পড়ল, প্যান্টের বেল্টে আটকানো রয়েছে ছুরির খাপ, কাপড় খোলার সময় ওটা খুলে রেখে এসেছে সৈকতে।

দুহাতে ধরে তঁড়টা ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে। চ্যাপ্টা হুঁড়, পেটের দুই কিনারে দুই সারি সাকশন কাপ। চামড়া থেকে ওগুলোর তীব্র আকর্ষণ ছুটানোর সাধ্য তার হল না। বরং টের পেল, আরেক হুঁড় দিয়ে আরেক পা জড়িয়ে ধরা হচ্ছে, তৃতীয় আরেকটা ঔড় খুঁয়োপোকার মত তিরতির করে হেঁটে যাচ্ছে কাঁধের ওপর দিয়ে।

সাহায্যের জন্যে চিৎকার শুরু করল মুসা। এখন হয়ত তার মাথার ওপরেই রয়েছে সবাই, তার বেরোনোর অপেক্ষা করছে, তাকিয়ে আছে পানির দিকে। তার ডাক ওদের কানে গেলে নিশ্চয় দেখতে আসবে।

চিৎকার করায় অতি মূল্যবান অক্সিজেনের অনেকটাই বেরিয়ে গেল ফুসফুস থেকে। আর আধ মিনিটের মধ্যে যদি দম নিতে না পারে, জ্ঞান হারাবে। শুড় ছাড়ানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রাণপণে গুহার ওপরে ভেসে উঠতে চাইল সে। দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে থাকা প্রবাল ধরে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করল শরীরটা।

ভারি একটা শুড়ের চাপ রয়েছে কাধে। ওটা কিছুতেই সরাতে পারল না সে। শেষে মরিয়া হয়ে কাধ নিচু করে চোখা প্রবালে ঘষা মারল শুড়টা।

গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস, একেবারে মানুষের মত। কাঁধের ওপর শুড়ের চাপ কমার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়া দিয়ে ওটাকে নামিয়ে দিল মুসা দুই পায়ের বাঁধন আগের মতই রয়েছে। তবু কাধ থেকে শুড়টা সরাতে পারায় ভেসে উঠে দম নেয়া সম্ভব হল।

তারপর শুরু করল চিৎকার। গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল, কিশোর! রবিইন! দোহাই তোমাদের! আমাকে বের কর! অক্টোপাসে ধরেছে!… কুমালোওওও…

চেঁচিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলল সে। কোন সাড়া এল না।

ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে চাইল তার, ভয়ে। রসিকতা করেছে ওদের সঙ্গে একটু আগে। ওরা হয়ত ভাবছে আবার নতুন কোন রসিকতা। মনে পড়ল সেই মেষ পালকের কথা। বাঘ এসেছে! বাঘ এসেছে! বলে অযথা। চেঁচিয়ে সত্যি সত্যি বাঘ যখন এল কেউ এল না তাকে সাহায্য করতে পায়ে টান লাগল।

কিশোওর! দোহাই তোমাদের! প্রায় কেঁদে ফেলল মুসা। আল্লার কসম, অক্টোপাস…

কথা শেষ করার আগেই টান মেরে পানির তলায় নিয়ে গেল তাকে জীবটা। এগিয়ে এল বাকি গুঁড়গুলোও। এক এক করে জড়িয়ে ধরতে লাগল কাঁধ, বুক, পেট।

আমাজানের জঙ্গলের বোয়া-কনসট্রিকটরের কথা মনে পড়ল। ভয়ঙ্কর সাপ। একেকটা শুড়কে একেকটা সাপ বলে মনে হল এখন, তারমানে মোট আটটা সাপ। একযোগে আক্রমণ করেছে। শক্ত হচ্ছে চাপ, আগের মত আলতো ভাব আর নেই। পেট বসে যাচ্ছে চাপের চোটে, হাঁসাস করছে ফুসফুস, পাগল হয়ে এলোপাতাড়ি বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ড।

ছায়া নামল এই সময় গুহার ভেতরে, সূর্যকে মেঘে ঢেকে দেয়ায় রোদ পড়ে গেল যেন। তারমানে সুড়ঙ্গে ঢুকেছে কেউ, আলো আসায় বাধা পড়েছে। আশার আলো জ্বলল মুসার মনে। নিশ্চয় কুমালো! অনেক কষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল, সে, কে এসেছে দেখার জন্যে। কুমালো নয়, সুড়ঙ্গমুখে দেখা দিল মস্ত এক হাঙ্গরের মাথা, টাইগার শার্ক। রক্তের গন্ধ পেয়ে গেছে সাগরের কসাই। প্রবালের ঘষায় মুসার শরীরের কয়েক জায়গা কেটে রক্ত বেরোচ্ছে।

অনাহূত আগন্তুককে দেখেই রেগে লাল হল অক্টোপাস। ঢিল হল শুড়ের বাঁধন। সত্যি সত্যি লাল রঙ এখন শরীরের।

এমনিতেই ফোলা ঢোল, পানি টেনে নিয়ে আরও ফুলে পিপা হয়ে যেতে লাগল বস্তার মত শরীরটা। হঠাৎ বেরিয়ে গেল টেনে নেয়া সমস্ত পানি, শত্রুর দিকে টর্পেডোর মত ছুটে গেল অক্টোপাস। এত জোরে গেল, ওটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হেরে গেল মুসার দৃষ্টি।

জেট প্লেন বা রকেটের সঙ্গেই শুধু তুলনা করা চলে ওই গতিকে। ব্যতিক্রম শুধু, ওগুলোর পেছনের ফুটো দিয়ে বেরোয় গ্যাস, আর এটার বেরোল পানি। শুড়গুলো লম্বা হয়ে ছুটে গেল বস্তাশরীরের পেছনে, যেন ধূমকেতুর পেছনে তার ছড়ানো ফোলা লেজ।

আটটা শুড়ের শতশত সাকশন কাপ দিয়ে কষে চড় লাগাল অক্টোপাস বেহায়া মাছের গায়ে যত্রতত্র। ব্যাটা, আমার শিকার ছিনিয়ে নিতে আস! এত্তো সাহস! বেরিয়ে গেল হাঙর। ছাড়ল না অক্টোপাস। সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়েই রুখে দাঁড়াল বাঘা হাঙরের বাচ্চা, সে-ও কম শক্তিশালী নয়। গুহার ভেতরে জায়গা কম, নড়তে চড়তে অসুবিধে, তাই বের করে নিয়ে গেছে অক্টোপাসটাকে।

সুড়ঙ্গের এপাশে থেকে ওপাশে ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছে মুসা, পলকের জন্যে মাঝে মাঝে শুধু চোখে পড়ছে পাখনা কিংবা শুড় নড়ানো। দৃষ্টি আরও অচল হয়ে গেল, যখন কালির থলে থেকে একরাশ কালো কালি ছুঁড়ে মারল অক্টোপাস। পানিতে কালো মেঘের মত ছড়িয়ে পড়ল কালি।

এখন বাইরে বেরোনো আত্মহত্যার সামিল। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে মুসা। প্রার্থনা করছেঃ আল্লাহ্, সরে যাক ব্যাটারা, খালি একটু দূরে সরুক! আমি  বেরোতে পারলেই হয়! আল্লাহ…

আবার চেঁচাতে শুরু করল সে। কাছাকাছি কি কেউ নেই নাকি? ভয়াবহ লড়াই চোখে পড়ছে না কারও? পানিতে ওই আলোড়ন দেখতে পাচ্ছে না?

পানিতে এখন কালি গোলা। কিছু দেখতে পাচ্ছে না মুসা। দানব দুটো আছে না গেছে, বোঝার উপায় নেই।

ঠিক করল সে, ঝুঁকি নেবে। লম্বা দম নিয়ে ডুব দিল। কিন্তু ফিরে এসে ভেসে উঠতে বাধা হল আবার। কারণ, সুড়ঙ্গমুখে চকিতের জন্যে আবছাভাবে চোখে পড়েছে বস্তা-শরীরের মুখ। ওপাশের কালো মেঘের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

একা। তাড়িয়ে দিয়ে এসেছে শত্রুকে। আট পায়ে ভর দিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাঁটছে গুহার মেঝেতে, বিরাট এক মাকড়সার মত।

শিকারের দিকে তাকিয়ে নাচ জুড়েছে যেন। আটকা পড়া ইঁদুরকে ধরার আগে ঠিক এরকম ভাবভঙ্গিই করে বেড়াল। সারা শরীরে ওটার এখন রামধনুর সাত রঙ। কুমালো আর কলিগের কাছে জেনেছে মুসা, খুব বেশি রাগলে শরীরের রঙ ওরকম হয়ে যায় অক্টোপাসের।

আবেগ বোঝার ক্ষমতা আছে এদের। বাচ্চাকে কাছে টেনে আদর করে, শত্রু দেখলে খেপে যায়। মাছের চেয়ে অক্টোপাসের মগজ অনেক উন্নত। মানুষের মত চোখ, আর শেয়ালের মত ধূর্ত।

আবার ফুলতে শুরু করেছে ওটা। আবার চিৎকার করে সাহায্যের আবেদন জানাল মুসা। বুঝতে পারছে, সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর বড় জোর কয়েক সেকেণ্ড।

তীব্র গতিতে পানি বেরোতে লাগল বস্তার ভেতর থেকে। ছুটে এল অক্টোপাস। জড়িয়ে ধরল শিকারকে।

অন্য কেউ হলে হয়ত হাল ছেড়ে দিত এতক্ষণে, কিন্তু মুসা ছাড়ার পাত্র নয়। মরতে হলে লড়াই করে মরবে। দ্রুত ভাবনা চলেছে মাথায়। অক্টোপাসের ব্যাপারে আর কি কি বলেছিল কুমালো? সাগরের এই আতঙ্ককে খালি হাতে লড়াই করেই অনেক সময় হারিয়ে দেয় দ্বীপবাসীরা। দুই চোখের মাঝখানে রয়েছে এদের সব চেয়ে দুর্বল জায়গা, একটা বিশেষ নার্ভ সেন্টার। ওখানে আঘাত লাগলে অবশ হয়ে যায় অক্টোপাসের শরীর।

আশা হল মুসার। শুধু হারানোই নয়, এই দানবটাকে জ্যান্তই ধরে নিয়ে যেতে পারবে হয়ত সে। বড় একটা অক্টোপাস চেয়েছেন মিস্টার লিসটার। কিশোরও খুশি হবে, মুসার ওপর থেকে রাগ কমবে তার।

প্রবাল আঁকড়ে ধরে পানির ওপরে মাথা তুলে রাখল মুসা, যতক্ষণ পারল। শ্বাস টানল জোরে জোরে। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে পানির নিচে নামিয়ে নেয়া হল তাকে। কিন্তু এখন আর আগের মত আতঙ্কিত নয় মুসা। ফুসফুসে বাতাস ভর্তি, মনে দুর্জয় সাহস। এখন তাকে দেখলে ভাবতেই পারবে না কেউ, এই সেই মুসা আমান, ভূতের নাম শুনলেই যে ভয়ে কাবু হয়ে যায়। শরীর থেকে শুড় ছাড়ানোর জন্যে এখন আর ধস্তাধস্তি করছে না সে। কাজ হয় না, তাতে শক্তিই খরচ হয় অহেতুক।

ধীরে ধীরে তাকে কাছে টেনে নিচ্ছে অক্টোপাস। শয়তানি ভরা চোখ দুটোর কাছে, আরও কাছে। আফ্রিকায় রেগে যাওয়া গণ্ডার দেখেছে মুসা। গণ্ডারের কুতকুতে চোখের চাহনির সঙ্গে অক্টোপাসের চাহনির অনেক মিল।

এতক্ষণ বস্তা-শরীরের ভেতরে লুকিয়ে ছিল অক্টোপাসের চোয়াল দুটো। বেরিয়ে এল এখন। তোতাপাখির ঠোঁটের মত বাঁকা, কিন্তু অনেক অনেক বড়। প্রচণ্ড শক্তি ওই চোয়ালের, এক চাপ দিয়ে পাকা নারিকেল গুঁড়িয়ে ফেলতে পারে। মুসার মাথাটা গুড়ো করতেও এক চাপের বেশি লাগবে না।

তবু নড়ছে না মুসা।

এমন ভাব দেখাচ্ছে, দুর্বল হয়ে গিয়ে নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সে। দানবটাকে বোঝাতে হবে, হাল ছেড়ে দিয়েছে। ততো শক্ত করে আর তাকে, ধরেনি অক্টোপাসটা, ধরার দরকার মনে করছে না। এটার ওপর এত বল প্রয়োগ করে লাভ নেই। খাবারকে আস্তে আস্তে মুখের কাছে নিয়ে যাচ্ছে শুড়গুলো।

দম ফুরিয়ে এসেছে মুসার। বাতাসের জন্যে আকুলি বিকুলি করছে ফুসফুস। কিন্তু চুপ করে রইল সে। জায়গাটা কোথায়? কুমালো বলেছে, দুচোখের মাঝখানে, শরীরের সমস্ত স্নায়ু ওখানে এক জায়গায় মিলিত হয়ে একটা গুটি তৈরি করেছে, মটরদানার সমান।

হ্যাঁ, আছে, ওই তো! উঁচু হয়ে আছে, ছোট্ট ফেঁড়ার মত। মন শক্ত করল মুসা। তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে কুতকুতে চোখ দুটো। তার মনের কথা বুঝে ফেলছে না তো? পেশী ঢিল করে দিল সে।

অক্টোপাসটাও চাপ আরও কমাল। এইই সুযোগ। হঠাৎ সামনে ঝাঁপ দিল সে। দানবটার মাথা খামচে ধরে কামড় বসালো ফোঁড়াটায়।

যন্ত্রণায় মানুষের মত গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস। দুর্বল ভঙ্গিতে শরীর ঝাঁকিয়ে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করল। কালি দিয়ে কালো করে ফেলল পানি। নিয়ন্ত্রণ হারাল সাকশন কাপগুলো। মুসার শরীর থেকে খসে পড়ল সব কটা শুড়।

কামড় ছাড়ল না মুসা। চাপ দিল আরেকটু জোরে। আবার গুঙিয়ে উঠল অক্টোপাস। ধস্তাধস্তি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।

আর থাকতে পারছে না মুসা। এখুনি দম নিতে না পারলে ফেটে যাবে যেন ফুসফুস। অক্টোপাসটাকে ছেড়ে পানির ওপর ভেসে উঠল সে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ ভেসে থেকে বিশ্রাম নিল। নিচে, পানিতে নিথর হয়ে ঝুলে রয়েছে দানবটা।

মরে গেল নাকি ব্যাটা! শঙ্কিত হল মুসা। কুমালো বলেছে, জোরে এক কামড় দিয়েই মেরে ফেলা যায় এতবড় দানবকেও। বিন্দুমাত্র নড়ছে না ওটা। মরেই গেছে। বোধহয়!

দম নিয়ে ডুব দিল মুসা। একটা শুড় ধরে অক্টোপাসটাকে টেনে নিয়ে চলল গুহার বাইরে। শুড়-টুড় মিলিয়ে আকারে বিশাল হলেও ওজন ততটা নয়। তাছাড়া পানির নিচে হওয়ায় ভার আরও কমে গেছে। হাড়ও নেই শরীরে, শুধু ঠোঁটটা ছাড়া।

গুহার বাইরে বেরিয়ে তবে স্বস্তি। উজ্জ্বল রোদে আলোকিতপানি। পৃথিবীটাকে আর এত সুন্দর মনে হয়নি কখনও মুসার। আধ ঘন্টা আগে যা ছিল, তার চেয়ে অনেক জ্ঞানী মনে হচ্ছে এখন নিজেকে। কারণ খানিক আগে মৃত্যুর করাল রূপ দেখে এসেছে সে। বুঝেছে, মৃত্যু কত ভয়ঙ্কর, বেঁচে থাকা কতটা আনন্দের।

পানির ওপরে মাথা তুলল সে। ধারেকাছে কেউ নেই। সবাই দূরে। চেঁচিয়ে ডাকল সে। ফিরে তাকাল ওরা। দুহাতে তুলে ধরে একটা শুড় নাচাল মুসা। থমকে দাঁড়াল সবাই, তারপরই দৌড় দিল এদিকে।

সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কাকে ধরেছ! মরা নাকি?

মনে হয় না। জাহাজে তোলা যায় কিভাবে?

তুলো না তুলো না, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল কুমালো। পানির ওপরে তুললে রোদ লাগলেই মরে যাবে।

নৌকা আনতে গেল কুমালো। এই সময়ে সবাইকে তার কাহিনী শোনাতে লাগল মুসা। শুনতে শুনতে ফ্যাকাসে হয়ে গেল কিশোর আর রবিনের চেহারা। আর জামবুর চোখ যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে কোটর থেকে।

যাক, খুশি হলাম, ক্যাপ্টেন কলিগ বলল। দুষ্টুমি করে বটে। সাহসও আছে। এরকম ছেলেই আমার পছন্দ।

দাড় বেয়ে নৌকা নিয়ে হাজির হল কুমালো। বলল, শুড় ধরে বসে থাক কোয়। টেনে নিয়ে যাব। দেখ, পানির ওপরে না ভেসে ওঠে।

জাহাজের কিনারে ভিড়ল নৌকা। দড়ি নামিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা হল তুলতুলে শরীরটা। তারপর যত তাড়াতাড়ি পারা গেল চালান করে দেয়া হল ট্যাংকে, যতটা সল্ক রোদ বাঁচিয়ে।

ট্যাংকটা ছোট হয়ে গেল অক্টোপাসের জন্যে। শরীরটা ঠিকই আঁটে, গুঁড়গুলো। বেশি লম্বা। সোজা করা যায় না ট্যাংকের ভেতরে। বারো ফুট লম্বা একেকটা।,

কুমালো বলল, সোজা করার দরকার নেই। করে না সাধারণত। গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে।

হুঁশ ফিরছে দানবের। আলো দেখা দিল চোখ দুটোয়। শুরু হল সারা শরীরে রঙের খেলা। কিলবিল করে উঠল শুড়গুলো।

পানি খেয়ে ফুলছে বস্তা-শরীর। হঠাৎ লাফ দিল ওটা, বাড়ি খেল গিয়ে আরেক পাশের দেয়ালে। আবার লাফ দিল আরেক পাশে, বাড়ি খেল এবারও। বুঝল আটকা পড়েছে। ট্যাংকের ভেতরে ছোটাছুটি শুরু করল পাগলের মত প্রচণ্ড রাগে শেষে শুড় কামড়াতে শুরু করল।

বেশি রেগে গেলে ওরকম করে ওরা, কলিগ জানাল ধরা পড়লে কামড়ে নিজের শুড়ই খেয়ে ফেলে। শুড়-ছাড়া-অক্টোপাস বেচতে পারবে কাস্টোমারের কাছে?

শঙ্কিত হয়ে পড়ল কিশোর আর মুসা। এত কষ্ট করে ধরে এনে তাহলে লাভটা কি, শুড়ই যদি খেয়ে ফেলে?

সমস্যার সমাধান করে দিল কুমালো। বড় দেখে একটা লোহার ড্রাম এনে রাখল ট্যাংকের ভেতর, কাত করে। খোলা মুখটা রইল অক্টোপাশের দিকে।

নিমেষে রাগ দূর হয়ে গেল দানবটার। সুড়ুৎ করে গিয়ে ঢুকে পড়ল ড্রামের ভেতরে। শুড়গুলো ভেতরে গুটিয়ে নিল, যতটা জায়গা হল।

সাগরের নিচে, কুমালো বলল। অন্ধকার গর্তে বাস করে ওরা। গর্তে ঢুকলে নিরাপদ মনে করে। আর গণ্ডগোল করবে না। বাড়ি পেয়ে গেছে।

Categories: