৮. ভোর থেকেই উত্তেজিত

0 Comments

ভোর থেকেই উত্তেজিত হয়ে আছে শুকতারার যাত্রীরা। অস্বস্তিতে ভুগছে।

বিকিনি ছেড়েছে শুকতারা। এগিয়ে চলেছে পোনাপের দিকে। চমৎকার হাওয়া লাগছে পালে, সাগর শান্ত, অস্বস্তি বোধ করার কারণ নেই। তবুও করছে

ওরা,কারণ, বাতাস গরম। অসহ্য। বাষ্প মিশে রয়েছে যেন বাতাসের সঙ্গে।

নিষ্প্রাণ এই বাতাসে শ্বাস নিয়েও শান্তি নেই। বমি বমি লাগে। আকাশও নীল নয়। কেমন যেন কালচে-সাদা।

একই সাথে একটা বিশেষ কিছুর রঙ কালো আর সাদা হতে পারে না, অথচ আকাশের বেলায় তাই হয়েছে। ফ্যাকাসে কালো অন্ধকার ধীরে ধীরে চেপে আসছে যেন জাহাজের ওপর, মলিন করে দিয়েছে সবার মুখ। বেলা বাজে বারোটা, অথচ দেখে মনে হয় কাকডাকা ভোর।

বিনাকলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। হাতে সেক্সট্যান্ট। দুপুরের রীডিং নেয়ার চেষ্টা করছে। তাহলে নটিক্যাল অ্যালম্যানাকের সাহায্য নিয়ে জাহাজের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে।

খুব আগ্রহ নিয়ে ক্যাপ্টেন কলিগের কাছে নেভিগেশন শিখছে কিশোর। যেকোন কাজ জানা থাকলে অনেক সুবিধে। আর এটা জানা তো এখন তিন গোয়েন্দার জন্যে বিশেষ জরুরি, কারণ, প্রফেসর ইস্টউডের গোপন মুক্তার খামারে যেতে হবে। কখন কি ঘটে যায়, ঠিক আছে?

মনে যেন জুলজুলে অক্ষরে লেখা হয়ে আছে পজিশনটাঃ নর্থ ল্যাটিচিউড এগারো ডিগ্রি চৌত্রিশ মিনিট, ইস্ট লংগিচিউড একশো আটান্ন ডিগ্রি বারো মিনিট।

একটা সমস্যার সমাধান এখনও করতে পারেনি সে। আসল অবস্থানের কথা কাউকে না জানিয়ে কি করে সেখানে পৌঁছবে? সঙ্গে যে-ই যাক, জেনে যাবে, জামবু, কুমালো, কলিগ, তিনজনেই।

কুমালোকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন আর জামবুকে? প্রফেসরকে হুমকি দিয়েছে যারা, চুরি করে ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছে, তাদের সঙ্গে কি যোগাযোগ আছে দুজনের? কি করে জানা যাবে? ওদের কিছু কিছু মন্তব্য সন্দেহ জাগিয়েছে তার মনে।

পার্ল অ্যাটলে ওরা তিন গোয়েন্দার সঙ্গে না গেলেই খুশি হত সে। কিন্তু ওদেরকে ছাড়া, কিংবা দক্ষ অন্য কোন নাবিকের সহায়তা ছাড়া যেতে পারবে না কিছুতেই।

পারবে, যদি সে নিজে নাবিক হতে পারে, নেভিগেশন শিখে নিতে পারে। সূর্য, তারা, আর ক্রনোমিটারের সাহায্যে জাহাজের গতিপথ নির্ধারণ করা জানতে হবে। হিসেবে সামান্যতম ভুল করা চলবে না। তাহলেই চলে যাবে একদিক থেকে আরেক দিকে, আসল জায়গায় যাওয়া আর হবে না।

বুদ্ধি আছে তার। চেষ্টা করলে শিখতে পারবে না তা নয়, বরং অন্য অনেকের চেয়ে দ্রুতই পারবে। কিন্তু আরও একটা সমস্যা রয়ে যায়, কলিগ আর জামবুকে কোথায় নামিয়ে রেখে যাবে? কিভাবে? কি বলে বোঝাবে…

ভাবনায় বাধা দিল কলিগ, কি ভাবছ?

সূর্যটা ধরতে পারছি না ঠিকমত।

ওপরে তাকাল কলিগ। সূর্য যেখানে থাকার কথা, সেখানে শুধু একটা সাদাটে আভা। আকাশের কালো ভূতুড়ে মুখটা অন্ধকার হচ্ছে আরও।

ব্যারোমিটার দেখল ক্যাপ্টেন। সাধারণত তিরিশের ওপরে থাকে, এখন উনত্রিশের কাছাকাছি নেমে এসেছে।

মনে হচ্ছে, বড় রকমের বাড়ি খাব, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কলিগ। মন্তব্যটা অদ্ভুত লাগল কিশোরের কাছে। তার ধারণা ছিল বাতাস বাড়বে, তা হয়ে কমছে। খুব সামান্য, ঝিরঝির করে আসে, যায়, আসে, যায়। স্কুলে পড়েছে পাল। প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে হাওয়া।

ঘটনাটা কি? কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছে মুসা। ঘুমাচ্ছিল। আগের দিন অক্টোপাসের সঙ্গে লড়াইয়ের পর বিশ্রাম দিচ্ছিল শরীরটাকে। সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ, অক্টোপাসের সাকশন কাপের শোষণের স্বাক্ষর। শ্বাসই নিতে পারছি না!

বিশাল এক কম্বল ছড়িয়ে দিয়ে যেন চেপে ধরা হয়েছে শুকতারার যাত্রীদের, শ্বাসরুদ্ধ করে মারার পায়তারা চলছে।

হারিক্যান! ঘোষণা করল কলিগ। কুমালো, আলগা যা যা আছে, শক্ত করে বাঁধ। জামবু, পাল খোল। প্রধান মাস্তুলের নিচে গিয়ে দাঁড়াল সে। আরে, বাবা, একটু জলদি কর না! হাত চালাও। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে, তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে। এই তোমরাও এস, ধর, ধর! আর সময় নেই!

তাড়াহুড়ো করে নামাতে গিয়ে, পুলিতে দড়ি পেঁচিয়ে আটকে গেল একটা পালের ওপরের দিকটা।

ইসসিরে, আর সময় পেল না আটকানোর! উঠে গিয়ে এখন খুলতে হবে, উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে ক্যাপ্টেন। মাল্লাদের দিকে তাকাল। কুমালো আর জামবু দুজনেই ব্যস্ত। সে নিজে বয়স্ক লোক, ভারি শরীর, মাস্তুল বেয়ে এত ওপরে উঠতে পারবে না। মুসা পারবে, কিন্তু ঘষা লাগলেই চাকা দাগগুলোতে ব্যথা পায়।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করল রবিন। সারা দিনে কয়েকবার করে কাকের বাসায় উঠে উঠে মাস্তুল বাওয়া অভ্যাস হয়ে গেছে তার। বেয়ে উঠতে শুরু করল আরেকবার। নিচের দিকের ক্রসট্রীগুলো পেরিয়ে উঠল কাকের বাসায়। জিরানোর সময় নেই। উঠে গেল আগায়। পুলি থেকে দড়ির জট ছাড়িয়ে দিতেই হড় হড় করে নামতে শুরু করল পাল।

ডেকে তখন তুমুল ব্যস্ততা। দড়ি দিয়ে হ্যাচের মুখগুলো বেঁধে ফেলেছে কুমালো, ডিঙি বাঁধছে। অক্টোপাসের ট্যাংকটা জায়গামত আটকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে জাহাজের দুলুনির সময় না নড়ে! ছোটবড় সব কটা ট্যাংকের ঢাকনা শক্ত করে লাগাতে হবে। ইচ্ছে করলে খুবই দ্রুত কাজ করতে পারে জামবু, কিন্তু তাকে কেউ কিছু করার আদেশ দিলেই চিটাগুড়ের মত আঠা হয়ে যায় যেন তার শরীর, নড়তেই চায় না আর। কয়েকটা পাল গুটিয়ে নিয়ে নিচের তলায় রাখতে এল। স্টোররুমে ঢুকেই যেন আর কাজ পেল না, এই জরুরি মুহূর্তে মদ খাবার ইচ্ছে হল।

ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ক্যাপ্টেন। বিপদের মুখোমুখি হওয়ার জন্যে সবরকমে তৈরি করছে জাহাজটাকে।

পালে হাওয়া লাগলে সহজেই সাড়া দেয় শুকতারা, কিন্তু ইঞ্জিনের সঙ্গে সমঝোতা হতে সময় লাগল। সাড়া দিতে সবে শুরু করেছে। ঠিক এই সময় এল ঝড়।

মাস্তুলের ওপরে থেকে আসতে দেখল প্রথম রবিন। ডেকে নামার সুযোগ পেল না। কাকের বাসায় মাস্তুল আঁকড়ে বসে থাকতে বাধ্য হল সে।

বিশাল এক ঢেউ, তার মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে অনেক ওপরে। একটা মাত্র ঢেউ, আসার কোন ইঙ্গিতই দেয়নি, জন্মাল কখন তা-ও বোঝা যায়নি। হঠাৎ চোখে পড়ল ঢেউটা, পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে গেছে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল রবিন। ঢেউয়ের চূড়ায় সাদা ফেনা নাচছে। দেখে মনে হচ্ছে সাগরের সঙ্গেও কোন সম্পর্ক নেই ঢেউটার, পানি আর আকাশের মাঝে শূন্যে ঝুলে ঝুলে ছুটে আসছে শুকতারাকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যে।

ঢেউয়ের দিকে পাশ ফিরিয়ে আছে জাহাজ। ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করল পাহাড়ে। পানির ঢলে পড়ে কাত হয়ে যাচ্ছে। এত বেশি কাত হয়ে গেল মাস্তুল, নিচে তাকিয়ে ডেক দেখতে পেল না রবিন, চোখে পড়ল আয়নার মত চকচকে সাগর।

হাত ছেড়ে লাফিয়ে পড়বে পানিতে? তার মনে হল, এই ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সাধ্য দুনিয়ার কোন জাহাজের নেই, এখুনি উল্টে যাবে শুকতারা। তখন আর মুক্তির উপায় থাকবে না। পানির তলায় চলে যাবে সে।

কিন্তু কি ভেবে শেষ পর্যন্ত ছাড়ল না রবিন। কুঁচকে ফেলল নাকমুখ, যখন ঢেউয়ের চূড়াটাকে তার ওপর ভেঙে পড়তে দেখল। পনি এরকম আঘাত করতে পারে, জানতই না সে। মনে হল কঠিন কিছু দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে তাকে। পানির চাপে কাকের বাসার রেলিঙ আর মাস্তুলের সঙ্গে এমনভাবে আটকে গেল, চাইলেও এখন আর নিজেকে ছোটাতে পারবে না।

ফুসফুসের সমস্ত বাতাস নিঙড়ে বের করে নিয়ে গেছে যেন পানি। হাঁ করে দম টানতে গিয়ে নাকমুখ দিয়ে ঢুকল নোনা পানি। নিঃশেষ হয়ে আসছে শক্তি। পুরো ব্যাপারটাই কেমন অবাস্তব লাগছে। ডেকের চল্লিশ ফুট ওপরে বসে থেকে পানিতে ডুবল কিভাবে?

কিশোর কই? আর মুসা? ডেক থেকে ধুয়ে নিয়ে গেছে ওদেরকে পানি? এই তাহলে হারিক্যান! মাস্তুলটা আবার সোজা হয়েছে বলে মনে হল। নিচে তাকাল সে। ডেকটা যেখানে থাকার কথা সেখানে শুধু পানির ঘূর্ণি।

সরে গেল পানি। লাফ দিয়ে আবার বেরিয়ে এল যেন ডেকটা। কিশোর আর মুসাকে দেখা গেল। দুই মাস্তুলের সঙ্গে যার যার শরীর বেঁধে নিয়েছে। মরে গেছে

বেঁচে আছে বোঝার জো নেই। তবে আছে জাহাজেই, সাগরে ভেসে যায়নি, এটুক নিশ্চিত হওয়া গেল। ককপিটের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে ক্যাপ্টেন। মহাপ্লাবনের ভেতর থেকে যেন একটা সীমাছের মত বেরিয়ে এল কুমালো। এগিয়ে গেল হালের দিকে, জখমী হালটাকে মেরামত করার জন্যে।

জামবুর ছায়াও চোখে পড়ল না।

কিন্তু জামবু আছে। মাত্র চুমুক দিয়েছে বোতলে। পানীয়টা পেটে গিয়েও সারতে পারেনি, মাথায় লাগল প্রচণ্ড বাড়ি। তুলে নিয়ে বাল্কহেডের গায়ে ছুঁড়ে মারল যেন তাকে কেউ। গায়ের ওপর এসে পড়ল, বাক্স, টিন, বস্তা আর আরও নানারকম জিনিস। একটা ময়দার বস্তা ছিঁড়ে গিয়ে ময়দায় মাখামাখি হয়ে গেল তার সমস্ত শরীর। জিনিসপত্রের স্তুপের নিচে, দেয়ালে উপুড় হয়ে পড়েছে সে, মাথা ঠেকে আছে ছাতের সঙ্গে। খানিক পরে গড়িয়ে সরে গেল জিনিসগুলো, মুহূর্ত পরেই ফিরে এল আবার দ্বিগুণ বেগে, বাড়ি মেরে, চাপ দিয়ে, নীল করে দিল তাকে।

অনেক কষ্টে চার হাতপায়ে ভর দিয়ে টেনে তুলল শরীরটা। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। শক্ত হয়ে লেগে গেছে পাল্লা। খুলতে পারল না। তালা। লাগেনি। তালা নেই-ই, লাগবে কি করে? কিন্তু তবু খুলতে পারল না। দরজার ওপাশে প্রচণ্ড গর্জন।

বাতাস তাহলে এল অবশেষে। এমনভাবে ঠেলে ধরে রেখেছে পাল্লা, যেন পেরেক দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ওটাকে। কাত হয়ে আছে ঘরটা। দেয়ালে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল জামবু।

জিনিসপত্র ওড়াউড়ি থেমেছে। এখন বাইরে বেরোনো গাধামি হয়ে যাবে, ভাবল সে। এখানেই আরাম করে বসে থাকতে পারে, শুয়েও থাকতে পারে ইচ্ছে হলে। কাজ যা করার অন্যেরাই করুক না, সে কেন অযথা খাটতে যাবে? দরজাটা আটকে গেছে, বেরোতে পারেনি, এটা তার দোষ নয়। দরজা খোলার। চেষ্টা বাদ দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল দেয়ালে।

বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়। মস্ত ঢেউটা সরে যাওয়ার পর, বাতাস আসার আগে, মাঝখানে একটু সময় পেয়েছে রবিন। নেমে চলে এসেছে কাকের বাসা থেকে। কাত হয়ে শুয়ে আছে যেন শুকতারা, বাতাসের দিকে পিঠ দিয়ে। কাত হয়ে আছে ডেক, টিনের ঘরে চালার মত। গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে না। যেন শক্তহাতে ধরে রাখা হয়েছে জাহাজটাকে। পানি আগের মতই মর্সণ। তবে বাতাস আসার পর থাকবে এরকম। লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

প্রাণপণে লড়ে চলেছে দুর্বল ইঞ্জিন। ঢেউয়ের চূড়া পেরিয়ে এসে আরেক পাশের ঢালে রয়েছে এখন জাহাজ। নিচ দিয়ে ঢেউটা গড়িয়ে সরে যাওয়ার পর সোজা হল। কিন্তু হয়েও সারতে পারল না, ঝাপটা মারল বাতাস।

রবিনের মনে হল, বাতাস নয়, ইটের দেয়াল এসে ধাক্কা মারল তাকে। বাতাসের মুখোমুখি হয়ে আছে সে। আপনাআপনি বুজে গেছে চোখের পাতা, জোর করে বাতাস ঢুকে গেছে ফুসফুসে, ফোলাতে ফোলাতে যেন ফাটিয়ে ফেলবে। এখনই মাস্তুলের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলতে না পারলে একটা পাতার মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে তাকে হাওয়া। শুধু হাত দিয়ে মাস্তুল আঁকড়ে ধরে রেখে বাঁচতে পারবে না।

ঝড় আরও দেখেছে সে, কিন্তু এমন অবস্থা দেখেনি। হারিক্যান নামটা কোথা থেকে এসেছে, জানে। বই পড়ে জেনেছে। নামটা এসেছে মধ্য আমেরিকার ইনডিয়ানদের বজ-বিদ্যুতের অপদেবতা হারাকান থেকে। এই একই ঝড়কে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম অঞ্চলের লোকেরা বলে টাইফুন, নামটার উৎপত্তি চীনা শব্দ টাইফুং, অর্থাৎ প্রচণ্ড বাতাস থেকে। আরও অনেক নাম আছে এই ঝড়ের। কেউ বলে চাব্যাসকো, কেউ সিক্লোন, কেউ হারাকান। বলে টরবেলিনো, টরমেনটা, কিংবা ট্রপিক্যাল। কিন্তু যে যে নামেই ডাকুক, একবার যে এর মধ্যে পড়েছে, জীবনে ভুলবে না আর।

মাস্তুলের একদিক থেকে ঘুরে আরেক দিকে চলে এল রবিন। শ্বাস নিতে কষ্ট হল এভাবেও।

জাহাজের সামনের পাটাতনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানি। সেখান থেকে খানিকটা খাবলা মেরে তুলে পেছনে ছিটিয়ে দিল বাতাস। তালু ছড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাসের জোর পরীক্ষা করতে গিয়েছিল রবিন, প্রচণ্ড ঝটকায় হাত সরে গেল পেছনে। হাতের তালুতে পানির কণা সুচের মত এসে বিঁধে রক্তাক্ত করে ফেলল চামড়া। অবশ হয়ে গেল হাতটা, যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে। আন্দাজ করল সে, ঘন্টায় দেড়শো মাইলের কম হবে না বাতাসের গতিবেগ।

বিশাল ঢেউটা যাওয়ার পর যে শান্ত হয়ে গিয়েছিল সাগর, এই বাতাসে সেটা আর থাকতে দিল না। জ্যান্ত হয়ে উঠল যেন পানি। লাফিয়ে উঠতে লাগল বড় বড় ঢেউ। কয়েক মুহূর্ত শান্ত হয়ে ছিল জাহাজটা, এখন পাগলের মত নাচতে শুরু, করল ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে। ঢেউয়ের মাথায় ওঠার সময় ওঠে নাক উঁচু করে, নামার। সময় নামে নিচু করে, বিপজ্জনক ভঙ্গিতে।

ভাগ্যিস সময়মত মাস্তুলের সঙ্গে শরীরটা পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলেছিল পালের দড়ি দিয়ে! আরও দুটো মাস্তুলে বাঁধা অবস্থায় মুখ গুঁজে রয়েছে কিশোর আর মুসা। কুমালো মুক্তই রয়েছে, জাহাজের সঙ্গে তাল রেখে একবার এদিকে কাত হয়ে। যাচ্ছে, একবার ওদিকে, বাতাসে ঝুলন্ত ডালে আঁকড়ে বানর যে-রকম করে ঠিক তেমনি। ককপিটের মেঝেতে শুয়ে আছে ক্যাপ্টেন, এক হাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে হুইলের নিচের দিকের একটা স্পেক। জামবু নেই। নিশ্চয় নিচের মালপত্র সামলাতে ব্যস্ত, ভাবল রবিন।

কিন্তু মাল নয়, নিজেকেই এখন আর সামলাতে পারছে না জামবু। ভেবেছিল আরাম করে শুয়ে থাকবে। ঝড় বাড়তেই বুঝল, মস্ত ভুল করে ফেলেছে। সাগর যেন বল খেলতে শুরু করল তাকে নিয়ে। দেয়াল থেকে একবার মেঝেতে ছুঁড়ে মারে, আবার মেঝে থেকে দেয়ালে। ঘরের একপাশে একটা বাংক আছে। কোনমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে গিয়ে উঠল ওটাতে। ধার খামচে ধরে উপুড় হল। ভাবল, যাক বাঁচা গেল। কিন্তু বাঁচতে পারল না। ওটাও ছুঁড়ে মারল তাকে। আরও দুঃখ যোগ হল তার কপালে, জীবন্ত হয়ে উঠল যেন মালপত্রগুলো। সে যেদিকে যায়, ওগুলোও ছুটে যায় সেদিকে, কে কত জোরে এসে তার গায়ে লাগতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় মেতেছে যেন।

আতঙ্কে, ব্যথায় প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হল জামবুর। মেঝেটা আরেকবার সোজা হতেই ঝাঁপিয়ে এসে দরজায় পড়ল সে। পাল্লা খোলার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। জোরে জোরে ধাক্কা মারতে লাগল কাঁধ দিয়ে। ব্যথাই পেল শুধু কাঁধে, পাল্লার কিছু করতে পারল না। আগের মতই অনড় রইল ওটা।

উড়ে এসে মাথায় লাগছে নানারকম বাক্স, টিন। পাগলের মত দরজায় কিল মারতে মারতে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে শুরু করল সে। ঝড়ের এই ভয়াবহ শব্দের মাঝে তার ডাক কারও কানে পৌঁছবে না, বুঝল। বড় একটা বাক্স তুলে গায়ের জোরে ছুঁড়ে মারল দরজায়। কিন্তু অন্যপাশে বাতাসের হাত আরও শক্ত, বিন্দুমাত্র নড়তে দিল না পাল্লাটাকে। ভাল জেলখানাতেই আটকে পড়েছে সে!

ভীষণ অনুশোচনা হল তার, কাঁদতে শুরু করল। জোরে জোরে বলতে লাগল, এখান থেকে যদি জীবন্ত বেরোতে পারে, মদ খাওয়া ছেড়ে দেবে, জীবনে আর বোতল ছুঁয়ে দেখবে না। আর কখনও কাজে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে না। খারাপ কাজ করবে না। একেবারে ভাল হয়ে যাবে, দুধে ধোঁয়া, বিমল, পরিষ্কার।

যেন তার ডাক শুনতে পেলেন ঈশ্বর, করুণা করলেন ক্ষণিকের জন্যে। ঝটকা দিয়ে হঠাৎ খুলে গেল পাল্লা। ওটার ওপরই কাত হয়ে হেলান দিয়ে ছিল জামবু, পড়ে গেল করিডরে। জোর বাতাসে পেছনে আবার দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লা। মালপত্রের মার খাওয়া থেকে বাঁচল অন্তত সে।

উপুড় হয়ে পড়ে থেকে খুব অল্প সময়েই প্রতিজ্ঞা ভুলে গেল জামবু। কাজ করে মরুকগে কুমালো, তার কি? সুবিধেমত একটা জায়গা বেছে নিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। অনেক ধকল গেছে, জিরিয়ে নেয়া দরকার।

একটানা বাতাস বওয়া বন্ধ হল, থেকে থেকে আসছে এখন ঝাপটা। কমছে বাড়ছে, কমছে বাড়ছে, এরকম করতে করতে থেমেই গেল একেবারে। কানফাটা গর্জনের পর এই স্তব্ধ নীরবতা আরও ভয়ঙ্কর মনে হল রবিনের। ছেড়া ছেড়া মেঘগুলো অদৃশ্য হয়ে গিয়ে ফুটে বেরোলো নীল আকাশ।

আল্লাহ্, বাঁচলাম! চেঁচিয়ে বলল মুসা। গেছে মরার তুফান!

রবিনের তা মনে হল না।

কলিগ বলল, অর্ধেকটা গেছে।

পানির ঘূর্ণির মতই পাক খেয়ে খেয়ে চলে হারিক্যানের বাতাস। একশো থেকে দুশো মাইল গতিতে। ঘোরার গতি প্রচণ্ড, কিন্তু সরার গতি খুব কম, বড় জোর ঘন্টায় বারো মাইল।

এই ঘূর্ণির মাঝখানে রয়েছে ঝড়ের চোখ, খুব শান্ত, বাতাস প্রায় থাকেই না কেন্দ্রবিন্দুতে।

বেশি হলে আধ ঘন্টা, ক্যাপ্টেন বলল। তারপরই অন্যপাশের দেখা পাব আমরা।

যার যার বাঁধন খুলে কুমালোর কাজে সাহায্য করতে গেল তিন গোয়েন্দা। জাহাজের ভেতরে বাইরে সব তছনছ করে দিয়েছে ঝড়। আরেকটু হলেই দড়ি ছিঁড়ে সাগরে পড়ে যেত ডিঙিটা, কোনমতে আটকে আছে।

কাজ করতে করতে ঘামছে ওরা। বাতাস খুব পাতলা, গরম, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ঝড় নেই, তবুও জাহাজটা এত দুলছে কেন প্রথমে বুঝতে পারল না কিশোর। ঝড় যখন ছিল, তখনকার চেয়ে বড় আর এলোমেলো ঢেউ এখন সাগরে। আসলে তখন বাতাসের গতি একটা বিশেষ দিকে ছিল, নিয়ন্ত্রণ ছিল পানির ওপর। এখন নেই। ফলে উত্তাল হয়ে উঠেছে পানি, যেন যা-ইচ্ছে-করার খেলায় মেতেছে। লাফিয়ে উঠছে ঢেউ, পঞ্চাশ ফুট, ষাট ফুট ওপরে গিয়ে ফাটছে, ঝরে পড়ছে। ফোয়ারার মত। যেন পানির নিচে জাহাজ বিধ্বংসী টর্পেডো ফাটানো হচ্ছে একের পর এক।

চারদিকে দাপাদাপি করছে পানি, ঢেউ আছড়ে ভাঙছে ঢেউয়ের ওপর, সৃষ্টি করছে হাজারো ফোয়ারা, অসংখ্য জলপ্রপাত।

পানির এই অস্থিরতার কারণও এখানে বাতাস নেই বলে। প্রচণ্ড গতিতে। চরকির মত পাক খেয়ে বাতাস ঘুরতে ঘুরতে মাঝখানে সৃষ্টি করেছে ফাঁপা শূন্যতা। বাতাসের চক্র ভেদ করে বেরোতে পারছে না ঢেউ, ফলে সবদিক থেকে ধেয়ে আসছে কেন্দ্রের দিকে, মহা-অনর্থ বাধিয়েছে এসে এই শূন্যস্থানে।

বড় যাত্রীবাহী জাহাজ কিংবা মালবাহী স্টীমার হলে এই অত্যাচার সহ্য করতে পারত না, ঠাই নিত গিয়ে এতক্ষণে সাগর দেবতার ভঁড়ারে। শুকতারা ছোট বলেই পারছে। এ-ধরনের আবহাওয়া সহ্য করার ক্ষমতা বড়গুলোর চেয়ে ছোট জলযানগুলোর বেশি।

প্রথম কারণ, স্কুনারটা কাঠের তৈরি। কাঠ পানিতে ভাসে, ইস্পাত ভাসে না। বড় যে-কোন একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে যেতে পারছে ছোট বলে। বড়গুলো পারে না, ওগুলোর নিচে পড়ে একাধিক ঢেউ। ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথায় চড়ে বসতে পারে না, ফলে মার হজম করতে হয়। ভয়ঙ্কর চাপে বেঁকেচুরে ফেটে যায় খোল। – শাঁ করে একবার ঢেউ-পর্বতের চূড়ায় উঠে যাচ্ছে শুকতারা, তীব্র গতিতে আবার নামছে অন্ধকার উপত্যকায়। এদিকে কাত হচ্ছে, ওদিকে কাত হচ্ছে, দুলছে, গড়াচ্ছে, কিন্তু ডুবছে না, ভেসে রয়েছে কোনমতে।

শত শত পাখি এসে ঢুকেছে,এই কেন্দ্রবিন্দুতে। নাগালের মধ্যে যতগুলোকে। পেয়েছে, ঝেটিয়ে সব নিয়ে এসেছে যেন বাতাস। নুডি, বুবি, গাল, ডানা কাপাতে কাপাতে এসে বসছে ডেকে, ওপর থেকে খসে পড়ছে যেন। ডিঙির ওপরে এসে ঠাই নিল দুটো মস্ত ফ্রিগেট পাখি। শুধু পাখিই না, পাখাওয়ালা আরও জীব এসেছে, হাজারে হাজারে পতঙ্গ প্রজাপতি, মথ, মাছি, মৌমাছি, বোলতা, ঘাসফড়িং। ঝাকে ঝাকে এসে ছেয়ে ফেলছে মাস্তুল, পালের দড়ি। হাতে লাগছে, মুখে লাগছে, কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছে বিচিত্র সুরে।

উত্তর-পুবমুখো এগোচ্ছে জাহাজ। হঠাৎ ওটার নাক দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরিয়ে ফেলল ক্যাপ্টেন।

এরকম করলেন কেন? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

করলাম, যাতে ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে এগোতে পারে।

ঝড়টা এল আবার, আচমকা। আরেকটু হলেই উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল কিশোরকে। আবার শুরু হল বাতাসের গর্জন। হাতে মুখে বিধছে পানির কণা। অদৃশ্য হয়ে গেছে নীল আকাশ, মাথার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে যেন কালো ভূতুড়ে অন্ধকার।

আগের বারের চেয়ে ঢেউগুলো, এখন ছোট, মাস্তুল ছাড়িয়ে যাচ্ছে না। ভয়ঙ্কর কোন উদ্দেশ্য নিয়েই বুঝি ছুটে চলেছে একদিকে।…

একটা ব্যাপার পরিষ্কার, হারিক্যানের প্রথম আঘাতের চেয়ে দ্বিতীয়টা খারাপ : হবে।বাতাস এবং ঢেউ, দুটোরই জোর বেশি। উধাও হয়ে গেল পাখি আর পতঙ্গ, যেন ভেল্কিবাজি। টুকরো টুকরো হয়ে গেল মাস্তুল, পাল যে কটা ঝুলছিল, ছিঁড়ে ফালাফালা। বুমটা ভেঙে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ঝুলতে লাগল ডেকের ওপর।

ভাঙা মাস্তুলের গোড়ায় নিজেদেরকে বাঁধার সাহস আর হল না তিন গোয়েন্দার। কুমালোর পদ্ধতি অনুকরণ করে টিকে রইল কোনমতে। জামবু কোথায় ভেবে অবাক হচ্ছে।

জাহাজটাকে দুদিক থেকে ধরে ভীষণ ভাবে আঁকাচ্ছে যেন কোন দানব। মড়মড় করে শব্দ হল পেছনে, টিল হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের হাতের হুইল।

হালটা গেল! চিৎকার করে বলল কলিগ।

বাতাসের দিকে পেছন করে আর থাকতে পারল না শুকতারা। নিজের নিয়ন্ত্রণ শেষ। বাতাস এখন যেদিকে ঘোরাচ্ছে সেদিকেই ঘুরতে বাধ্য হচ্ছে। টেউয়ের তাথৈ নাচের মাঝে পড়ে বাদামের খোসার মত দুলতে লাগল, অসহায়।

প্রতিবার গড়ানোর সময় কয়েক টন করে পানি বয়ে যাচ্ছে ডেকের উপর দিয়ে, নিচে নামার পথ বেয়ে নেমে চলে যাচ্ছে খোলে।

পাম্প চালু করে দিয়েছে ক্যাপ্টেন, কিন্তু সেঁচে সারতে পারছে না। কুলিয়ে উঠতে পারছে না পাম্প, ফলে জমে যাচ্ছে পানি।

ঘুমিয়ে পড়েছিল জামবু। নাকে পানি ঢুকতে জাগল। দেখল, নোনা পানিতে। ডুবে আছে সে, ফুসফুসে ঢুকতে শুরু করেছে পানি। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটল। হাঁসফাঁস করছে, কাশছে। কত তাড়াতাড়ি এখন ডেকে উঠবে কেবল সেই চেষ্টা।

প্রকৃতিও যেন খেলতে আরম্ভ করেছে দুষ্ট জামবুকে নিয়ে। ডেকে উঠেও সারতে পারল না সে, প্রচণ্ড এক ঢেউ এসে তাকে ভাসিয়ে নিল রেলিঙের দিকে।

পড়ে গেল! পড়ে গেল! চিৎকার করে উঠল ক্যাপ্টেন।

চিৎকারটা সবে বেরিয়েছে তার মুখ থেকে, এই সময় ফিরতি আরেকটা ঢেউ আবার জামবুকে এনে ডেকে আগের জায়গায় ফেলল। তার বোকা-হয়ে-যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল ছেলেরা।

জলদি উঠে ধর কোন কিছু, তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল ক্যাপ্টেন। নইলে আবার নিয়ে যাবে। সাগরে পড়লে আর উঠতে হবে না।

জামবুর দিকে বেশিক্ষণ নজর দেয়ার সময় কারও নেই। খুনী বাতাস পলিনেশিয়ানরা বলে হারিক্যানকে—শুকতারাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যেন।

ভীষণ ভাবে দুলে উঠল জাহাজ। গোড়া থেকে মড়মড় করে ভাঙল প্রধান মাস্তুল। দড়িদড়ায় আটকে থাকায় পানিতে পড়ল না, ওটার ভারে বাঁ পাশে কাত হয়ে গেল জাহাজ। কয়েক মুহূর্ত পরে সামনের মাস্তুলটা ভাঙল, ডিঙির ওপর পড়ে গুঁড়িয়ে দিল ডিঙিটাকে।

আনন্দ ভ্রমণ শেষ। এখন আর জাহাজ বলা যাবে না শুকতারাকে, জাহাজের ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। যাত্রীরা প্রাণে বাঁচবে কিনা এখন তার আর বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই।

নোঙর ফেলো, নোঙর! চেঁচিয়ে উঠল কলিগ।

থোলের মধ্যে পানি। প্রতিটি ঢেউ এখন গড়িয়ে যাচ্ছে জাহাজের ওপর দিয়ে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত যোগ হল এর সঙ্গে বৃষ্টি। এক ফোঁটা দুফোঁটা নয়, মুষলধারে। অবিশ্বাস্য রকমের বড় বড় ফোঁটা।

এতক্ষণে বিশ্বাস করল কিশোর, হারিক্যানের ভয়াবহতা আর বৃষ্টি সম্পর্কে যা শুনেছে, সব সত্যি। হারিক্যানের সময় ফিলিপাইনে মাত্র চারদিনে যা বৃষ্টিপাত হয়, তা ইউনাইটেড স্টেটস-এর পুরো এক বছরের বৃষ্টিপাতের সমান।

এই বৃষ্টির চেয়ে মাথার ওপর ঢেউ ভেঙে পড়া অনেক আরামের ছিল।

কোথাও গিয়ে মাথা গোঁজার সময় নেই, উপায়ও নেই। এক্ষুনি নোঙর ফেলতে না পারলে বাঁচানো যাবে না জাহাজটাকে। কিন্তু কিশোর বুঝতে পারল না এই গভীর পানিতে নোঙর ফেলবে কি করে?

বাতলে দিল ক্যাপ্টেন। কুমালোকে নিয়ে কাজে লেগে গেল ছেলেরা। ছোট মাস্তুলটাকে টেনে-হিঁচড়ে প্রধান মাস্তুলের কাছে নিয়ে গিয়ে এক করে পেঁচিয়ে বাঁধল। তারপর দুটোর মাঝামাঝি জায়গায় শক্ত দড়ি বেঁধে দড়ির, আরেক মাথা বাঁধল গলুইয়ের কাছে নোঙর বাধার খুঁটিতে। যেসব দড়িতে মাস্তুলগুলো আটকে রয়েছে ওগুলো কেটে দিতেই পিছলে গিয়ে পানিতে পড়ল মাস্তুল দুটো। সোজা হয়ে গেল জাহাজ।

আরেকটা ব্যাপার ঘটল। ভারি মাস্তুলগুলো ডুবে ডুবে ভেসে রয়েছে পানিতে। বাতাস লাগছে না, ঘোরাতেও পারছে না ওগুলোকে, কিন্তু জাহাজটাকে ধাক্কা দিয়ে সহজেই ঘুরিয়ে ফেলছে। নোঙরের কাজ করছে এখন মাস্তুল দুটো। টান লেগে জাহাজের মুখ ঘুরে গেল বাতাসের দিকে, ঢেউয়ের মুখোমুখি। ফলে বাতাসের চাপ যেমন কমল অনেকখানি, ঢেউয়ের আঘাতও। দুপাশ দিয়ে কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাতাস আর ঢেউ দুটোই।

আরও একটি ঘন্টা ঝড়ের সঙ্গে প্রাণপণে ঝুঝলো ছোট্ট জাহাজটা। কোনমতে ভেসে রইল পানির ওপরে।

তারপর যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি গর্জন করতে করতে পেছনে সরে গেল ঝড়।

আবার দেখা দিল নীল আকাশ। বেরিয়ে এল সূর্য। বারো নট গতিতে পশ্চিমে সরে যাচ্ছে বাতাসের প্রচণ্ড ঘূর্ণি।

ঝড় সরে যাওয়ার পর আরও ফুসে উঠল সাগর, বাতাসের চাপ হঠাৎ কমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া। তারপর শান্ত হয়ে এল আস্তে আস্তে। ঢেউ আছে, তবে ছোট, ডেকের ওপরে আর উঠতে পারছে না, পানিও ঢুকছে না আর কোলে। জিততে শুরু করেছে পাম্প। আগেরমত ভেসে উঠছে জাহাজ।

হাঁপ ছেড়ে বাঁচল জাহাজের ছজন মানুষ। মনে মনে ধন্যবাদ দিল ঈশ্বরকে, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী।

ট্যাংকগুলোর অবস্থা দেখতে গেল কিশোর। সব কটার ঢাকনা লাগানো রয়েছে। পানি কানায় কানায় ভরা। ফলে কোন ক্ষতি হয়নি ভেতরের অধিবাসীদের। আনন্দেই আছে, এতবড় একটা ঝড় যে গেল যেন বুঝতেই পারেনি।

মাস্তুলগুলোর কি হবে? ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। ফেলে দিয়ে যাব?

না। পোনাপতে গিয়ে ঠিকঠাক করে আবার লাগাব।

কাজ চালানোর মত মেরামত হল হালটা। কিন্তু পাল আর তোলা গেল না। ছোট্ট ইঞ্জিনের ক্ষমতা নিঙড়ে, ভারি দুটো মাস্তুল পেছনে টানতে টানতে, ধুকে ধুকে পোনাপের দিকে এগিয়ে চলল শুকতারা।

Categories: