প্রায় অচেনা-সাগরে এসে পড়েছে এখন জাহাজ। ক্যাপ্টেন কলিগও এখানে আসেনি কখনও। কোন জাহাজ চোখে পড়ল না, জাহাজপথ এখান থেকে অনেক দূরে, উত্তরে এবং দক্ষিণে।
দুটো বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়টা এই অঞ্চল জাপানের দখলে ছিল। অন্য কোন দেশের জাহাজকে ঢুকতে দিত না এখানে। জাপান ছাড়া বাইরের দুনিয়ার আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না এখানকার আড়াই হাজার অধিবাসীর। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখানে আসত অন্য দেশের অভিযাত্রীরা।
অবস্থা এখনও প্রায় সেই একই রকম রয়েছে, কর্তৃত্ব হাতবদল হয়েছে মাত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে, ইউনাইটেড নেশনসের হয়ে দ্বীপগুলো শাসন করছে এখন ইউনাইটেড স্টেটস।
আমেরিকান নৌবাহিনীর যেসব লোক কর্মরত রয়েছে এখানে, তাদের মনে হয়, পৃথিবীতে নয়, অন্য কোন গ্রহে বন্দি জীবনযাপন করছে। জীবনে কোন উত্তেজনা নেই, নতুনত্ব নেই, কাজেই ভাঙাচোরা শুকতারা আর এর অধিবাসীদের দেখে স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনা সৃষ্টি হল তাদের মাঝে। পোনাপেতে অতিথির আগমন!
অতিথিরাও উত্তেজিত, বিস্মিত। ভাঙা জাহাজ থেকে মাটিতে পা রাখার জন্যে যেন আর তর সইছে না। এত সুন্দর দ্বীপ আর দেখেনি ওরা।
আরিব্বাবা, এত সুন্দর! মুগ্ধ বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। সাদা সৈকত, নীল ল্যাগুন, আর সবুজে ছাওয়া আকাশচুম্বী পর্বত। মনে হয় ছবি। পর্বতের ঢালে – সাজিয়ে রাখা হয়েছে যেন নারকেলগুচ্ছ, ডালা ছড়ানো আমগাছ, বিশাল বট আর অন্যান্য শত শত জাতের গাছপালা, ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে, ছেয়ে আছে ফুলে ফুলে। ঠিকই নাম রেখেছিল প্রাচীন স্পেনের নাবিকেরা–বাগানদ্বীপ।
দক্ষিণ সাগরের নিচু প্রবাল অ্যাটলগুলোতে বৃষ্টিপাত প্রায় হয়ই না, অথচ পোনাপের আবহাওয়া এর উল্টো। প্রচুর বৃষ্টি হয়। ঝড়বাদলকে স্বাগত জানিয়ে ডেকে আনে পর্বতের উঁচু উঁচু চূড়াগুলো। এই যে এখন, চারপাশে ঝকঝকে রোদ, এই এখনও টটল নামের চূড়াটার ওপর জমে রয়েছে কালো মেঘ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে।
খাইছে! ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার চোখ।
খালি যে তাহিতি আর সামোয়ার কথা বলে লোকে, রবিন বলল। এর চেয়ে ভাল?
ধারেকাছে আসতে পারবে না, ক্যাপ্টেন বলল। ওই দুটো দ্বীপ দেখেছে সে।
তাহলে এটার কথা বেশি শোনা যায় না কেন?
লোকে বেশি আসতে পারে না বলে।
আরি, একেবারে দেখি জিবরালটার! বলে উঠল মুসা।
হ্যাঁ, একেবারে জিবরালটারের মতই। চার্ট বলছে, ওটার নাম রক অভ চোকাচ। বন্দরের ওপরে নশো ফুট উচু হয়ে আছে। ব্যাসল্টের পাহাড়, ঢল এত খাড়া, দুঃসাহসী পর্বতারোহীও ওঠার আগে দশবার দ্বিধা করবে।
প্রবাল প্রাচীরের একটা ফাঁকের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল শুকতারা। দ্বীপের সৌন্দর্য যেন চুইয়ে এসে পড়েছে ল্যাগুনেও। তীরের খুব বেশি কাছে যাওয়া গেল না, বিপজ্জনক চড়ার জন্যে। দশ ফ্যাদম পানিতে নোঙর ফেলল ক্যাপ্টেন।…
কিছু মাছধরা নৌকা আর নেভির বিশেষ জলযান ছাড়া কোন জাহাজ নেই বন্দরে। বিমান একটা দেখা গেল, ক্যাটালিনা বিমান, ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে যেন।
দ্বীপের একাংশে গড়ে উঠেছে শহর। সেদিক থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এল একটা লঞ্চ। শুকতারার পাশে এসে থামল। লঞ্চ থেকে জাহাজের ডেকে নামল একজন সুদর্শন তরুণ নেভাল অফিসার। পরিচয় দিল, কমাণ্ডার ফেলিক্স ম্যাকগয়ার, পোনাপের ডেপুটি মিলিটারি গভর্নর।
হারিক্যানের স্বাদ তাহলে ভালই পেয়েছেন, বলল অফিসার।
শেষ করে দিয়েছে একেবারে, স্বীকার করল ক্যাপ্টেন। আপনাদের ওপর দিয়েই গেছে নাকি?
না, ভাগ্য ভাল, উত্তর দিয়ে সরে গেছে। কিন্তু আমাদের একটা সাপ্লাই শিপ পড়েছিল ওটার পথে।
তারপর?
ডুবে গেছে। পুরো পাঁচ হাজার টন। আপনাদের এই বাদামের খোসাটা বাঁচল কিভাবে? আশ্চর্য!
গর্বিত ভঙ্গিতে শুকতারার ওপর চোখ বোলাল ক্যাপ্টেন। ছোট জাহাজ তো, তাই। তবে খুব মজবুত। এখানে মেরামত করানোর জায়গা আছে?
আছে। শিপইয়ার্ড।
নিশ্চয় কাগজপত্র দেখতে চাইবেন, বলতে বলতে বের করল কলিগ। পোর্ট চার্জ কত?
হেসে উঠল কমাণ্ডার। লাগবে না। লোকজন খুব একটা আসে না আমাদের এখানে, তাই পোর্ট চার্জ নিয়েও ভাবি না। ছমাসের মধ্যে বাইরের লোক এই আপনারাই এলেন। তা থাকবেন কদ্দিন?।
ও বলতে পারবে, কিশোরকে দেখিয়ে দিল কলিগ। কিশোর পাশা। এই অভিযানের লীডার।
বেশি দিন না, কিশোর বলল। মিস্টার কলিগ তাঁর জাহাজ মেরামত করুন। আমরা শুধু শুধু বসে থেকে আর কি করব? একটা মোটর-বোট ভাড়া করে আশেপাশের যে কটা দ্বীপ পারি, ঘুরে দেখে আসব।
এক মুহূর্ত নীরবতা। আরও বিস্তারিত শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে। ম্যাকগয়ার। কিন্তু প্রফেসরের মুক্তাদ্বীপের কথা সবার সামনে কমাণ্ডারকে বলার ইচ্ছে নেই কিশোরের।
বেশ, ম্যাকগয়ার বলল। বোট একটা ঠিক করে দেব। এখন নিশ্চয় তীরে যেতে চাও। উঠে পড়ো আমার লঞ্চে, কে কে যাবে।
ক্যাপ্টেন, রবিন, মুসা আর কুমালো উঠল লঞ্চে। কিশোর উঠতে যাবে, এই সময় কলিগ বলে উঠল, জামবু কই?
দেখি, ডেকে আনি।
ফোরক্যাসলে তাকে পেল না কিশোর। স্টোররুম খুঁজতে গেল। সেখানেও দেখল না। খসখস শব্দ কানে আসতে গিয়ে একটানে খুলল কেবিনের দরজা, যেটাতে ওরা তিনজন থাকে।
ওই তো জামবু। কিশোরের নোটবুক আর ফাইলপত্রের পাতা ওল্টাচ্ছে। এই, কি করছ? তীক্ষ্ণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না, কিছু না, ভোঁতা গলায় জবাব দিয়ে, কিশোরকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে। কেবিন থেকে বেরোলো জামবু। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ডেকে। একটা কথা বলল না। চুপচাপ গিয়ে উঠল লঞ্চে।
চিন্তিত হয়ে পড়েছে কিশোর। নিশ্চয় মুক্তাদ্বীপের কথা জানে লোকটা, তার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখতে চাইছিল কোন তথ্য আছে কিনা। তারমানে প্রফেসর ইস্টউডের প্রাণনাশের হুমকি যারা দিয়েছে, তাদেরই চর জামবু। শুকতারায় উঠেছে
তথ্য জোগাড়ের উদ্দেশ্যে।
যা হবার হয়ে গেছে, লঞ্চে আর কিছু বলল না কিশোর। তবে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে, মুক্তাদ্বীপে তাদের সঙ্গে আর যে-ই যাক, জামবু অন্তত যাচ্ছে না। এমনকি শুকতারা, যখন আবার পাল তুলবে দেশে ফেরার জন্যে, তাতেও মান্না হিসেবে আর নেয়া হবে না লোকটাকে।
দ্বীপটাতে তিরিশ বছর রাজত্বের স্বাক্ষর ভালমতই রেখে গেছে জাপানীরা। পোনাপের বেশিরভাগ স্টোর আর বাড়িঘর তৈরি হয়েছে জাপানী কায়দায়, ওরাই তৈরি করে রেখে গিয়েছে। শহরের বাইরে পাতা দিয়েঙ্কুঁড়ে তুলেছে স্থানীয় অধিবাসীরা।
একটা টিলার মাথায় চমৎকার একটা জাপানী বাংলোতে অভিযাত্রীদের নিয়ে এল কমাণ্ডার। টিলাটার এক ধার খাড়া নেমে গেছে সাগরে। বন্দর চোখে পড়ে ওখান থেকে, দেখা যায় বন্দরের ওপাশের বিশাল উঁচু রক অভ চোকাচ।
এটা তোমাদের বাড়ি,ম্যাকগয়ার বলল। যতদিন মন চায় থাক।
হলুদ মাদুরে এতে খুব আরাম। শুয়ে শুয়েই চোখে পড়ে নীল ল্যাগুনের এখানে ওখানে খুদে খুদে দ্বীপ, সাদা পালতোলা মাছ ধরা নৌকা। দেখা যায়, কয়েক হাজার ফুট উঁচু পর্বতের ওপর থেকে ঝরে পড়া রূপালি জলপ্রপাত।
বেহেশতই এটা, কি বল, কিশোর? মুসা বলল।
কিন্তু তার কথা কিশোরের কানে ঢুকল কিনা বোঝা গেল না। না বলে আবার কোথায় গায়েব হয়ে গেছে জামবু।